
Sanskar-Baisistya-o-paryalocana
সংস্কার: বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা
অতিসংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর
‘গ্রামবাৰ্ত্তা প্রকাশিকা‘ পত্রিকাটি কোথা থেকে প্রকাশিত হতো ?
উত্তর বাংলার কুষ্টিয়া থেকে।
বাংলায় কোন শতককে নবজাগরণের শতক বলা হয় ?
উত্তর উনিশ শতককে।
রেভারেন্ড জেমস লঙ কোন অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন?
উত্তর নীলদর্পণ নাটকের ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ করার জন্য।
‘বিদ্যাহারাবলী‘ কার লেখা?
উত্তর ফেলিক্স কেরির।
‘গোরা‘ উপন্যাস কে রচনা করেন ?
উত্তর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা‘ পত্রিকার সম্পাদক কে ছিলেন?
উত্তর হরিনাথ মজুমদার (কাঙাল হরিনাথ)।
‘শ্রীরামপুর ত্রয়ী‘ কাদের বলা হয় ?
উত্তর উইলিয়াম কেরি, মার্শম্যান এবং উইলিয়ম ওয়ার্ডকে একত্রে শ্রীরামপুর ত্রয়ী‘ বলা হয়।
‘সতীদাহ নিবারণ‘ আইন কে পাশ করেন?
উত্তর লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক।
‘সতীদাহ নিবারণ আইন‘ কবে পাশ হয়েছিল?
উত্তর 1829 খ্রিস্টাব্দে ।
কোন বছর ‘সাধারণ ব্রাত্মসমাজ‘ প্রতিষ্ঠিত হয় ?
উত্তর 1878 খ্রিস্টাব্দে ।
রামকৃষ্ণ মিশন কে প্রতিষ্ঠা করেন?
উত্তর স্বামী বিবেকানন্দ ।
কে ‘সম্বাদ কৌমুদী’ সম্পাদনা শুরু করেন?
উত্তর রাজা রামমোহন রায় ।
কলকাতা মাদ্রাসা কে, কবে প্রতিষ্ঠা করেন ?
উত্তর 1781 খ্রিস্টাব্দে লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংস।
এশিয়াটিক সোসাইটি কে, কবে প্রতিষ্ঠা করেন ?
উত্তর 1784 খ্রিস্টাব্দে উইলিয়াম জোন্স।
বারাণসী সংস্কৃত কলেজ কে, কবে প্রতিষ্ঠা করেন ?
উত্তর জনাথন ডানকান 1791 খ্রিস্টাব্দে ।
হিন্দু কলেজ কবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ?
উত্তর 1817 খ্রিস্টাব্দে।
‘বামাবোধিনী পত্রিকা‘র প্রচার বন্ধ হয় কত খ্রিস্টাব্দে?
উত্তর 1923 খ্রিস্টাব্দে।
নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের কথা জানা যায় কোন পত্রিকা থেকে?
উত্তর ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’।
পাশ্চাত্য ও প্রাচ্য শিক্ষার একজন করে সমর্থকের নাম লেখো।
উত্তর যথাক্রমে আলেকজান্ডার ডাফ এবং এইচ. টি. প্রিন্সেপ ।
চার্লস উড কে ছিলেন ?
উত্তর বোর্ড অব কন্ট্রোলের সভাপতি ।
ভারতের প্রথম মহিলা চিকিৎসক কে ছিলেন?
উত্তর কাদম্বিনী গাঙ্গুলি।
‘ভারতপথিক‘ কাকে বলা হয় ?
উত্তর রাজা রামমোহন রায়কে।
লন্ডন মিশনারি সোসাইটির দু‘জন সদস্যের নাম লেখো।
উত্তর ফরসিথ এবং মে সাহেব।
ভারতে প্রথম কে শবব্যবচ্ছেদ করেন ?
উত্তর ডা: মধুসূদন গুপ্ত
সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর
রাধাকান্ত দেব স্মরণীয় কেন ?
উত্তরঃ নারীশিক্ষা ও পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারে 1822 খ্রিস্টাব্দে রাধাকান্ত দেব ‘স্ত্রীশিক্ষা বিধায়ক’ নামক পুস্তিকা প্রকাশ করেন। এ ছাড়া তিনি হিন্দু কলেজ, স্কুলবুক সোসাইটি এবং ক্যালকাটা স্কুলবুক সোসাইটির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ বিভক্ত হলো কেন ?
উত্তরঃ কেশবচন্দ্র সেন ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজের নিয়ম ভেঙে নিজের 14 বছরের নাবালিকা কন্যাকে কোচবিহারের রাজার সঙ্গে 1878 সালে বিবাহ দেন। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী, শিবনাথ শাস্ত্রী, আনন্দমোহন বসু প্রমুখ কেশবচন্দ্রকে ত্যাগ করে ‘সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ’ গড়ে তোলেন।
মেকলে মিনিট কী ?
উত্তরঃ 1813 খ্রিস্টাব্দের সনদ আইন অনুসারে ভারতীয় শিক্ষাখাতে বার্ষিক এক লক্ষ টাকা ব্যয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সেই অর্থ প্রাচ্য না পাশ্চাত্য কোন খাতে ব্যয় হবে তা নিয়ে শুরু হয় দ্বন্দ্ব। এই দ্বন্দ্বের অবসানে ব্যাবিংটন মেকলে পাশ্চাত্য শিক্ষাখাতে অর্থব্যয়ের সিদ্ধান্ত নেন 1835 খ্রিস্টাব্দে। এই প্রস্তাবটি মেকলে মিনিট নামে পরিচিত ।
সমাজসংস্কারে নব্যবঙ্গ আন্দোলনের ভূমিকা কী ছিল ?
উত্তরঃ সমকালীন সমাজের জাতিভেদপ্রথা, বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, সতীদাহপ্রথা ও পৌত্তলিকতার অবসান করে নারীশিক্ষা, নারীস্বাধীনতা, পত্রিকার স্বাধীনতা প্রভৃতির স্বপক্ষে নব্যবঙ্গ আন্দোলন গড়ে উঠেছিল।
নববিধান কী ?
উত্তরঃ ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ থেকে 1878 সালে সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ বিভক্ত হয়ে গেলে 1880 সালে কেশবচন্দ্র সেন সর্বধর্ম সমন্বয়ের আদর্শে তাঁর নববিধান ঘোষণা করেন। কেশবচন্দ্রের নেতৃত্বাধীন সংগঠনটি ‘নববিধান‘ নামে পরিচিত হয়।
এদেশে পাশ্চাত্য শিক্ষার বিস্তারে খ্রিস্টান মিশনারিদের প্রধান উদ্দেশ্য কী ছিল ?
উত্তরঃ ঊনবিংশ শতকে ভারতবর্ষে সরকারি সাহায্য ছাড়াই খ্রিস্টান মিশনারিরা নিজেদের উদ্যোগে শিক্ষাবিস্তারে উদ্যোগী হয়েছিল। তারা মনে করত খ্রিস্টীয় সভ্যতার আলোই একমাত্র অসভ্য জাতিগুলিকে সভ্য করতে পারে। এইজন্যে তারা একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার পাশাপাশি ইতিহাস, ভূগোল, ব্যাকরণ প্রভৃতি বিষয়ে শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করে।
স্কুলবুক সোসাইটি কেন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ?
উত্তরঃ ডেভিড হেয়ার 1817 খ্রিস্টাব্দের 6 মে ‘স্কুলবুক সোসাইটি‘ প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর প্রধান লক্ষ্য ছিল ইংরেজি ও বাংলা ভাষায় দ্রুত পাঠ্যপুস্তক প্রকাশ করে শিক্ষার্থীদের মধ্যে তা বিতরণ করা, যা বাংলা ভাষার নবজাগরণের প্রেক্ষাপট তৈরিতে সহায়ক ছিল।
মধুসূদন গুপ্ত স্মরণীয় কেন?
উত্তরঃ মধুসূদন গুপ্ত ছিলেন একজন বাঙালি ব্রাহ্মণ অনুবাদক এবং আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক। তিনি 1836 সালে কুসংস্কারের বিরোধিতা করে কলকাতা মেডিকেল কলেজে ভারতে প্রথম মানবব্যবচ্ছেদ করার কৃতিত্ব অর্জন করেন।
লর্ড হার্ডিঞ্জের শিক্ষা বিষয়ক নির্দেশনামা গুরুত্বপূর্ণ কেন?
উত্তরঃ লর্ড হার্ডিঞ্জ ইংরেজি শিক্ষাকে সরকারি শিক্ষানীতি বলে ঘোষণা করেন। এই প্রস্তাবে পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রবর্তনের স্বপক্ষে যুক্তি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, এদেশের উচ্চ মধ্যবিত্তদের মধ্যে ইংরেজি শিক্ষার প্রসার ঘটবে। এ ছাড়া তিনি বলেন, নিম্নপরিস্রাবণ নীতি দ্বারা ইংরেজি শিক্ষা দেশের সাধারণ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়বে।
বাংলার নবজাগরণ বলতে কী বোঝায় ?
উত্তরঃ বাংলার নবজাগরণ বলতে বোঝায় বাংলায় ব্রিটিশ রাজত্বের সময় ঊনবিংশ ও বিং শতকে সামাজিক সংস্কার
আন্দোলনের জোয়ার ও অল্প সময়ে একাধিক গুণী মনীষীর আবির্ভাবকে
কাদম্বিনী (বসু) গঙ্গোপাধ্যায় স্মরণীয় কেন ?
উত্তরঃ কাদম্বিনী গাঙ্গুলি ব্রিটিশ ভারতের প্রথম দুইজন নারী স্নাতকের একজন এবং ইউরোপীয় চিকিৎসাশাস্ত্রে শিক্ষিত দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম মহিলা চিকিৎসক। উনিশ শতকের শেষভাগে তিনি পাশ্চাত্য চিকিৎসায় ডিগ্রি অর্জন করেন এবং আনন্দীবাই জোশীর সাথে তিনিও হয়ে ওঠে ভারতের প্রথমদিককার একজন নারীচিকিৎসক।
কোম্পানির শিক্ষাক্ষেত্রে চুঁইয়ে পড়া নীতি‘ বলতে কী বোঝায় ?
উত্তরঃ 1835 খ্রিস্টাব্দে টমাস ব্যাবিংটন মেকলে তাঁর পাশ্চাত্য শিক্ষা সংক্রান্ত নির্দেশনাম বা মেকলে মিনিট ঘোষণা করেন। মেকলের বক্তব্য অনুসারে, সমাজের উচ্চবর্গের কিছু মানুষ পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত হলে তাঁদের মাধ্যমে ধীরে ধীরে সমাজের নিম্নস্তরে শিক্ষা ছড়িয়ে পড়বে। ফলে সমাজের নীচের স্তরের মানুষরাও শিক্ষিত হবে। শিক্ষাবিস্তারের এই তত্ত্ব ডাউনওয়ার্ড ফিলট্রেশন থিয়োরি বা ক্রমনিম্ন পরিশ্রুত নীতি অর্থাৎ চুঁইয়ে পড়া নীতি নামে পরিচিত।
অ্যাডামের রিপোর্ট কী ?
