চুল ও ত্বকের সমস্যা
একটু ইতিহাসে চোখ রাখলে দেখা যাবে সৌন্দর্য বজায়ে রূপচর্চার চল বহু প্রাচীন কাল থেকেই চলে আসছে যার প্রত্যক্ষ উদাহরণ আয়ুর্বেদশাস্ত্রে রূপচর্চার বর্ণনা। আয়ুর্বেদে ত্বকের যত্নে বর্ণপ্রসাদক ঔষধিসমূহ নিয়ে আলোচনায় আচার্য চরক দশটি ভেষজের কথা বলেছেন। সেগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল শ্বেতচন্দন, নাগকেশর, পদ্মক, মুলেঠি, মঞ্জিষ্ঠা, অনন্তমূল ইত্যাদি। পাশাপাশি চুলের পরিচর্যার ক্ষেত্রে কেশ অর্থাৎ চুলের পক্ষে হিতকর ঔষধিবর্গের সুবিস্তারিত তথ্যও পাওয়া যায়।
ত্বকের সমস্যায় আয়ুর্বেদ
আয়ুর্বেদ মতে মানুষের ত্বক সাতটি স্তরে বিভক্ত এবং প্রতিটি স্তরের গঠন, কাজ, রোগ উৎপত্তিও ভিন্ন ভিন্ন হয়। আবার প্রকৃতিগত বিভাজনে (বাত, পিত্ত, কফ) ত্বকের সমস্যা ও তার চিকিৎসাও স্বতন্ত্র। যেমন—
১. রুক্ষ শুষ্ক ত্বকের যত্নে কাঁচা দুধ
বাতজ প্রকৃতির ব্যক্তিরা সাধারণত এই জাতীয় সমস্যায় ভুক্তভোগী হয়ে থাকেন। এক্ষেত্রে কাঁচা দুধ তুলোয় করে নিয়মিত মাখা উচিত যা ত্বকের গভীরে গিয়ে পুষ্টি জোগাতে এবং লাবণ্য ফেরাতে অদ্বিতীয় ভূমিকা পালন করে। সঙ্গে মধুর, অম্ল, লবণ রস সমৃদ্ধ খাদ্যদ্রব্য পথ্য হিসেবে সেবনীয়।
২. ব্রণনাশে নিম ও ঘৃতকুমারী
পিত্তজ প্রধান ব্যক্তিদের প্রধানত ব্রণর সমস্যা দেখা দেয়। এক্ষেত্রে নিমপাতা বাটা ঘৃতকুমারীর রসের সঙ্গে মিশিয়ে স্নানের মিনিট দশেক আগে নিয়মিত ব্যবহার করলে আশাপ্রদ ফল পাবেন। ব্রণর সমস্যা দীর্ঘদিন ধরে ভোগালে, শিমুল কাঁটা ও ধনেগুঁড়ো দুধের সঙ্গে বেটে মাখুন। তবে সাথে যদি কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা থাকে, সেক্ষেত্রে ১ চামচ পরিমাণ ত্রিফলা চূর্ণ রাতে গরম জলের সঙ্গে কিছুদিন সেব্য।
৩. ত্বকের কালোছোপ রোধে আমলা–হলুদ
১ চামচ আমলকী পাউডারের সঙ্গে ১ চামচ হলুদ গুঁড়ো মিশিয়ে পেস্ট বানিয়ে নিন। স্নানের আগে ছোপ প্রধান জায়গায় মেখে ফেলুন। মিনিট পনেরো পর ঈষদুষ্ণ জলে ধুয়ে ফেলতে হবে। নিয়মিত এই প্যাক ব্যবহারে ত্বকের প্রাকৃতিক জেল্লা ফিরে আসে। সঙ্গে সুপাচ্য আহার ও শাক সব্জি সেবনের প্রতি লক্ষ রাখাও জরুরি।
৪. ত্বকের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধিতে কেশর ও চন্দন
ত্বকের লাবণ্য বর্ধনে কেশর ও চন্দনের ভূমিকা যথেষ্ট প্রশংসনীয়। প্রত্যহ দু‘বার কেশর ও চন্দন বাটা মেখে মিনিট দশেক পর হালকা গরম জলে সুতির কাপড় ভিজিয়ে ত্বক মুছে নিন। উল্লেখযোগ্য ফল পেতে সঙ্গে ব্যবহার করতে পারেন কুমকুমাদি তৈল নামক আয়ুর্বেদ ওষুধ। গোলাপি ঠোঁট কাঙ্ক্ষিত মুখেরা কমলালেবুর খোসাচূর্ণের সঙ্গে পরিমাণমতো গোলাপ জল মিশিয়ে ঠোঁটে মাখুন, তবে ধূমপান নৈব নৈব চ৷
৫.ত্বকের এলার্জিতে মঞ্জিষ্ঠা ও নিম
অনেকের ত্বকে একটুতেই অ্যালার্জি দেখা দেয় বা লাল ছোপ পড়ে। ক্ষেত্রবিশেষে জ্বালাভাব পরিলক্ষিত হয়। ফলে, বিশেষ প্রসাধনী ব্যবহারের আগে তাঁরা বিড়ম্বনার শিকার হয়ে পড়েন। এক্ষেত্রে মঞ্জিষ্ঠা চূর্ণ ও নিমপাতা একসঙ্গে মিশিয়ে পেস্টের মতো করে মাখুন। উপকার পাবেন।