উত্তরঃ স্কটল্যান্ড নিবাসী অ্যাডাম ব্যক্তিগত উদ্যোগে বাংলাদেশের শিক্ষা সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করে একটি রিপোর্ট তৈরি করেন। এতে তৎকালীন শিক্ষাব্যবস্থার চিত্র তুলে ধর হয়, ইতিহাসে এটি অ্যাডামের রিপোর্ট নামে পরিচিত।
কবে, কেন ‘নাট্যাভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইন‘ জারি করা হয়েছিল ?
উত্তরঃ নাট্যাভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইন 1876 খ্রিস্টাব্দে লর্ড নর্থব্রুকের নেতৃত্বে পাশ হয়। এই আইন ছিল ব্রিটিশ ভারতে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর শিল্পচর্চার মাধ্যমে পরাধীনতা ও ঔপনিবেশিক শাসকদে প্রতি প্রতিবাদ–প্রতিরোধের জন্য তৎকালীন সরকার কর্তৃক প্রবর্তিত একটি নিবর্তনমূলক পদক্ষেপ। আইনটি অদ্যাবধি ভারতবর্ষের বহু স্থানে বলবৎ রয়েছে।
অকল্যান্ড মিনিট কী ?
উত্তরঃ 1839 খ্রিস্টাব্দে লর্ড অকল্যান্ড প্রাচ্যবাদীদের নিরসনের জন্যে প্রাচ্য শিক্ষাক্ষেত্রে বার্ষিক 31000 টাকা ব্যয়ের যে প্রস্তাব সুপারিশ করেছিলেন তাই ‘অকল্যান্ড মিনিট‘ নামে পরিচিত।
কে, কাকে, কবে ব্রহ্মানন্দ উপাধিতে ভূষিত করেন ?
উত্তরঃ মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর 1862 খ্রিস্টাব্দে কেশবচন্দ্র সেনকে ব্রহ্মানন্দ উপাধিতে ভূষিত করেন।
কে, কবে, কেন অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠা করেন?
উত্তরঃ 1828 খ্রিস্টাব্দে ডিরোজিও অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন নামে বিতর্কসভা প্রতিষ্ঠা করেন। হিন্দুসমাজে প্রচলিত জাতিভেদপ্রথা রদ, মূর্তিপূজা ও অস্পৃশ্যতা দূর করাই ছিল এর উদ্দেশ্য।
সরকারি উদ্যোগে দেশীয় শিক্ষার বিবরণ দাও
উত্তরঃ কলকাতা মাদ্রাসা : 1780 সালে আরবি ও ফারসি ভাষায় শিক্ষাপ্রসারের উদ্দেশ্যে হেস্টিংস কলকাতা মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন।
এশিয়াটিক সোসাইটি : 1781 সালে দেশীয় ভাষাচর্চার জন্য সরকারি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
হাজি মহম্মদ মহসিন স্মরণীয় কেন ?
উত্তরঃ হাজি মহম্মদ মহসিন ছিলেন বাংলার একজন ধর্মপ্রাণ ও মহান জনহিতৈষী ব্যক্তি। তিনি তাঁর বিশাল সম্পত্তি বিভিন্ন জনহিতৈষী কাজে ব্যয় করেন। পরে সরকার ‘মহসিন ফান্ড‘ করে জনহিতৈষী বিভিন্ন কর্মসূচি চালিয়ে যায়।
শ্রীরামকৃষ্ণের সর্বধর্ম সমন্বয়ের আদর্শ কীরকম ছিল?
উত্তরঃ রামকৃষ্ণদেব বলেছেন—“যত মত ততো পথ।” অর্থাৎ প্রত্যেক ধর্মের মধ্যে সত্য আছে, প্রত্যেক ধর্মের মধ্যে দিয়ে ভগবানকে পাওয়া যায়। তাঁর এই মতবাদ এবং ধর্মীয় আদর্শ ধর্ম ও সামাজিক ক্ষেত্রে সহনশীলতার পরিবেশ তৈরি করেছিল।
প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য দ্বন্দ্ব কী ?
উত্তরঃ 1813 সালের সনদ আইন অনুসারে ভারতীয়দের শিক্ষার জন্য বার্ষিক এক লক্ষ টাকা ব্যয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এই অর্থ প্রাচ্য না পাশ্চাত্য কোন খাতে ব্যয় হবে সে সম্পর্কে সনদে কিছুই বলা হয়নি। একারণে ভারতে প্রাচ্য শিক্ষার সমর্থক ও পাশ্চাত্য শিক্ষার সমর্থকদের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব তা ইতিহাসে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য দ্বন্দ্ব নামে পরিচিত।
লালন ফকির কে ছিলেন?
উত্তরঃ লালন ফকির ছিলেন হিন্দু ও মুসলিম ধর্মশাস্ত্রের বিশ্লেষক তথা উনিশ শতকে বাংলার এক বাউল সাধক ।
নারীশিক্ষার বিস্তারে ঈশ্বরচন্দ্রের ভূমিকা কী ছিল ?
উত্তরঃ বাংলায় নারীশিক্ষার জনক ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের উদ্যোগে 35টি বিদ্যালয় স্থাপিত হয়। এ ছাড়া স্ত্রীশিক্ষা সম্মেলনী, হিন্দু ফিমেল স্কুল, মেট্রোপলিটন স্কুল প্রভৃতি প্রতিষ্ঠার সাথেও তিনি নিবিড়ভাবে যুক্ত ছিলেন।
নব্যবেদান্তবাদ কী?
উত্তরঃ স্বামী বিবেকানন্দের মতে মানবসেবাই ব্রহ্মের সেবা, তাঁর এই মতবাদ নববেদান্তবাদ নামে পরিচিত। তিনি এই মতানুসারে সমাজের সকল মানুষের সেবা করা এবং আত্মার মুক্তির জন্য সমাধির ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলেছেন।
ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য কী ছিল ? অথবা, ব্রাহ্মসমাজের সংস্কারমূলক কাজ কী ?
উত্তরঃ সমাজের কুসংস্কারের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ প্রতিবাদ গড়ে তোলা, বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহের বিরোধিতা করা, পৌত্তলিকতার অবসান করে শিক্ষাবিস্তার ও নারীস্বাধীনতা প্রভৃতির জন্য ব্রাহ্মসমাজ গঠিত হয়।
কী উদ্দেশ্যে, কে, কবে এশিয়াটিক সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেন ?
উত্তরঃ 1784 খ্রিস্টাব্দে স্যার উইলিয়াম জোন্স এশিয়াটিক সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেন। মূলত প্রাচা সাহিত্য, ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করার জন্য এটি প্রতিষ্ঠিত হয়।
ভারতে আধুনিক শিক্ষাপ্রসারে চার্লস উডের দু‘টি সুপারিশ লেখো। অথবা, উডের ডেসপ্যাচ কী ?
উত্তরঃ 1854 খ্রিস্টাব্দে চার্লস উডের সুপারিশে বলা হয়েছে, শিক্ষাবিস্তারে পৃথক শিক্ষাবিভাগ প্রতিষ্ঠা, ইংরেজি ও দেশীয় ভাষায় শিক্ষার সম্প্রসারণ করা এবং কলকাতা, মাদ্রাজ ও বোম্বাইয়ে তিনটি পৃথক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হবে। শিক্ষা সংক্রান্ত এই নির্দেশনামা উডের ডেসপ্যাচ নামে পরিচিত।
নব্যবঙ্গ গোষ্ঠী বলতে কী বোঝো? অথবা, নব্যবঙ্গ আন্দোলন কী? অথবা, নব্যবঙ্গীয় কাদের বলা হয় ?
উত্তরঃ ডিরোজিও এবং তাঁর হিন্দু কলেজের অনুগামী ছাত্রমণ্ডল উনিশ শতকের প্রথমার্ধে সামাজিক ও পাশ্চাত্য শিক্ষা সংক্রান্ত আন্দোলনের জন্য যে গোষ্ঠী গড়ে তোলেন তা নব্যবঙ্গ গোষ্ঠী নামে পরিচিত। এর সাথে যুক্ত ছিলেন রামগোপাল ঘোষ, রামতনু লাহিড়ি, রাধানাথ শিকদার প্রমুখ ।
‘বিধবাবিবাহ‘ কবে, কোন আইনের দ্বারা সিদ্ধ হয়?
অথবা, কে, কবে বিধবাবিবাহ আইনগতভাবে প্রচলন করেন?
উত্তরঃ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনকালে বিদ্যাসাগরের প্রচেষ্টায় লর্ড ক্যানিং 1856 খ্রিস্টাব্দে 15 নং রেগুলেশন দ্বারা হিন্দু ‘বিধবাবিবাহ’ আইন চালু করেন।
‘বামাবোধিনী পত্রিকা‘ প্রকাশের উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য কী ছিল ?
উত্তরঃ স্ত্রীশিক্ষার প্রসার, বাল্যবিবাহ, অসম বিবাহের বিরোধিতা করে নারীদের সচেতন করা, স্ত্রীজাতি থেকে কুসংস্কার দূর করে তাদের মধ্যে জ্ঞানের বিকাশ ঘটানোর জন্যই ‘বামাবোধিনী
পত্রিকা‘ প্রকাশ করা হয়।
‘গ্রামবাৰ্ত্তা প্রকাশিকা‘ কেন একটি ব্যতিক্রমী পত্রিকা তা উল্লেখ করো।
অথবা, ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা‘ পত্রিকার উদ্দেশ্য কী ছিল?
অথবা, ‘গ্রামবাৰ্ত্তা প্রকাশিকা‘ পত্রিকায় তৎকালীন গ্রামীণ সমাজের কোন ছবি ফুটে উঠেছে?
উত্তরঃ 1863 খ্রিস্টাব্দে হরিনাথ মজুমদার প্রকাশিত এই পত্রিকায় সাহিত্য, সংস্কৃতি, জ্ঞান–বিজ্ঞান, দর্শন প্রভৃতি সংবাদ প্রকাশের সাথে সাথে নারীশিক্ষার বিস্তার, কৃষক শ্রেণির দুরবস্থার খবর প্রভৃতি পরিবেশিত হতো।
কোন কোন বিদেশিনি বাংলার নারীশিক্ষার প্রসারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন?
উত্তরঃ মিসেস কুক, মেরি উইলসন, মেরি কার্পেন্টার প্রমুখ।
তিন আইন কী ? এটি কবে পাশ হয় ? এর ঘোষিত বিষয় কী?
উত্তরঃ 1872 খ্রিস্টাব্দে কেশবচন্দ্র সেন–এর নেতৃত্বে এই আইন পাশ হয়। এর দ্বারা বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ নিষিদ্ধ হয় এবং বিধবাবিবাহ, অসবর্ণ বিবাহ আইনসিদ্ধ হয়।
‘হুতোমপ্যাঁচার নক্সা‘ গ্রন্থটির দু‘টি বৈশিষ্ট্য লেখো।
উত্তরঃ (১) সমকালীন কলকাতার একটি সমাজচিত্র এখানে বর্ণিত হয়েছে।(২) এটি একটি নকশা বা ব্যঙ্গচিত্র জাতীয় রচনা এবং কলকাতা ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকার কথ্যভাষার ব্যবহার এখানে লক্ষণীয়।
কবে, কী উদ্দেশ্যে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ?
উত্তরঃ 1800 খ্রিস্টাব্দে লর্ড ওয়েলেসলি ইংল্যান্ড থেকে আগত ব্রিটিশ কর্মচারীদের ভারতীয় জীবনযাত্রা, ভাষা, সংস্কৃতি ও ধর্মীয় মতামত সম্পর্কে অবগত করার জন্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ।
দেশীয় ভাষায় প্রকাশিত সংবাদপত্র নিয়ন্ত্রণ আইন কী ? কেন প্রবর্তন করা হয়েছিল?
উত্তরঃ দেশীয় ভাষায় প্রকাশিত সংবাদপত্র নিয়ন্ত্রণ আইন 1878 সালে লর্ড লিটনের সময়কালে পাশ হয়েছিল। এই আইন স্থানীয় বা দেশীয় সংবাদপত্রের অত্যন্ত সমালোচনামূলক সংবাদ পরিবেশন দমন করার জন্য প্রণয়ন করা হয়েছিল।
বিশ্লেষণধর্মী প্রশ্নোত্তর
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ও তার তাৎপর্য বিশ্লেষণ করো।
উত্তরঃ
সূচনাঃ ভারতে শিক্ষা তথা উচ্চশিক্ষার বিকাশে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিকচিহ্ন হলো উডের ডেসপ্যাচের সুপারিশ অনুযায়ী লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুকরণে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা (1857 খ্রিস্টাব্দে)।
প্রতিষ্ঠাঃকলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়ঃ
ইউনিভার্সিটি কমিটিঃ উডের ডেসপ্যাচের সুপারিশের ভিত্তিতে লর্ড ডালহৌসির শাসনকালে গঠিত ইউনিভার্সিটি কমিটির দেওয়া রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করেই প্রতিষ্ঠিত হয় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় (24 জানুয়ারি, 1857 খ্রিস্টাব্দে)।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনঃ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুসারে, 41 জন সদস্য নিয়ে গঠিত সিনেটের হাতে শিক্ষানীতি রূপায়ণের ভার ন্যস্ত করা হয়। লর্ড ক্যানিং হন এর প্রথম আচার্য এবং স্যার জেমস উইলিয়াম কোলভিল হন প্রথম উপাচার্য।
পাঠদান–এর সূচনাঃ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট–এর প্রথম মিটিং হয় 30 জানুয়ারি, 1858 খ্রিস্টাব্দে কলকাতা মেডিকেল কলেজের কাউন্সিল রুম–এ। ক্যামাক স্ট্রিটের একটি ভাড়া বাড়িতে বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্থায়ী অফিস গড়ে ওঠে। 1861 খ্রিস্টাব্দের মার্চে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম এন্ট্রান্স পরীক্ষায় 244 জন পরীক্ষার্থী অংশগ্রহণ করে।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার তাৎপর্যঃ এতে শিক্ষাক্ষেত্রে বিশেষ করে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে জোয়ার আসে। ছাত্রদের পরীক্ষাগ্রহণ ও মেধাবী ছাত্রদের বৃত্তিদানের ফলে শিক্ষায় আগ্রহ বৃদ্ধি পায় ৷
শিক্ষার বিষয়বস্তুঃ শিক্ষাদানের সূচনা কলা বিভাগ দিয়ে হলেও পরবর্তীতে বিজ্ঞান, ফোর্ড কারিগরি, আইন, ডাক্তারি বিভাগেও শিক্ষার প্রসার ঘটেছিল।
জ্ঞানীগুণীদের উপস্থিতিঃ এই বিশ্ববিদ্যালয়ে দেশবিদেশের পণ্ডিতদের উপস্থিতি শিক্ষামহলে আলোড়ন ঘটায় যা শিক্ষাবিস্তারে সহায়ক হয় ।
মন্তব্যঃ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ফলে ভারতের প্রাথমিক শিক্ষা থেকে শুরু করে উচ্চশিক্ষার বিষয়টি পরিপূর্ণতা লাভ করলেও প্রতিষ্ঠাকালে এটি উচ্চশিক্ষাকেন্দ্র ছিল না, বরং তা ছিল পরীক্ষাগ্রহণকারী কেন্দ্র ।
‘হুতোম প্যাঁচার নক্সা‘ গ্রন্থে উনিশ শতকের বাংলার কীরূপ সমাজচিত্র পাওয়া যায়? অথবা, নকশা সাহিত্যের ইতিহাস হিসেবে ‘হুতোমপ্যাঁচার নক্সা‘র কৃতিত্ব উল্লেখ করো।
উত্তরঃ
সূচনাঃ উনিশ শতকে বাংলা সাহিত্যের যেসকল গ্রন্থে বাংলার তৎকালীন সমাজে ধরে প্রথ প্রতিচ্ছবি তুলে ধরা হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হলো হুতোমপ্যাঁচার নক্সা। কালীপ্রসন্ন সিংহ ‘হুতোমপ্যাঁচার নক্সা‘ গ্রন্থটি 1861 সালে প্রকাশ করেন।
বাংলার সংস্কৃতির আলোচনাঃ ‘হুতোমপ্যাঁচার নক্সা‘ গ্রন্থে তৎকালীন বাংলার বিভিন্ন অবদান ত আঞ্চলিক উৎসব যেমন—গাজন, রথযাত্রা, রামলীলা, চড়ক, বারোয়ারি দুর্গাপূজা, মাহেশের দ্বারকানাথ স্নানযাত্রা তুলে ধরা হয়েছে যা থেকে বাংলার সংস্কৃতির পরিচয় মেলে।
সমকালীন সমাজচিত্রঃ ‘হুতোম প্যাঁচা‘ ছদ্মনামে এখানে ব্যঙ্গবিদ্রুপের কশাঘাতে আধুনিক কলকাতার বাবুসমাজের জীবন্ত প্রতিচ্ছবি, উৎসব–অনুষ্ঠান, সামাজিক কুপ্রথা চলিত ভাষায় ও হাস্যরসাত্মক ভঙ্গিতে তুলে ধরা হয়েছে।
ব্যঙ্গচিত্রের প্রদর্শনঃ ‘হুতোমপ্যাঁচার নক্সা‘য় যেসব বাঙালি সাহেবদের ভাষা, চালচলন নকল করতে অভ্যস্ত তাদের তীব্র ভাষায় ব্যঙ্গবিদ্রুপ করা হয়েছে। এই গ্রন্থে মাতাল, ফোটা তিলক কাটা বৈয়বের কাহিনি, বাইজিনাচ, মদ্যপান সহ জমিদারদের কাহিনি তুলে ধরা হয়েছে।
মূল্যায়নঃ এই আলোচনায় স্পষ্ট যে সমকালীন বাংলার সামাজিক ও অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য তুলে ধরার ক্ষেত্রে এই গ্রন্থটি একটি প্রামাণ্য দলিল। এই গ্রন্থে সমাজের যেসকল মানুষের চরিত্র নিন্দনীয় নয়, তাদেরকে তিনি সং সাজিয়ে উপস্থাপিত করেছেন।
এদেশে চিকিৎসাক্ষেত্রে কলকাতা মেডিকেল কলেজের ভূমিকা কীরূপ ছিল ?
অথবা, ভারতে পাশ্চাত্য ও আধুনিক চিকিৎসাবিদ্যাচর্চার বিকাশে কলকাতা মেডিকেল কলেজের ভূমিকা আলোচনা করো।
উত্তরঃ
সূচনাঃ গভর্নর জেনারেল লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্কের উদ্যোগে 1835 খ্রিস্টাব্দে গ্রহ প্রতিষ্ঠিত কলকাতা মেডিকেল কলেজের হাত ধরে ভারতবর্ষে চিকিৎসাবিদ্যাচর্চায় নবযুগের সূচনা হয়েছিল। প্রাথমিক পর্যায়ে কলেজের সুপারিন্টেন্ডেন্ট পদে নিয়োগ করা হয়েছিল মাউন্ট ফোর্ড জোসেফ ব্রামলিকে। দ্বারকানাথ ঠাকুর সহ দেশীয় অভিজাতদের অনেকেই এই প্রতিষ্ঠানে অর্থদান করেন।
উদ্দেশ্যঃ প্রাথমিক পর্যায়ে কলকাতা মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠায় সরকারের উদ্দেশ্য ছিল এই কলেজ থেকে সাব–অ্যাসিস্ট্যান্ট সার্জেন্ট হিসেবে যোগ্যতা অর্জনকারী ছাত্রদের সামরিক ও অসামরিক কেন্দ্রে নিয়োগ করা। পরবর্তীতে জাতিধর্মনির্বিশেষে ভারতীয় যুবকদের চিকিৎসাবিদ্যায় দক্ষ করে তোলা এবং দক্ষ ডাক্তার ও নার্স জোগান দেওয়াই হয়ে ওঠে এই কলেজের উদ্দেশ্য।
শিক্ষার বিষয়ঃ 1835 সালে প্রতিষ্ঠিত কলকাতা মেডিকেল কলেজে ভেষজ, অঙ্গব্যবচ্ছেদবিদ্যা, রসায়নবিদ্যা, ঔষধের গুণাগুণ ও প্রয়োগ সংক্রান্ত বিষয়ে পাঠদান করা হতো। এই কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন ড. মধুসূদন গুপ্ত, ড. এ টি গুডউইড প্রমুখ।
শবব্যবচ্ছেদঃ 1836 খ্রিস্টাব্দে কলকাতা মেডিকেল কলেজে ড. মধুসূদন গুপ্তের হাত ধরে প্রথম শবব্যবচ্ছেদ চালু হয়েছিল। তৎকালীন কুসংস্কারে আচ্ছন্ন সমাজব্যবস্থায় ধর্মীয় কুসংস্কার যে যুক্তিহীন তা প্রমাণ করা হয়েছিল এই শবব্যবচ্ছেদ–এর মাধ্যমে।
প্রখ্যাত ডাক্তার তৈরিঃ খ্যাতনামা ডাক্তার তৈরিতে কলকাতা মেডিকেল কলেজের অবদান অনস্বীকার্য। এই কলেজে প্রথম ব্যাচে ডাক্তারি পাশ করেন উমাচরণ শেঠ, রাজকৃষ্ণ দে, দ্বারকানাথ গুপ্ত প্রমুখ ।
মূল্যায়নঃ এশিয়া মহাদেশের দ্বিতীয় মেডিকেল কলেজ হিসেবে কলকাতা মেডিকেল কলেজে আধুনিক চিকিৎসাবিদ্যা লাভ করে বহুছাত্র দেশের বিভিন্ন প্রান্তে চিকিৎসকের কাজে যুক্ত হন। এই কলেজ থেকে পাশ করা বহুডাক্তার পরবর্তীতে বিলেতে ডাক্তারি পড়ার যোগ্যতা অর্জন করেন।
নীলদর্পণ‘ নাটক থেকে উনিশ শতকের বাংলার সমাজজীবনের কীরূপ প্রতিফলন পাওয়া যায়?