চুলের সমস্যায় আয়ুর্বেদ
আয়ুর্বেদে চুলের নানাবিধ সমস্যার সমাধান হিসেবে নিয়মিত তেলমাখাকে সর্বাগ্রে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে এবং তার ফলাফল হিসেবে বলা হয়েছে যে, ‘ন খালিত্যং ন পালিত্যং ন কেশা প্রপন্ততি’ অর্থাৎ নিয়মিত তেল ব্যবহারে একদিকে যেমন চুল ঝরে পড়ে না, অন্যদিকে চুলে অকালপক্বতাও আসে না। তাই চুলের সমস্যাকে সমূলে উৎপাটন করতে গেলে চুলে নিয়মিত তেল মাখা অত্যন্ত জরুরি। এছাড়াও ফলপ্রসূ যোগগুলি হলো–
১. চুলের অকালপক্কতায় আমলকী তৈল
যাঁদের অকালে চুল পেকে যাচ্ছে, তাঁরা সবুজ আমলার স্বরস সমপরিমাণ নারকেল তেলের সঙ্গে মিশিয়ে মৃদু তাপে পাক করে নিন। আমলার জলীয় পদার্থ বাষ্প হয়ে গেলে পরিষ্কার মিহি কাপড়ে সেটি ফিল্টার করে রেখে দিন। নিয়মিত চুলের গোড়ায় হালকাভাবে ঘষে ঘষে লাগান। এতে চুল ঘন, মূল দৃঢ় ও কৃষ্ণবর্ণ হয়। এই সমস্যায় পিত্তবর্ধক খাদ্যদ্রব্য (যেমন, অতিরিক্ত ভাজাভুজি, ফাস্টফুড, লবণাক্ত খাওয়ার ইত্যাদি) এড়িয়ে চলা উচিত।
২. খুশকির সমস্যায় ত্রিফলা ও টক দই
যাঁদের খুশকির সমস্যায় নাজেহাল অবস্থা, তাঁরা স্নানের আধ ঘণ্টা আগে টক দইয়ের সঙ্গে এক চামচ ত্রিফলা চূর্ণ ও ১/৪
চামচ পরিমাণ টঙ্কন ভস্ম (আয়ুর্বেদ ওষুধের দোকানে কিনতে পাবেন) ভালো করে মিশিয়ে চুলে লাগিয়ে রাখুন। উল্লেখযোগ্য ফলাফল পেতে সপ্তাহে দুই থেকে তিনবার এটি ব্যবহার করতে পারেন।
৩. চুলপড়া রোধে ভৃঙ্গরাজ
ভৃঙ্গরাজ চুলের জন্য অমৃত সমান। চুলপড়া রোধে এটির স্বরস নিয়মিত মাখা উচিত।সঙ্গে লেবুর রসে দ্বিগুণ পরিমাণ নারকেল তেল মিশিয়ে ব্যবহার করলে আশাতীত ফল পাওয়া যায়। চুলের স্বাস্থ্যে যেহেতু অস্থি ধাতুর পুষ্টির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত তাই ক্যালশিয়ামের ঘাটতির ব্যাপারটিও নজরে রাখা উচিত।
৪. নিস্তেজ চুলে মুলতানি মাটির শ্যাম্পু
পরিষ্কার মুলতানি মাটি পরিমাণমতো ভিজিয়ে রেখে দিন। ঘণ্টা খানেক পরে ফুলে উঠলে, তাতে জল দিয়ে গাঢ় ঘোল বানিয়ে ফেলুন। এটি শ্যাম্পুর মতো করে সপ্তাহে দু‘বার মতো চুলে ব্যবহার করুন। চুল মোলায়েম রাখতে এবং উজ্জ্বলতা ফিরিয়ে আনতে মুলতানি মাটির জুড়ি নেই।
৫. চুলের স্বাস্থ্যে যোগব্যায়াম
বিভিন্ন গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে মানসিক উদ্বেগ চুলের স্বাস্থ্যহানির অন্যতম কারণ। নিয়মিত প্রাণায়াম ও যোগা মানসিক ভারসাম্য বজায় রাখতে অব্যর্থ। তাই সুন্দর স্বাস্থ্যোজ্জ্বল কেশবিন্যাস পেতে নিয়মিত যোগা ও প্রাণায়াম অভ্যাস করুন। সম্ভব হলে খেয়ে উঠে মিনিট পাঁচেক বজ্রাসনে বসার অভ্যেস গড়ে তুলুন।
সবশেষে বলি, চুলের যত্নের নামে অবৈজ্ঞানিক ভাবে ঘনঘন কৃত্রিম রং ব্যবহার ও হেয়ার ড্রায়ারের অভ্যেস কিন্তু ক্ষতিকর হতে পারে।এক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ প্রার্থনীয়।বিভিন্ন গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে মানসিক উদ্বেগ চুলের স্বাস্থ্যহানির অন্যতম কারণ।