অথবা, উনিশ শতকে বাংলার সমাজচিত্র তুলে ধরার ক্ষেত্রে ‘নীলদর্পণ‘ নাটকের কি ভূমিকা ছিল ?
অথবা, ‘নীলদর্পণ’ নাটক সম্বন্ধে আলোচনা করো। অথবা, ‘নীলদর্পণ” নাটক সম্বন্ধে কী জানো? অথবা, জাতীয়তাবাদ প্রসারে ‘নীলদর্পণ‘ নাটক–এর অবদান ও গুরুত্ব আলোচনা করো।
উত্তর
সূচনাঃ উনিশ শতকে বাংলার ইতিহাসে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল নীলচাষ এই নীলচাষের সাথে যুক্ত ছিলেন নীলকর সাহেব এবং নীলচাষিগণ। ‘নীলদর্পণ‘ নাটক থেকে নীলচাষিদের জীবনের বিভিন্ন ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ জানা যায়। ভারতীয়দের জাতীয়তাবাদের প্রসার ঘটানোর জন্য 1860 সালে দীনবন্ধু মিত্র ‘নীলদর্পণ‘ নাটকটি রচনা করেন। ওই বছরই নাটকটি প্রকাশিত হয় তাঁর ছদ্মনামে ৷
নীলচাষিদের দুর্দশার বিবরনঃ ‘নীলদর্পণ‘ নাটকে নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্র সমকালী নীলচাষিদের জীবনের বাস্তব চিত্র তুলে ধরেছেন। যেমন— খাদ্যশস্য চাষের পরিবর্তে কৃষকদের নীলচাষে বাধ্য করা, উৎপাদিত নীল বিক্রির সময় যথার্থ মূল্য থেকে বঞ্চিত হওয়া এবং চাষিদের ওপর অকথ্য অত্যাচার ও আর্থিক শোষণের কাহিনি।
জনমত সৃষ্টিতেঃ ‘নীলদর্পণ’ নাটকটি যখন বিভিন্ন জায়গায় মঞ্চস্থ হতে শুরু করে তখন শহর ও শহরতলির শিক্ষিত সমাজ নীলকর সাহেবদের বিরুদ্ধে একত্রিত হয়ে এক বলিষ্ঠ জনমত গড়ে তোলে যা ভারতীয়দের মধ্যে জাতীয়তাবাদ প্রসারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল।
নীল বিদ্রোহের কাহিনিঃ নীলকর সাহেবদের তীব্র শোষণ ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে বঞ্চিত নীলচাষিগণ বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে 1858 খ্রিস্টাব্দে শুরু করে নীল বিদ্রোহ যার পূর্ণাঙ্গ বিবরণ পাওয়া যায় ‘নীলদর্পণ’নাটকে। এই নাটকটি নীল বিদ্রোহের প্রসার ঘটাতে সহায়ক হয়েছিল।
উপসংহারঃ জেমস লঙ–এর সহযোগিতায় নাটকটির ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হলে বিদেশেও নীলকর সাহেবদের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে ওঠে। এরই সাথে এই নাটকটি বাংলায় সাধারণ নাট্যশালার বিকাশের পথ প্রশস্ত করেছিল, যদিও 1908 সালের পর সরকারিভাবে নাটকটি মঞ্চস্থ করা আইনত নিষিদ্ধ হয়।
পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারে ড্রিঙ্কওয়াটার বিটন (বেথুন) কী ভূমিকা নিয়েছিলেন ?
অথবা, উনিশ শতকে নারীশিক্ষার বিস্তারে ড্রিঙ্কওয়াটার বিটন (বেথুন) সাহেব কী ভূমিকা নিয়েছিলেন?
উত্তরঃ
সূচনাঃ উনিশ শতকে বাংলায় পাশ্চাত্য শিক্ষা তথা নারীশিক্ষার বিস্তারে যেসকল বিদেশি শিক্ষানুরাগী ভারতবর্ষে এসেছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম ব্যক্তিত্ব ছিলেন ড্রিঙ্কওয়াটার বিটন (বেথুন) সাহেব। ব্রিটিশ শাসনকালে বেথুন সাহেব 1848 খ্রিস্টাব্দে লর্ড ডালহৌসির আইনমন্ত্রী হিসেবে ভারতবর্ষে এসেছিলেন। তিনি ভারতবর্ষের দুর্বিষহ গ্রামীণ রীতিনীতি এবং শিক্ষাব্যবস্থা দেখে নিরাশ হয়েছিলেন। আর এর পরেই তিনি ভারতবর্ষে নারীশিক্ষার বিস্তারে বিশেষ করে পাশ্চাত্য শিক্ষার বিস্তারে প্রয়াসী হয়েছিলেন।
নিজ ভাষায় পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রয়াসঃ বেথুন আঞ্চলিক ভাষা বিশেষ করে প্রতিটি প্রাদেশিক ভাষায় শিক্ষাদানের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেন। তাঁর মতে,এর ফলে সামাজিক কুসংস্কারের যেমন অবসান হবে তেমনি পিছিয়ে–পড়া নারীদের মধ্যে শিক্ষারও প্রসার হবে।
বেথুন স্কুল প্রতিষ্ঠাঃ নারীশিক্ষার প্রসারে উদ্যোগী ব্রিটিশ মন্ত্রীসভার সদস্য বেথুন 1849 খ্রিস্টাব্দের 7 মে একটি বালিকা বিদ্যালয় (হিন্দু ফিমেল স্কুল) প্রতিষ্ঠা করেন। এই বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়, মদনমোহন তর্কালঙ্কার, রামগোপাল ঘোষ প্রমুখ খুবই উদ্যোগী ছিলেন। বিদ্যাসাগর ছিলেন এই স্কুলের প্রথম সম্পাদক।
বেথুন কলেজ স্থাপনঃ বিশেষ সামাজিক বেড়াজালে আবদ্ধ তৎকালীন নারীসমাজের মধ্যে উচ্চশিক্ষার বিস্তারের জন্য বেথুন কলকাতায় একটি মহিলা কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন যা বর্তমানে বেথুন কলেজ নামে পরিচিত। কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায় এবং চন্দ্রমুখী বসু ছিলেন এই কলেজ থেকে পাশ করা প্রথম মহিলা স্নাতক।
আধুনিক শিক্ষার প্রসারঃ বাংলার নারীদের মধ্যে আধুনিক শিক্ষার প্রসার ঘটানোর জন্য দের বেথুন ফিমেল জুভেনাল সোসাইটি প্রতিষ্ঠায়, বঙ্গানুবাদ সমাজ গঠনে এবং কলকাতা পাবলিক লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
মূল্যায়নঃ ড্রিঙ্কওয়াটার বিটন কলকাতার বেথুন স্কুলের প্রতিষ্ঠালগ্নে বলেছিলেন—“আমি বিশ্বাস করি আজকের দিনটিতে একটি বিপ্লবের সূচনা করতে যাচ্ছি ….. আমরা সফল হয়েছি এবং আজকে যে আদর্শের বীজ বপন করা হলো তা আর কোনো দিন বিফল হবে না।” প্রসঙ্গত, ভারতবর্ষে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য শিক্ষার মেলবন্ধন ঘটিয়ে শিক্ষার বিস্তারে বেথুন যে অবদান রেখে গেছেন তা চিরস্মরণীয়।
সতীদাহপ্রথা কীভাবে রদ হয় ?
অথবা, সতীদাহপ্রথা বিরোধী আন্দোলন সম্পর্কে একটি নিবন্ধ লেখো।
উত্তর
সূচনাঃ প্রাচীনকাল থেকেই ভারতীয় হিন্দুসমাজে সতীদাহপ্রথার প্রচলন ছিল। ঊনবিংশ শতকের গোড়া থেকেই পাশ্চাত্য শিক্ষা ও যুক্তিবাদের প্রসার ঘটলে যেসকল সামাজিক কুসংস্কার ও কুপ্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়েছিল তার মধ্যে অন্যতম ছিল সতীদাহপ্রথাবিরোধী আন্দোলন।
সার্বিক আন্দোলনঃ প্রাচীন হিন্দুরীতি অনুযায়ী, গোঁড়া হিন্দুদের কাছে সতীদাহপ্রথা পবিত্র ও মহান হলেও বাস্তবে তা ছিল প্রচণ্ড নিষ্ঠুর ও কুসংস্কারে আচ্ছন্ন। উনিশ শতকে কলকাতা সহ বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে এর বিরুদ্ধে শুরু হয় সার্বিক আন্দোলন।
কোম্পানির প্রথম পদক্ষেপঃ 1805 খ্রিস্টাব্দে নিজামত আদালতে পণ্ডিত ঘনশ্যাম কমিটি প্রথম সতীদাহপ্রথা সম্পর্কে মতামত জানায়। এই মতামতের ভিত্তিতে 1813 খ্রিস্টাব্দে সরকার সর্বপ্রথম গর্ভবতী ও অল্পবয়সি নারীর সতী হওয়া নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
রামমোহনের প্রচেষ্টাঃ মানবতাবাদী রামমোহন রায় প্রতিষ্ঠিত ‘আত্মীয় সভা‘ সতীপ্রথার বিরুদ্ধে জনমত গঠনে সচেষ্ট হয়। সতীদাহপ্রথার বিরুদ্ধে রামমোহন একটি বই লিখে প্রমাণ করেন সতীদাহপ্রথা শাস্ত্রসম্মত নয়। তাই তিনি সরাসরি সাহায্য চেয়ে উইলিয়াম বেন্টিঙ্কের কাছে আবেদন করেন।
বেন্টিঙ্কের উদ্যোগঃ উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক সতীপ্রথা বন্ধের লক্ষ্যে সরকারি কর্মচারীদের সাথে আলোচনা করে 1829 খ্রিস্টাব্দের 4 ডিসেম্বর সতীদাহ প্রথাকে 17 নং রেগুলেশন জারির দ্বারা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন।
উনিশ শতকে বাংলায় নারীশিক্ষার বিস্তারে রাধাকান্ত দেব কীরূপ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন ?
অথবা, সমাজসংস্কারক হিসেবে ও পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারে রাধাকান্ত দেবের ভূমিকা আলোচনা করো।
উত্তর
সূচনাঃ ঊনবিংশ শতকে ভারতবর্ষে পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারে দেশীয় যেসব মনীষী ভূমিকা নিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন রাধাকান্ত দেব। রাধাকান্ত দেব চেয়েছিলেন প্রাচ্যবাদী শিক্ষাকাঠামোয় পাশ্চাত্য শিক্ষার বিকাশ হোক। তাঁর অনুপ্রেরণায় ও পৃষ্ঠপোষকতায় হিন্দু কলেজের ছাত্ররা ইংরেজি সাহিত্য ও পাশ্চাত্য বৈজ্ঞানিক গবেষণার গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থগুলি বাংলায় অনুবাদ করেন।
হিন্দু কলেজের অবদানঃ প্রগতিশীল চিন্তার দ্বারা আন্তরিকভাবে রাধাকান্ত দেব হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠার সাথে যুক্ত ছিলেন। 1818 খ্রিস্টাব্দ থেকে পরবর্তী 32 বছর পর্যন্ত রাধাকান্ত দেব হিন্দু কলেজের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।
বিজ্ঞানশিক্ষা বিস্তারের প্রয়াসঃ বিজ্ঞানশিক্ষার প্রসারে রাধাকান্ত দেব চিকিৎসাবিদ্যায় শবব্যবচ্ছেদকে সমর্থন করেন। এ ছাড়া ভারতীয় ছাত্রদের উচ্চতর বিজ্ঞানশিক্ষার জন্য বিদেশে পাঠানোর ব্যাপারে তিনি তহবিল গঠন করেন।
নারীশিক্ষার প্রসারেঃ রাধাকান্ত দেব নারীশিক্ষার প্রসারেও অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলে তিনি নিজ বাসভবনে ‘ফিমেল জুভেনাইল সোসাইটি‘র ছাত্রীদের পরীক্ষাগ্রহণের ব্যবস্থা করেন তিনি ক্যালকাটা ফিমেল স্কুল প্রতিষ্ঠায় ও স্ত্রীশিক্ষা বিষয়ক পুস্তক রচনায় এবং মহিলাদের ইংরেজি শিক্ষাগ্রহণে সহযোগী ছিলেন।
উপসংহারঃ রাধাকান্ত দেব পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারে সর্বক্ষেত্রেই উদ্যোগী এবং আগ্রহী ছিলেন। তবে তিনি ইংরেজি শিক্ষার সাথে খ্রিস্টান ধর্মপ্রচারের বিরোধী ছিলেন। ধর্মীয় কারনে তিনি রামমোহনের বিরোধী হলেও উভয়েই বিশ্বাস করতেন পাশ্চাত্য শিক্ষা ছাড়া দেশে সামগ্রিক উন্নয়ন সম্ভব নয়।
লর্ড মেকলে–কে এদেশে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রবর্তক বলা হয়নি কেন?
উত্তর
সূচনাঃ ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন গভরনার জেনারেল লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্কের আইন সচিব টমাস ব্যাবিংটন মেকলে। ব্রিটিশ পার্লামেন্ট 1813 খ্রিস্টাব্দের সনদ আইনে ভারতের জনশিক্ষার জন্য বার্ষিক এক লক্ষ টাকা ব্যয় করার কথা বললেও সেই অর্থ প্রাচ্য না পাশ্চাত্য কোন শিক্ষাখাতে ব্যয় হবে সে সম্পর্কে স্পষ্ট কোনো কিছু বলা হয়নি। সেই প্রশ্নকে কেন্দ্র করে সরকারের ঘনিষ্ঠ বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে বিতর্ক দেখা দেয়।
প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যবাদীদের বক্তব্যঃ প্রাচ্যবাদী শিক্ষার সমর্থকদের মধ্যে এইচ টি প্রিন্সেপ, কোল ব্রুক, উইলসন প্রমুখ এদেশে প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্য ও দর্শন বিষয়ে শিক্ষাদানের পক্ষপাতী ছিলেন। অন্যদিকে পাশ্চাত্যবাদী শিক্ষার সমর্থকদের মধ্যে মেকলে, আলেকজান্ডার ডাফ, সন্ডার্স, কলভিন প্রমুখ এদেশে পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রবর্তনের দাবি জানান ।
মেকলে মিনিটঃ বেন্টিঙ্কের আমলে (1828-35) জনশিক্ষা কমিটির সভাপতি টমাস ব্যাবিংটন মেকলে ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রবর্তনের দাবি জানিয়ে বড়োলাট লর্ড বেন্টিঙ্ক–এর কাছে একটি প্রস্তাব পেশ করেন। এতে তিনি বলেন যে দেশের উচ্চবিত্ত শ্রেণি ইংরেজি শিক্ষাগ্রহণ করলে তা নিম্ন পরিস্রাবণ নীতি অনুসারে ধীরে ধীরে সমাজের সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়বে যা মেকলে মিনিট নামে পরিচিত।
এই প্রস্তাবে তিনি বলেন, (ক) প্রাচ্যের শিক্ষা নিকৃষ্ট ও বৈজ্ঞানিক চেতনাহীন। তাই এদেশে পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রবর্তিত হওয়া উচিত। (খ) পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারের ফলে এদেশে এমন একটি সম্প্রদায়ের আত্মপ্রকাশ ঘটবে যারা “রক্তে ও বর্ণে ভারতীয় হলেও রুচি, মত, নৈতিকতা ও বুদ্ধিমত্তায় হবে ইংরেজ।”
সরকারের সিদ্ধান্তঃ অবশেষে মেকলের বক্তব্য মেনে নিয়ে বড়োলাট লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক 1835 সালে ভারতে ইংরেজি ও পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারকে সরকারি নীতি হিসেবে ঘোষণা করেন ৷
ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষাপ্রবর্তনের ফলাফল সম্পর্কে লেখো ?
অথবা, ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতে ইংরেজি ও আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষাপ্রসারের ফলাফল আলোচনা করো।
উত্তরঃ ঊনবিংশ শতকের প্রথমার্ধ থেকেই ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রবর্তন ও প্রসারের ফলে মধ্যযুগীয় অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার ও ঘৃণা থেকে ভারতীয়রা মুক্ত হতে শুরু করে। ঊনবিংশ শতকের তৃতীয় ও চতুর্থ দশক থেকে পাশ্চাত্য শিক্ষাপ্রসারের ব্যাপক উদ্যোগ লক্ষ করা যায়।
পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারের ফলাফলঃ ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষাপ্রসারের সুদূরপ্রসারী ফলাফল নিম্নরূপ—
যুক্তিবাদের প্রসারঃ পাশ্চাত্য তথা ইংরেজি শিক্ষাগ্রহণের দ্বারা ভারতীয়দের মধ্যে কুসংস্কারাচ্ছন্ন মধ্যযুগীয় বর্বরতার অবসান ঘটে। সমাজের সকল শ্রেণির মানুষের মধ্যে যুক্তিবাদের প্রসার ঘটে। মানুষ যুক্তিতর্কের কষ্টিপাথরে বিচারবিশ্লেষণ করতে শেখে।
মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভবঃ পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রবর্তনে ভারতে আধুনিক ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত নামে নতুন শ্রেণির উদ্ভব হয় যা ভারতীয় সমাজে শ্রেণিবৈষম্য সৃষ্টি করে।
জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষঃ পাশ্চাত্য শিক্ষাব্যবস্থা ভারতীয়দের বিভিন্ন বৈদেশিক শিক্ষা সম্পর্কে জানতে সাহায্য করে যা ভারতীয় জাতীয়তাবাদ ও দেশাত্মবোধের ধারণার বিস্তার ঘটাতে সাহায্য করেছিল ও এভাবেই ভারতে জাতীয় চেতনার উন্মেষ হয়।
মূল্যায়নঃ এই আলোচনায় স্পষ্ট, পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার বিভিন্ন রকম সংস্কারের সহায়ক হয়ে এক নবযুগের সূচনা করে। তবে নানারূপ দুর্বলতা সত্ত্বেও পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রবর্তন ঊনবিংশ শতকে বহু সমাজ ও ধর্মসংস্কার আন্দোলনের সূচনা করে যা পরে ব্রিটিশবিরোধী জাতীয় সংগ্রামের পটভূমি তৈরি করেছিল।
প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য দ্বন্দ্ব বলতে কী বোঝায় ?
অথবা, ঔপনিবেশিক শাসনকালে শিক্ষাবিস্তারে প্রাচ্য–পাশ্চাত্যবাদী দ্বন্দ্ব কী?
অথবা, এদেশে শিক্ষাবিস্তারে প্রাচ্যবাদী ও পাশ্চাত্যবাদী বিতর্ক আলোচনা করো।
উত্তরঃ
সূচনাঃ ঊনবিংশ শতকের প্রথমার্ধ থেকেই বহু বিদেশি ও ভারতীয় শিক্ষানুরাগী মানুষের প্রচেষ্টায় এদেশে শিক্ষাবিস্তারে জোয়ার আসে। এক্ষেত্রে কোম্পানি প্রথম পর্যায়ে প্রাচ্য শিক্ষার সমর্থক হলেও পরবর্তীতে সরকারিভাবে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তার নিয়ে যে বিতর্কের সৃষ্টি হয় তা–ই প্রাচ্য–পাশ্চাত্য দ্বন্দ্ব নামে পরিচিত।
প্রাচ্য–পাশ্চাত্য দ্বন্দ্বঃ
সনদ আইন (1813) ঔপনিবেশিক শাসনকালে 1813 সালের সনদ আইন অনুসারে ভারতীয় শিক্ষাখাতে বার্ষিক এক লক্ষ টাকা ব্যয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কিন্তু এই টাকা প্রাচ্য না পাশ্চাত্য কোন খাতে ব্যয় হবে তা নিয়ে শুরু হয় প্রাচ্য–পাশ্চাত্য দ্বন্দ্ব।
প্রাচ্য শিক্ষার সমর্থকদের মতামতঃ প্রাচ্য শিক্ষার সমর্থকদের মতে, কোম্পানির শিক্ষানীতি হওয়া উচিত ভারতীয় ভাষায়। এই নীতির পক্ষে ছিলেন উইলসন, কোলব্রুক, স্যার প্রিন্সেপ প্রমুখ।
পাশ্চাত্যবাদীদের যুক্তিঃ পাশ্চাত্য শিক্ষার সমর্থকদের মতে, শিক্ষার মাধ্যম হওয়া উচিত ইংরেজি, বিষয় হওয়া উচিত পাশ্চাত্যের জ্ঞান–বিজ্ঞান। এই মতের সমর্থক ছিলেন মেকলে, রাজা রামমোহন রায়, আলেকজান্ডার ডাফ প্রমুখ।
প্রাচ্য–পাশ্চাত্য দ্বন্দ্বের অবসানঃ 1813 খ্রিস্টাব্দের পর থেকে প্রাচ্য–পাশ্চাত্য শিক্ষার সমর্থকদের মধ্যে শিক্ষাবিস্তার নিয়ে দ্বন্দ্ব দীর্ঘদিন চলতে থাকে। অবশেষে‘General Committee of Public Instruction-এর সভাপতি টমাস ব্যাবিংটন মেকলে 1835 খ্রিস্টাব্দের 2 ফ্রেব্রুয়ারি ‘মেকলে মিনিট’ নামক এক রিপোর্টে পাশ্চাত্য শিক্ষার সমর্থনে সরকারি অর্থব্যয়ের নির্দেশ দেন। আর এভাবেই প্রাচ্য–পাশ্চাত্য দ্বন্দ্বের অবসান হয়েছিল।
মন্তব্যঃ প্রাচ্য–পাশ্চাত্য দ্বন্দ্ব দীর্ঘদিন চললেও এই দ্বন্দ্বই আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থায় এক নব উন্মাদনার সূত্রপাত করেছিল। এই দ্বন্দ্বের অবসানে ভারতবর্ষে সরকারিভাবে পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারের অগ্রগতি লক্ষ করা যায়।
ইয়ং বেঙ্গল আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও ।
অথবা, টীকা লেখো : নব্যবঙ্গ গোষ্ঠী।
উত্তরঃ
সূচনাঃ ঊনবিংশ শতকের দ্বিতীয় ও তৃতীয় দশকে হিন্দু কলেজের অধ্যাপক হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিওর নেতৃত্বে কিছু তরুণ ছাত্র পাশ্চাত্য ভাবধারার আদর্শে যুক্তিবাদ, মুক্তচিন্তা, মানসিক চিন্তা, সততার মাধ্যমে সমাজসংস্কারে ব্রতী হয়। তারা ইয়ং বেঙ্গল বা নব্যবঙ্গ গোষ্ঠী নামে পরিচিত। তাদের পরিচালিত আন্দোলনই ছিল নব্যবঙ্গ আন্দোলন।
আন্দোলনের উদ্দেশ্যঃ নব্যবঙ্গ গোষ্ঠীর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল একদিকে হিন্দুসমাজ, খ্রিস্টধর্ম ও পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাব থেকে সনাতন হিন্দুধর্ম ও হিন্দুসমাজকে রক্ষা করা এবং অপরদিকে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার ঘটিয়ে হিন্দুসমাজের গোঁড়ামি, কুপ্রথা ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে জনমত গঠন করা।
নব্যবঙ্গ দলের কার্যকলাপঃ নব্যবঙ্গীয়দের মূললক্ষ্য ছিল হিন্দুসমাজের চিরাচরিত কুপ্রথাগুলির বিরোধিতা করা। ডিরোজিওর ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ ছাত্ররা 1828 খ্রিস্টাব্দে ‘অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন‘ নামে এক বিতর্ক সভা প্রতিষ্ঠা করেন সামাজিক কুসংস্কার ও কুপ্রথা দূর করার জন্যে। এ ছাড়া পার্থেনন ও ক্যালাইডোস্কোপ পত্রিকায় তাঁরা হিন্দুসমাজের বহুবিবাহ, নারীর শিক্ষা, জুরির বিচার, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও বিভিন্ন বিষয়ে লেখালেখি শুরু করেন।
আন্দোলনের নেতৃত্বঃ ডিরোজিও ছাড়াও অন্যান্য অনুগামীর মধ্যে ছিলেন কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, রামগোপাল ঘোষ, রাধানাথ শিকদার, রসিককৃষ্ণ মল্লিক, রামতনু লাহিড়ী প্রমুখ।
সমালোচনাঃ খুব অল্পসময়ে এই আন্দোলন স্ফুলিঙ্গের মতো ছড়িয়ে পড়লেও তা কেবলমাত্র কলকাতা শহরের কিছু ধনী হিন্দুসমাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। গ্রামগঞ্জের সকল শ্রেণির মধ্যে এই আন্দোলন লক্ষ করা যায়নি। তবে তাঁরা দেশের সভ্যতা ও সংস্কৃতির দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুকরণ করতে আগ্রহী ছিলেন একথা বলা যায়। ঐতিহাসিক অমলেশ ত্রিপাঠী নব্যবঙ্গ গোষ্ঠীকে ‘নকল দেশ‘ বলে মন্তব্য করেছেন।
তবে সমালোচনা সত্ত্বেও নব্যবঙ্গীয়দের সত্যানুসন্ধানী মনোভাব, দেশাত্মবোধ ও সংস্কৃতির চেতনা উনিশ শতকের নবজাগরণকে সমৃদ্ধ করেছিল।
শ্রীরামকৃষ্ণ সর্বধর্মসমন্বয়ের আদর্শ কীভাবে তুলে ধরেন?
উত্তরঃ
সূচনাঃ আধুনিক ভারতের ধর্মীয় ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব হলেন শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব। উনিশ শতকের বাংলায় ধর্মীয় আন্দোলন যখন নানা মত ও পথের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলেছে তখন রামকৃষ্ণ সর্বধর্মসমন্বয়ের সন্ধান দেন। আসলে তিনি এক নবহিন্দুধর্মের ভিত্তিস্থাপন করেছিলেন।
শিবজ্ঞানে জীবসেবাঃ সাধারণ পোশাক পরে সহজসরল ভাষা ও উপমার সাহায্যে তিনি ধর্মীয় মতাদর্শ প্রচার করেন। তিনি বলতেন, সব মানুষের মধ্যেই ঈশ্বর বিরাজ করে, তাই জীবে দয়া নয়—তিনি শিবজ্ঞানে জীবসেবার কথা বলেন।
যত মত তত পথঃ শ্রীরামকৃষ্ণ বৈষ্ণব থেকে শাক্ত, ইসলাম থেকে খ্রিস্টীয়, দ্বৈত থেকে অদ্বৈত, সাকার থেকে নিরাকার, সগুণ থেকে নির্গুণ সবধরনের ধর্মীয় সাধনায় উত্তীর্ণ হন। তিনি সাধনার মাধ্যমে এই সত্যে উপনীত হন—সব ধর্ম সত্য এবং সব ধর্মমত অনুসরণে ঈশ্বরকে পাওয়া যায়। তিনি বলেন—“যত মত তত পথ।”
মূল আদর্শঃ শ্রীরামকৃষ্ণের ধর্মের মূল আদর্শ হলো সর্বধর্মসমন্বয়। তিনি সকল ধর্মের মধ্যে সুসম্পর্কের বা সর্বধর্মসমন্বয়ের আদর্শ প্রচার করে বলেন, সব মতকে এক–একটি পথ বলে জানবে। আমার মত ঠিক আর অপরের সব মিথ্যে এইরকম বোধ যেন না হয়, বিজ্ঞের ভাব যেন না হয়। তিনি বলেন, ঈশ্বর এক ও অভিন্ন। লোকে তাঁকে বিভিন্ন নামে ডাকে।
মূল্যায়নঃসর্বধর্মসমন্বয়ের ক্ষেত্রে শ্রীরামকৃষ্ণ বেদান্ত দর্শন অনুসরণে বলেছেন, “যত্র জীব তত্র শিব।” তাঁর মতে, মানুষের মধ্যে ঈশ্বরের অধিষ্ঠান রয়েছে। জীবসেবা করলেই শিবসেবা করা হয়।
টীকা লেখো—লালন ফকির।
অথবা, উনিশ শতকে বাংলা ধর্মীয় সমন্বয়ে লালন ফকিরের অবদান কীরূপ?
অথবা, ধর্মচিন্তায় লালন ফকিরের সমন্বয়বাদ প্রকাশিত হয়—আলোচনা করো।
অথবা, বাংলার সমাজজীবনে লালন ফকিরের অবদান কী ?
উত্তর
সূচনাঃ উনিশ শতকে বাংলায় ধর্মীয় সমন্বয়ের ক্ষেত্রে যেসকল ব্যক্তির উদ্যোগ লক্ষ করা যায় তাঁদের অন্যতম ছিলেন লালন ফকির। তিনি তাঁর প্রায় দু‘হাজার গানের মাধ্যমে ধর্মসমন্বয়ের বার্তা দিয়েছিলেন। তাঁর বাউল গানগুলি অতিসহজসরল হলেও গভীর তাৎপর্যপূর্ণ ও মর্মস্পর্শী এবং মানবতাবাদের উদাহরণ।
বংশপরিচয়ঃ1774 খ্রিস্টাব্দের 17 অক্টোবর বর্তমান বাংলাদেশের ঝিনাইদহ জেলার হরিশচন্দ্রপুর গ্রামে লালন ফকিরের জন্ম হয়েছিল। তবে অনেকের মতে, তিনি জন্মেছিলেন কুষ্টিয়া জেলার ভাঁড়ড়া গ্রামে। তাঁর পিতা ছিলেন মাধবরাও, মাতা ছিলেন পদ্মাবতী দেবী।
বাউলগানের শিক্ষাঃ শৈশবকাল থেকে তিনি সংগীতপ্রিয় ছিলেন। লালন সিরাজ সাঁইয়ের কাছে বাউলগানের দীক্ষা নেন। তিনি একটি বাউল আখড়া তৈরি করে শিষ্যসহ বসবাস করতেন বলে জানা যায়।
ধর্মসমন্বয়ের আদর্শঃ লালন ফকির বিশ্বাস করতেন সকল মানুষের মধ্যে বাস করে এক মনের মানুষ। সেই মনের মানুষের কোনো জাতিধর্মবর্ণ ও লিঙ্গভেদ নেই। তাই সেই মানুষকে নিয়ে লালন গান বেঁধেছিলেন—
“মিলন হবে কত দিনে
আমার মনের মানুষেরই সনে।”
তিনি জাতিভেদপ্রথা মানতেন না, তাঁর গান ছিল মর্মস্পর্শী, মানবতাবাদী আদর্শে পূর্ণ। তাই
তিনি গেয়েছেন—
“সব লোকে কয় লালন কি জাত এ–সংসারে
লালন কয় জাতির কি রূপ দেখলাম না এনজরে।”
এভাবে গানের ভাষায় লালন ফকির সর্বধর্মের সমন্বয়বাদী আদর্শের প্রচারে প্রয়াসী হয়েছিলেন।
মূল্যায়নঃ লালন ফকিরের গান ও তাঁর জীবনদর্শন রবীন্দ্রনাথ, কাজী নজরুল ইসলামের মতো খ্যাতনামা সাহিত্যিক, দার্শনিক ও বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের মানুষদেরও প্রভাবিত করেছে। 1890 খ্রিস্টাব্দে 116 বছর বয়সে লালন ফকির পরলোকে গমন করেছিলেন।
মধুসূদন গুপ্ত স্মরণীয় কেন?
অথবা, মধুসূদন গুপ্তের শবব্যবচ্ছেদ সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।
উত্তরঃ
সূচনাঃ উনিশ শতকে বাংলার বিজ্ঞানশিক্ষায় বিশেষ করে চিকিৎসাবিজ্ঞানে এক অভূতপূর্ণ পরিবর্তনের সূচনা করেছিলেন ডা: মধুসূদন গুপ্ত। 1836 খ্রিস্টাব্দের 28/22 অক্টোবর তিনি কলকাতা মেডিকেল কলেজে প্রথম শবব্যবচ্ছেদ করে একটি যুগান্তকারী ঘটনা ঘটিয়েছিলেন।
মধুসূদন গুপ্তের পরিচয়ঃ হুগলি জেলার বৈদ্যবাটি গ্রামে 1800 খ্রিস্টাব্দে বৈদ্য চিকিৎসক পরিবারে মধুসূদন গুপ্ত জন্মগ্রহণ করেন। সংস্কৃত সাহিত্যে জ্ঞানলাভের পর তিনি 1826 খ্রিস্টাব্দে সংস্কৃত কলেজের বৈদিক শ্রেণিতে ভর্তি হয়ে চিকিৎসাশাস্ত্রে অধ্যয়ন শুরু করেন।
শবব্যবচ্ছেদের কৃতিত্বঃ কলকাতা মেডিকেল কলেজ 1835 খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরও শবব্যবচ্ছেদ করে জ্ঞান অর্জনের পথে হিন্দুধর্মের কুসংস্কার ছিল অন্যতম বাধা। কিন্তু মধুসূদন গুপ্ত 1836 খ্রিস্টাব্দে শবব্যবচ্ছেদ করে ধর্মীয় কুসংস্কার যে যুক্তিহীন তা প্রমাণ করেন। এই শবব্যবচ্ছেদে মধুসূদন গুপ্তের সহযোগী ছিলেন উমাচরণ শেঠ, রাজকৃষ্ণ দে, দ্বারকানাথ গুপ্ত ও নবীনচন্দ্র মিত্র প্রমুখ ।
গ্রন্থপ্রকাশঃ মধুসূদন গুপ্ত ‘লন্ডন ফার্মাকোপিয়া‘ নামে একটি গ্রন্থ বাংলায় অনুবাদ করেন। তিনি সংস্কৃত ভাষায় অপর একটি গ্রন্থ অনুবাদ করেন। এটি রবার্ট ওপার–এর লেখা‘Anatomist Vade Mecum. ‘
ধর্মীয় কুসংস্কার দূরীকরণঃ মধুসূদন গুপ্তের হাত ধরে সমকালীন সমাজে শবব্যবচ্ছেদ সম্পন্ন হলে এক বিরাট কুসংস্কারের হাত থেকে সমাজ রক্ষা পায়। যদিও এই কারণে তাঁকে জাতিচ্যুত করা হয় কিন্তু তবুও তিনি সমাজের কাছে মাথা নত করেননি।
উপসংহারঃ আধুনিক চিকিৎসা জগতের প্রাণপুরুষ মধুসূদন গুপ্তের হাত ধরেই চিকিৎসাক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছিল। 1865 খ্রিস্টাব্দের 15 নভেম্বর তিনি পরলোকগমন করেন।
ধর্ম ও সমাজসংস্কারে বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর অবদান কী ছিল ?
উত্তর
সূচনাঃ উনিশ শতকের বাংলায় এক অন্যরকম ধর্মসংস্কারক তথা সাধক ছিলেন বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং কেশবচন্দ্র সেনের সঙ্গে তিনি ব্রাহ্মসমাজের হয়ে একাধিক কর্মসূচি পরিচালনা করেন। শান্তিপুরে গোবিন্দ গোস্বামীর টোলে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে কলকাতার সংস্কৃত কলেজে তিনি তাঁর শিক্ষাজীবন কাটিয়েছিলেন।
ব্রাহ্মসমাজে যোগদান ও বিতর্কঃ 1863 সালে ব্রাহ্মসমাজে যোগদান ও বিতর্ক করে দীর্ঘ 25 বছর ভারতের বিভিন্ন স্থানে তিনি ব্রাহ্মধর্মপ্রচার করেছিলেন। 1878 সালে সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠার পর তাঁর সঙ্গে ব্রাহ্মসমাজের দূরত্ব বাড়ে এবং আচার্য পদ থেকে তাঁকে অপসারণ করা হয় ।
নব্যবৈয়ব আন্দোলনঃ ব্রাহ্মসমাজ ত্যাগ করার পর জীবনের শেষ চোদ্দো বছর তিনি বৈয়বধর্মপ্রচারে ও ধর্মসাধনায় মন দেন এবং বাংলায় নব্যবৈয়ব আন্দোলনের সূচনা করেন। বিপিনচন্দ্র পাল, অশ্বিনীকুমার দত্ত, সতীশ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ তাঁর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
সংস্কারঃ নব্যবৈয়বধর্মের প্রচারের সাথে সাথে বিজয়কৃষ্ণ স্ত্রীশিক্ষা এবং জাতির উন্নয়নে প্রয়াসী হয়েছিলেন।
মন্তব্যঃ ধর্মসংস্কারক ও সমাজসংস্কারক হিসেবে সন্ন্যাসগ্রহণের পর বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর নাম হয়েছিল অচ্যুতানন্দ সরস্বতী। 1899 খ্রিস্টাব্দে পুরীতে তিনি পরলোকগমন করেন।
কাঙাল হরিনাথের ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা‘ পত্রিকা সমকালীন জনমানসে কী প্রভাব ফেলেছিল?
অথবা, ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকা‘ পত্রিকা তৎকালীন সমাজজীবনে কী প্রতিফলন ঘটিয়েছে তা সংক্ষেপে লেখো।
উত্তরঃ
সূচনাঃ উনিশ শতকে বাঙালি জনমানসে ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকা’ পত্রিকার প্রভাব গুরুত্বপূর্ণ। 1863 খ্রিস্টাব্দে হরিনাথ মজুমদার সম্পাদিত এই পত্রিকাটি প্রথমে পাক্ষিক ও পরে সাপ্তাহিক হিসেবে প্রকাশিত হয়। এই পত্রিকায় সমকালীন বাংলার সমাজজীবনের বিভিন্ন দিক ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
গ্রামীণ সাংবাদিকতাঃ গ্রামীণ সাংবাদিকতার পথিকৃৎ হরিনাথ মজুমদার গ্রামের বিভিন্ন সামাজিক রীতিনীতি এমনকী গ্রামীণ সমাজের খুঁটিনাটি দিকগুলি তুলে ধরেছেন এই পত্রিকায়।
নারীদের সামাজিক স্থানঃ ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকা‘ পত্রিকা থেকে সমকালীন সমাজে নারীর দুরবস্থার কথা জানা যায়। তবে নারীশিক্ষাপ্রসারে ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকা‘র গুরুত্বও কোনো অংশে কম নয় ৷
জমিদারদের শোষণঃ এই পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরা হয়েছে সমকালীন বাংলার জমিদার, জোতদার ও মহাজন প্রমুখের শোষণ ও অত্যাচারের কথা। চড়াহারে রাজস্ব, অতিরিক্ত কর, কারণে–অকারণে জমি থেকে প্রজাদের উচ্ছেদ ছিল তৎকালীন সমাজে নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা।
নীলকর সাহেবদের অত্যাচারঃ এই পত্রিকায় তুলে ধরা হয়েছে কীভাবে নীলকর সাহেবরা সাধারণ চাষিদের জোর করে নীলচাষে বাধ্য করত। আর এর বিরুদ্ধে নীলচাষিরা কীভাবে প্রতিবাদী হয়ে উঠেছিল সেইসব ঘটনার বিবরণ।
আধুনিক শিক্ষার প্রসারেঃ ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকা‘ পত্রিকার মাধ্যমে সমকালীন সমাজে শিক্ষার প্রয়োজন এবং শিক্ষার প্রসারের জন্য প্রচেষ্টা লক্ষ করা যায়। বিশেষ করে পিছিয়ে–পড়া নারীদের মধ্যে আধুনিক শিক্ষাপ্রসারের ওপর এখানে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল।
মূল্যায়নঃ ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা‘ পত্রিকার সম্পাদক হরিনাথ মজুমদার অতিদারিদ্র্যের মধ্যেও পত্রিকা প্রকাশনার কাজ চালিয়ে যান। তাই তিনি ‘কাঙাল হরিনাথ‘ নামেও পরিচিত। তাঁর মূললক্ষ্য ছিল সমকালীন অবস্থা সম্পর্কে সাধারণ মানুষ তথা সমাজকে সচেতন করে তোলা।
রচনাধর্মী প্রশ্নোত্তর
উনিশ শতকে বাংলার সমাজসংস্কারে ব্রাহ্মসমাজের উদ্যোগগুলি কী ছিল? অথবা, ব্রাহ্মসমাজের উদ্যোগে সমাজসংস্কার আন্দোলনে রামমোহন রায়, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কেশবচন্দ্র সেনের অবদান আলোচনা করো ।
উত্তরঃ
সূচনাঃ ঊনবিংশ শতকে বাংলার হিন্দুসমাজের মধ্যে জাগরণ ঘটিয়ে সমাজকে কুসংস্কারমুক্ত করার জন্য রাজা রামমোহন রায় 1828 খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠা করেন ‘ব্রাহ্মসভা’। 1830 খ্রিস্টাব্দে ব্রাহ্মসভা রূপান্তরিত হয় ব্রাহ্মসমাজে। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল ভারতবর্ষে যথার্থ হিন্দুসমাজ ও হিন্দুধর্মের প্রতিষ্ঠা এবং সম্পূর্ণভাবে পৌত্তলিকতার অবসান ঘটানো।
রাজা রামমোহনের প্রয়াসঃ বাংলার সমাজসংস্কারে ভারতপথিক রাজা রামমোহন রায় ছিলেন অগ্রদূত। তিনি সমকালীন ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার সমর্থক হলেও সমাজে প্রচলিত কুসংস্কারগুলির বিরোধিতা করে যুক্তিনির্ভর প্রমাণের সাহায্যে সেগুলি যে ভুল তা প্রচারে প্রয়াসী ছিলেন। এই পদক্ষেপ বাস্তবায়িত করার জন্যই তিনি 1828 খ্রিস্টাব্দে ‘ব্রাহ্মসভা‘ প্রতিষ্ঠা করেন।
সতীদাহপ্রথা রদঃ রামমোহন রায়ের তীব্র বিরোধিতা ও তাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক 1829 খ্রিস্টাব্দে আইন প্রণয়ন করে সতীদাহ নিষিদ্ধ করেন।
নারীকল্যাণঃ সমাজে নারীদের নির্দিষ্ট মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠার জন্য রামমোহন রায় প্রয়াসী ছিলেন। তিনি সম্পত্তিতে নারীর অধিকার, নারীশিক্ষার প্রসার, নারীদের প্রাপ্য মর্যাদা দিতে প্রয়াসী ছিলেন।
দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রয়াসঃ রামমোহন রায়–এর পরবর্তীতে ব্রাত্মসমাজের হাল ধরেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি ‘ব্রাহ্মসমাজের অনুষ্ঠান পদ্ধতি‘ নামক একটি গ্রন্থরচনা করেন।
তত্ত্ববোধিনী সভাঃ দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রচেষ্টায় 1839 খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয় তত্ত্ববোধিনী সভা, যেখানে বাংলার শিক্ষা, সমাজ ও সাংস্কৃতিক বিকাশের বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। এই সভার মুখপত্র ছিল 1843 খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’।
কেশবচন্দ্রের প্রয়াসঃ 1857 খ্রিস্টাব্দে কেশবচন্দ্র সেন ব্রাহ্মসমাজে যোগদান করলেও তিনি তাঁর নিজস্ব উদ্যম ও বাগ্মিতার বলে অল্পসময়ে ব্রাত্ম আন্দোলনের প্রধান নেতায় পরিণত হন। তিনি ছিলেন ব্রাত্ম আন্দোলনের প্রথম অব্রাক্ষ্মণ আচার্য।
তিন আইন পাশঃ কেশবচন্দ্রের প্রচেষ্টায় 1872 খ্রিস্টাব্দে তিন আইন পাশ হয়। এর দ্বারা বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ নিষিদ্ধ করে বিধবাবিবাহ ও অসবর্ণ বিবাহ আইনসিদ্ধ হয়েছিল।
নববিধান প্রতিষ্ঠাঃ 1880 খ্রিস্টাব্দে কেশবচন্দ্র সেনের নেতৃত্বে ভারতীয় ব্রাত্মসমাজ পরিবর্তিত হয়ে গড়ে ওঠে নববিধান ব্রাহ্মসমাজ‘ যা সমাজসংস্কারের ক্ষেত্রে জোয়ার নিয়ে আসে।
এ ছাড়া কেশবচন্দ্র সেন 1860 খ্রিস্টাব্দে ‘সংগত সভা’ প্রতিষ্ঠা করে নিপীড়িত মানুষদের সহায়তায় উদ্যোগী হয়েছিলেন। তিনি নারীশিক্ষার প্রসার ও নারীদের কল্যাণের জন্য ব্রাহ্মিকা সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন।
মূল্যায়ন : ঊনবিংশ শতকের অন্তিম লগ্নে ব্রাহ্মসমাজ আন্দোলন দ্বিধাবিভক্ত হলেও এর গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না। সমাজ, ধর্মশিক্ষা, জনসেবা ইত্যাদি ক্ষেত্রে ব্রাহ্মসমাজের ভূমিকা প্রশংসনীয়। আর এভাবেই বাংলায় নবজাগরণের সূত্রপাত হয়েছিল।
ঊনবিংশ শতকে বাংলায় নবজাগরণ ও তার চরিত্র সম্পর্কে যা জানো লেখো।
অথবা, উনিশ শতকের বাংলায় নবজাগরণ বলতে কী বোঝো? এই নবজাগরণের প্রকৃতি সম্পর্কে আলোচনা করো।
অথবা, উনিশ শতকে বাংলায় কি সত্যি নবজাগরণ ঘটেছিল ?
উত্তর
সূচনাঃ উনিশ শতকে বাংলার সাংস্কৃতিক ভাবজগতে যে বৌদ্ধিক আন্দোলন শুরু হয়েছিল তাকে ঐতিহাসিকেরা ‘নবজাগরণ’আখ্যা দিয়েছেন। এইসময় পাশ্চাত্যের সঙ্গে প্রাচ্যের যোগাযোগের কারণে বাংলার সমাজ, ধর্ম, সংস্কৃতি প্রভৃতিতে এক ব্যাপক পরিবর্তন নেমে আসে। ইটালির নবজাগরণের সঙ্গে তুলনা করে অনেকে বাংলার এই জাগরণকে ‘Bengal Renaissance’ বা ‘বঙ্গীয় নবজাগরণ‘ নামে অভিহিত করেছেন।
নবজাগরণের সংজ্ঞাঃ উনিশ শতকের বাংলা ছিল কলকাতাকেন্দ্রিক। সেইসময় কলকাতা ও সংলগ্ন এলাকায় পাশ্চাত্যের আধুনিক সাহিত্য, দর্শন, যুক্তিবাদ, মানবতাবাদ, উদারতাবাদ প্রভৃতির দ্বারা বাংলার সংস্কৃতি প্রভাবিত হয়। এর সাথে বাংলায় পাশ্চাত্য শিক্ষা, জ্ঞান–বিজ্ঞানের চর্চা, ধর্মীয় উদারতা ও সমাজসংস্কারের সূচনা হয়। উনিশ শতকের এই অগ্রগতিকে ঐতিহাসিকেরা বাংলার নবজাগরণ বলে উল্লেখ করেছেন।
নবজাগরণের প্রকৃতিঃ বাংলার নবজাগরণের প্রকৃতি বা চরিত্র নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে বিতর্ক বর্তমান।
শহরকেন্দ্রিকতাঃ বাংলার এই নবজাগরণের প্রভাব অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ছিল কলকাতানির্ভর। কখনো তা পার্শ্ববর্তী শহরতলিতে কিছুটা দেখা গেলেও সমগ্র বাংলাজুড়ে এর কোনো প্রভাবই লক্ষ করা যায়নি।
হিন্দু জাগরণবাদঃ বাংলার নবজাগরণ প্রকৃতপক্ষে হিন্দু জাগরণবাদে পর্যবসিত হয়। তাই অনেকে মনে করেন যে উনিশ শতকে বাংলার নবজাগরণে ধর্মনিরপেক্ষ মানবতাবাদের ভূমিকা ছিল খুবই গৌণ।
সরকারপ্রীতিঃ উনিশ শতকের নবজাগরণের সঙ্গে যুক্ত বেশিরভাগ ব্যক্তি সামাজিক সংস্কারের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলেন। তাঁরা কখনোই ভারতবর্ষের স্বাধীনতার বিষয়ে চিন্তিত ছিলেন এমন প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
স্থাপত্য–ভাস্কর্য অবহেলিতঃ উনিশ শতকে বাংলার রাজধানীকেন্দ্রিক নবজাগরণে স্থাপত্য ও ভাস্কর্যশিল্পের বিষয় সম্পূর্ণভাবে অবহেলিত ছিল।
অবহেলিত মুসলিম সমাজঃ বঙ্গীয় নবজাগরণের নিয়ন্ত্রক ছিল হিন্দুসমাজ। মুসলিম সমাজ পুরোপুরিভাবে এই নবজাগরণ থেকে দূরে ছিল।
সামাজিক কাঠামো অপরিবর্তিতঃ বঙ্গীয় নবজাগরণ বাংলার সামাজিক ক্ষেত্রে বিশেষ করে সামাজিক শ্রেণিবিন্যাস, জাতিভেদপ্রথা, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে কোনো পরিবর্তন করতে পারেনি।
মন্তব্যঃ নবজাগরণ বাংলার স্তব্ধ হয়ে যাওয়া জীবনে এক নতুন গতিসঞ্চার করেছিল তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। অবশ্য ব্রিটিশ রাজত্বকালে বাংলার নবজাগরণের প্রাণশক্তি ছিল অত্যন্ত ক্ষীণ । অধ্যাপক বিনয় ঘোষ বাংলার নবজাগরণকে ‘অতিকথন’বা একটি ‘ঐতিহাসিক প্রতারণা’বলেছেন।
পাশ্চাত্য শিক্ষার বিস্তারে ডেভিড হেয়ারের উদ্যোগ সম্পর্কে আলোচনা করো ।
অথবা, ডেভিড হেয়ার কেন বিখ্যাত?
উত্তর
সূচনাঃ স্কটল্যান্ডের ঘড়ি ব্যবসায়ী ডেভিড হেয়ার সম্পূর্ণ ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে ভারতবর্ষে এসেছিলেন। কিন্তু এদেশের সংস্কৃতির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে তিনি এদেশীয় মানুষের কল্যাণের জন্য নিজ ব্যয়ে শিক্ষাবিস্তারে প্রয়াসী হয়েছিলেন। মানবতাবাদী চরিত্রের অধিকারী ডেভিড হেয়ার এদেশের মানুষের মধ্যে জ্ঞানের আলো প্রজ্বলিত করার জন্য আর নিজের দেশে ফিরে যাননি।
শিক্ষাবিস্তারে ডেভিড হেয়ারের অবদান
ক্যালকাটা বুক সোসাইটি স্থাপনঃ ডেভিড হেয়ার নিজস্ব উদ্যোগে তৎকালীন বাংলার গরিব ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে শিক্ষার বিকাশ ঘটানোর জন্য ইংরেজি ও ভারতীয় বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষায় পাঠ্যপুস্তক ছাপানোর ব্যবস্থা করেন। আর এই উদ্দেশ্যেই তিনি 1817 খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় প্রতিষ্ঠা করেন ‘ক্যালকাটা বুক সোসাইটি।
হিন্দু কলেজ স্থাপনে ডেভিড হেয়ারের উদ্যোগঃ শিক্ষার বিকাশ বিশেষ করে উচ্চশিক্ষার বিস্তারের জন্য কলকাতায় 1817 খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ‘হিন্দু কলেজ। এই কলেজ প্রতিষ্ঠার সাথে নিবিড়ভাবে যুক্ত ছিলেন ডেভিড হেয়ার। কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি সুপ্রিমকোর্টের প্রধান বিচারপতি হাইড ইস্টের কাছ থেকে সমর্থন আদায় করেন। এছাড়া রাজা রামমোহন রায় ও রাধাকান্ত দেবকেও তিনি সক্রিয়ভাবে সাহায্য করেন। অবশেষে 1817 খ্রিস্টাব্দের 20 জানুয়ারি প্রতিষ্ঠিত হয় হিন্দু কলেজ যা বর্তমানে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় নামে পরিচিত।
ক্যালকাটা স্কুলবুক সোসাইটি স্থাপনঃ কলকাতা শহরতলির স্কুলগুলিতে উন্নতমানের পাঠদান এবং বিভিন্ন স্থানে নতুন স্কুল প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ডেভিড হেয়ার 1818 খ্রিস্টাব্দের 1 সেপ্টেম্বর গড়ে তোলেন ক্যালকাটা স্কুলবুক সোসাইটি।
হেয়ার স্কুল স্থাপনঃ 1818 খ্রিস্টাব্দে ডেভিড হেয়ার কলকাতায় গড়ে তোলেন ‘পটলডাঙা অ্যাকাডেমি‘ নামে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যা বর্তমানে হেয়ার স্কুল নামে পরিচিত। তৎকালীন সময়ে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ইংরেজি ভাষায় শিক্ষাপ্রদান করা হতো।
মূল্যায়নঃ 1835 খ্রিস্টাব্দে কলকাতা মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠায় ডেভিড হেয়ার অনন্য ভূমিকা পালন করেন। আধুনিক শিক্ষার প্রসারে এবং সাধারণ মানুষের কাছে ইংরেজি শিক্ষার _জনকরূপে ডেভিড হেয়ার ভারতীয়দের কাছে একজন চিরস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব।