ভাবসম্প্রসারণ | Vab Somprosaron in Bengali Grammar Notes to each chapter is provided in the list so that you can easily browse throughout different chapter ভাবসম্প্রসারণ | Vab Somprosaron in Bengali Grammar and select needs one.
Vab Somprosaron-bhabsomprosaron-Vab Somprosaron-bhabsomprosaron-Vab Somprosaron-bhabsomprosaronVab Somprosaron-bhabsomprosaron-Vab Somprosaron
ভাবসম্প্রসারণ
‘জ্ঞানের কথাকে প্রমাণ করিতে হয়, আর ভাবের কথাকে
সঞ্চার করিয়া দিতে হয়।’ –রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
সাহিত্য চিরকালই ভাবসমৃদ্ধ। সেই ভাবের বলয়ে নিহিত থাকে অন্য এক ব্যঞ্ছনা। তাকে খুঁজে বের করার নামই ভাবসম্প্রসারণ। কবি-সাহিত্যিকের রচনায় এমন কিছু উদ্ধৃতি থাকে, যার অর্থ-ব্যঞ্ছনা সুদূরপ্রসারী। ভাবসম্প্রসারণ হল সেই নিগূঢ় অর্থ বা বক্তব্যের বিস্তারিত বিশ্লেষণ। অনেক সময় মূল বক্তব্যকে রূপকের মোড়কে আবদ্ধ রাখা হয়। শিক্ষার্থীদের সেই আবরণ উন্মোচন করে ভাবের বিস্তার ঘটাতে হবে।
ভাবসম্প্রসারণ করার নিয়মাবলি–
☞উদ্ধৃত গদ্যাংশ বা পদ্যাংশটি ভালো করে পড়ে তার মূল ভাবটিকে বুঝে নিতে হবে।
☞প্রথমে দু’একটি বাক্যে গদ্যাংশ বা পদ্যাংশটির সাধারণ অর্থ লিখে নিতে হবে। তারপর মূল ☞ভাবটি ধরে বিশ্লেষণ করতে হবে।
☞প্রদত্ত উদ্ধৃতির প্রসঙ্গ বা কবি-লেখকের নাম উল্লেখের প্রয়োজন নেই।
☞সাধু বা চলিত রীতির যে কোনো একটিকে বেছে নিতে হবে।
☞কোনো কবি বা সাহিত্যিকের উদ্ধৃতি প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা যেতে পারে।
☞মূল বক্তব্য থেকে সরে গিয়ে অপ্রাসঙ্গিক আলোচনা চলবে না।
☞রসবোধ ও সাহিত্যবোধ সম্পর্কে সচেতন হতে হবে।
নীচে কিছু ভাবসম্প্রসারণের দৃষ্টান্ত দেওয়া হল।
‘শুনহ মানুষ ভাই
সবার উপরে মানুষ সত্য
তাহার উপরে নাই।’
‘মান‘ আর ‘হুঁশ‘—এই নিয়ে মানুষ। আর তা না হলে সে পশু। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা বলেছেন – ‘Man is a social animal.’ গোরু, ছাগল, কুকুর, বিড়াল, বাঘ, সিংহ এরাও তো animal”। তাহলে এদের সঙ্গে মানুষের পার্থক্য কোথায়? – কী কারণেই বা মানুষ সবার ওপরে উঠে গেল? এই প্রশ্নের একটাই উত্তর-সাধনার দ্বারা। কীসের সাধনা? জীবনের সাধনা। জীবনের সাধনা কী? পশুত্বকে মানবত্বে, মানবত্বকে দেবত্বে উত্তীর্ণ করা। মানুষ সেটা পেরেছে, বাঘ-সিংহরা পারেনি। পারেনি বলেই তারা আজও অরণ্যে, আর পেরেছে বলেই মানুষ আজ সভ্যতার উঁচু মিনারে। এখনও কিছু কিছু মানুষ আছে, যারা পশুত্বকে বর্জন করতে পারেনি। তাদের কাছে জীবন মানে নিজে খাও, নিজে বাঁচো। অন্য মানুষ অনাহারে থাক, তাতে তাদের কী! আপনি বাঁচলে বাপের নাম। সারা পৃথিবীর মানুষ যদি এই রকম হত, তাহলে পশুদের মতো আমাদের বাসভূমি হত অরণ্য। ভাগ্য ভালো সব মানুষ তা করে না। মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব স্বার্থপরতায় নয়-পরার্থপরতায়। পরের কারণে স্বার্থ দিয়েই মানুষ মনুষ্যত্বের সিড়ি বেয়ে ‘সবার উপরে উঠে গেছে। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন-‘পৃথিবীতে যখন জন্মেছ, তখন একটা দাগ রেখে যাও।’ এই দাগ মনুষ্যত্বের দাগ, মান আর হুঁশের দাগ। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথও বলেছেন– ‘আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়া, বুকের মাঝে বিশ্বলোকের পাবি সারা।’ কবির এই আহ্বানই মানবতীর্থে উত্তীর্ণ হবার আমাদের একমাত্র পথ।
‘পুষ্প আপনার জন্য ফুটে না; তোমার হৃদয় কুসুমকে পরের জন্য প্রস্ফুটিত করিও।’
ফুলকে যদি কেউ জিজ্ঞাসা করে, ‘তুমি ফুটেছ কেন?’ মানুষের মতো কথা বলতে পারলে সে নিশ্চিত উত্তর দিত, তোমার জন্য। সত্যিই তো, কত মনোহর রূপে প্রস্ফুটিত হয়ে ফুল অপরকে সুগন্ধ বিতরণ করে নীরবে ঝরে যায়। প্রতিদানে কিছু চায় না। মানুষের হৃদয়-কোরকের মধ্যেও লুকিয়ে আছে প্রতিভা-কুসুম। তা প্রস্ফুটিত হলে বিশ্বলোকে ছড়িয়ে পড়বে সুবাস। আসলে হৃদয়ের ব্যাপ্তির নামই প্রতিভার বিকাশ। আকাশ অত বিশাল বলেই তা থেকে নির্মল বারিধারা ঝরে পড়ে। লোকে আকাশের মতো করতে পারলে তা থেকে ভালোবাসা ঝরবে। জীবনের পিলসুজে প্রাণের প্রদীপকে জ্বালাতে না পারলে মানুষ হিসাবে বাঁচার সার্থকতা কোথায় ? পরের জন্য আত্মবিসর্জন ভিন্ন পৃথিবীতে স্থায়ী সুখের অন্য কোনো ঠিকানা নেই। বহু মহাত্মা তাঁদের অমূল্য জীবনকে দেশ ও দশের জন্য উৎসর্গ করে অমরত্ব লাভ করেছেন। মানুষ পৃথিবীতে আসে সামাজিক ঋণ পরিশোধের জন্য। আর্তের সেবা, বিপন্নের পাশে দাঁড়ানো, অন্নহীনের মুখে অন্ন তুলে দেওয়া, অন্ধজনে আলো দেওয়া – এই সব কাজই তো সামাজিক ঋণ পরিশোধের উপায়। যাবতীয় সামাজিক পঙ্কিলতার ঊর্ধ্বে হৃদয়ের শতদলকে প্রস্ফুটিত করতে পারলেই মানুষ হিসাবে জন্মগ্রহণ করার সার্থকতা।
‘যারে তুমি নীচে ফেল সে তোমারে বাঁধিবে যে নীচে,
পশ্চাতে রেখেছ যারে সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে।’
অগ্রগতির রথ সকলকে নিয়েই সচল। আর তা না হলে সমাজ, রাষ্ট্র তথা সভ্যতার পশ্চাদ্গামিতা। কিন্তু মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ অর্থ ও বর্ণকৌলীন্যে নিজেদের সমাজের দণ্ডমুণ্ডের মালিক ভাবে। তারা ভাবে, প্রগতির রথের রশিতে হাত দেওয়া কেবল তাদেরই অধিকার। অন্য সকলে অপাক্তেয়, অস্পৃশ্য। পৃথিবীর সমাজবিপ্লবের ইতিহাস কিন্তু অন্য কথা বলে। অন্য কথা বলেছেন আমাদের প্রিয় কবি নজরুলও—‘ইহাদেরি পথে নিতে হবে সাথে, দিতে হবে অধিকার।’ দরিদ্র বলে, শূদ্র বলে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে দূরে সরিয়ে রাখার প্রয়াস দেখা যায় আমাদের সমাজে। আসলে তারাই তো সভ্যতার পিলসুজ। তারাই তো সেই ‘বাতিওয়ালা‘, অন্যের ঘরে আলো পৌঁছে দিয়ে নিজেরা থাকে অন্ধকারে। রাষ্ট্রশক্তির মূল আধারই হল শ্রমজীবী মেহনতি মানুষ। তারাই তো আমাদের সুখদুঃখের দিবসরজনিকে মন্দ্রিত করে তোলে। তাদের ঘৃণা করে দূরে সরিয়ে দেওয়া মানেই তো প্রগতির রথকে থামিয়ে দেওয়া। বঞ্চিত বুকের সঞ্চিত ব্যথাই একদিন বিদ্রোহের বারুদ হয়ে জ্বলে ওঠে। সুতরাং দরিদ্র-নীচ-অবহেলিত বলে যাদের পিছনে ফেলে রাখা হয়, তারাই উলটো দিকে টেনে ধরে প্রগতির রথকে। বর্ণ, অর্থ, শিক্ষা ইত্যাদির গর্বে যারা অন্ধ, তাদের বেরিয়ে আসতে হবে সমানাধিকার প্রতিষ্ঠার মুক্ত অঙ্গনে। ‘সকলের সাথে ভাগ করে খেতে হবে অন্নপান,’ আর অন্যের অপমানকে নিজের অপমান মনে করে হতে হবে সকলের সমান। তবেই একদিন আমাদের এই দুর্ভাগা দেশে যাবতীয় পঙ্কিলতার ঊর্ধ্বে ফুটে উঠবে মানবতার শতদল।
Click on the link below for more collections of ভাবসম্প্রসারণ | Vab Somprosaron in Bengali Grammar.
Also Read : ভাবসম্প্রসারণ-Vab Somprosaron in Bengali
Also Read : ভাবসম্প্রসারণ-Bhabsomprosaron
‘অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে,
তব ঘৃণা যেন তারে তৃণসম দহে।’
ন্যায় লঙ্ঘন করাকেই অন্যায় বলে। কী সেই ন্যায়, কী ভাবে তাকে লঙ্ঘন করা? আদিম অরণ্যের গুহাকে পিছনে ফেলে মানুষ যেদিন সভ্যতার আলোয় এসেছিল, সেদিন সামাজিক কল্যাণকে সামনে রেখে সে কিছু বিধি-বিধান তৈরি করেছিল। অলিখিত হলেও সেই বিধি-বিধানই মানুষের আলোর পথের ঠিকানা। যে কোনো কারণে তা লঙ্ঘিত হলে অন্যায় বলে প্রতিপন্ন হয়। যে লঙ্ঘন করে সে অন্যায়কারী। সামাজিক নিয়মে দোষী। যে অন্যায়কারীকে সমর্থন করে অথবা অন্যায় করতে দেখেও প্রতিবাদহীন থাকে, সেও সমদোষী। তার কারণ, অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়ার অর্থ পাপকে বিস্তারিত হবার সুযোগ করে দেওয়া। মানুষই ভুল করে, আবার মানুষ সেই ভুলগুলোকে ফুল রূপে ফুটিয়ে তোলে আত্মচেতনার আলোকে। কিন্তু ইচ্ছাকৃত
ভুল, স্বার্থের লোভে সমাজনীতিকে বুড়ো আঙুল দেখানো ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। কিছু দুর্বলচেতা মানুষ চোখের সামনে অন্যায় দেখেও নীরব থাকে, প্রতিবাদ করে না। তখন অন্যায়কারীর মতো অন্যায়সহ্যকারীও সমঅপরাধী, সমশাস্তিযোগ্য। তারা যেমন মানুষের ঘৃণার পাত্র, তেমনি ঈশ্বরের কাছেও পাপী। ভালোবাসা নয়, ঈশ্বরের ঘৃণার আগুনে তারা শুষ্ক তৃণের মতো দাহ্যবস্তু। সামাজিক কল্যাণের স্বার্থে প্রত্যেক মানুষের কর্তব্য হল অন্যায় প্রতিরোধে সর্বশক্তি নিয়োগ করা।
‘ধর্মের নামে মোহ এসে যারে ধরে,
অন্ধ সে জন মারে আর শুধু মরে।’
আফিং খাওয়া পাখি খাঁচা ছেড়ে উড়ে গেলেও আবার খাঁচাতেই ফিরে আসে। তাকে ফিরিয়ে আনে নেশা। সে নেশায় অন্ধ। ধর্মের রূপ ধরে মোহের অক্টোপাস যখন মানুষকে গ্রাস করে, তখন সে আত্মবিস্মৃত হয়, জীবনের অন্ধকার কানাগলিতে হারিয়ে ফেলে পথ। অন্যকে যেমন মারে, তেমনি মরে নিজেও। আসলে ধর্ম হল অনুভূতির স্তর বেয়ে উঠে আসা এক ধরনের শুভবোধ। সেই বোধ ঋদ্ধ করে মন ও মননকে। রবীন্দ্রনাথও বলেছেন, ‘মন্ত্রের আসল উদ্দেশ্য মননে সাহায্য করা।’কিন্তু এক শ্রেণির মানুষ ধর্ম বলতে হিন্দু, মুসলমান ইত্যাদিকেই বোঝে। সংস্কৃত ‘ধৃ’ ধাতু থেকে ধর্ম শব্দের উৎপত্তি, যার অর্থ ধারণ করা। প্রত্যেক বস্তুর একটি ধর্ম আছে। যেমন আগুনের ধর্ম তার দাহিকা শক্তি, জলের ধর্ম সমোচ্চশীলতা, সূর্যের ধর্ম আলো ও উত্তাপ দেওয়া, তেমনি মানুষের ধর্ম মানবতা। সেটা না থাকলে মানুষ আর পশুতে কোনো পার্থক্য নেই। ধর্ম বলতে যারা ঈশ্বর প্রাপ্তির নির্দিষ্ট একটা পথকে বোঝে, তারা আসলে ভ্রান্তপথের পথিক। বিশেষ এক সাম্প্রদায়িক গণ্ডিতে তারা আবদ্ধ। অন্য সম্প্রদায়ের মানুষকে তারা শত্রু ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারে না। তাই ধর্ম নিয়ে যখন বিরোধ বাধে তখন মানুষের রক্তে লাল হয়ে ওঠে দেবতার বেদি। মোহগ্রস্ত মানুষ বোঝে না, এতে ঈশ্বরই অপমানিত হন। ‘মানুষের ধর্ম মানবতা’–এই কথাটি সত্যরূপে প্রতিষ্ঠিত হলে পৃথিবী থেকে সাম্প্রদায়িকতার বিষবৃক্ষটি সমূলে বিনষ্ট হবে। তখন আমাদের এই ধূলিমলিন মাটির পৃথিবীতেই নেমে আসবে স্বর্গ।
‘কে লইবে মোর কার্য?’ কহে সন্ধ্যা রবি,
শুনিয়া জগৎ রহে নিরুত্তর ছবি।
মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল, ‘স্বামী,
আমার যেটুকু সাধ্য করিব তা আমি।’
অস্তমিত সূর্য জগতের কাছে রেখে যায় এক অমোঘ প্রশ্ন। দিবাবসানে কে নেবে আলো দেওয়ার কাজ। বিপুল বিস্তারিত ক্ষেত্রে আলো দানের আহ্বানে সবাই নিরুত্তর থাকে। শুধু একটা মাটির প্রদীপ এগিয়ে আসে তার সীমাবদ্ধ ক্ষমতা নিয়ে। গভীর আত্মবিশ্বাস আর অপরিমেয় সাহসকে সম্বল করে নৈশ অন্ধকার দূরীকরণে সে হয় অঙ্গীকারবদ্ধ। আমাদের এই মানব সংসারেও যুগে যুগে ঘনিয়ে আসে দুর্যোগের অন্ধকার। মানবাত্মার কাতর ক্রন্দনে কম্পিত হয় আকাশ-বাতাস। ঠিক তখনই মাটির প্রদীপের মতো আবির্ভূত হন অবতারকল্প মহাপুরুষেরা। সমাজের নীরন্ধ্র অন্ধকারে তাঁরা জ্বলে ওঠেন অনির্বাণ দীপশিখার মতো। নিজেদের জীবনকে তিলে তিলে দান করে সমাজ-সংসারকে তিলোত্তমায় পরিণত করেন। তাঁদের বিদায়ে পৃথিবীতে আবার নেমে আসে হতাশার অন্ধকার। সৃষ্টি হয় সীমাহীন শূন্যতা। তাই বলে মানুষকে দিশাহীন হলে চলবে না। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বারিবিন্দু নিয়েই তো অতল সাগরের সৃষ্টি। মানুষকেও এগিয়ে আসতে হবে সীমিত ক্ষমতা নিয়ে। ক্ষুদ্র মাটির প্রদীপ সূর্যের মতো বিপুল বিস্তারিত ক্ষেত্রে আলো দিতে অক্ষম। কিন্তু লক্ষ লক্ষ প্রদীপ স্বীয় শক্তিতে জ্বলে উঠলে কিছুটা স্থান তো আলোকিত হয়। ক্ষুদ্র সামর্থ্য নিয়ে প্রত্যেক মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে সমাজ কল্যাণের কাজে। হতে হবে সাহসী ও আত্মপ্রত্যয়ী। হীনমন্যতা ও দুর্বলতা দূরে সরিয়ে নাম লেখাতে হবে শপথের কোলাহলে। তবেই বিপন্নতার অন্ধকারে ফুটে উঠবে জীবনের সূর্যমুখী।
‘স্বার্থমগ্ন যেজন বিমুখ
বৃহৎ জগৎ হতে, সে কখনো শেখেনি বাঁচিতে।’
জীবন তো নদী। হেসে খলখল গেয়ে কলকল তালে তালে তালি দিয়ে মৃত্যু-সাগরের দিকে এগিয়ে যাওয়াই তার ধর্ম। নারী রেখে যায় পলি, তাতেই চরাচর হয়ে ওঠে ‘সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা।’ মানুষ রেখে যায় আদর্শ। সেই আদর্শের ওপরে গড়ে ওঠে আলোকিত সমাজ। জীবন মানে তো আত্মকেন্দ্রিক বলয়ে সীমাবদ্ধ থাকা নয়। পরের কারণে স্বার্থ বিলিয়ে দিয়ে প্রমাণ করতে হবে, ‘সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে আমরা পরের তরে।’ রবীন্দ্রনাথও বলেছেন, ‘তামার এই দেহখানা তুলে ধরো, তোমার ওই দেবালয়ের প্রদীপ করো। জীবনকে মোমবাতির মতো নিঃশেষ করে দিতে পারলেই সার্থক মানবজন্ম। ক্ষত ভালো হয়, কিন্তু দাগ মোছে না। মানুষ চলে যায়, কিন্তু আদর্শ বেঁচে থাকে। মৃত্যুর পরও মানুষ জগতে বেঁচে থাকে সেই অমলিন আদর্শকে সম্বল করে। আর যারা জগৎটাকে আত্মসুখের ক্ষেত্র মনে করে, তারা মৃত্যুর পর অচিরেই চলে যায় বিস্মৃতির অন্তরালে। মধুকবি মাইকেলের মতে— সেই ধন্য নরকুলে, লোকে যারে নাহি ভূলে‘। নরকুলে ধন্য হতে হলে জীবনকে মোমবাতি করতে হবে। স্বার্থের গণ্ডি থেকে বেরিয়ে প্রজাপতির মতো ডানা মেলতে হবে মানবর্তীর্থে। নিজেকে নিয়ে বিরত থাকতে মানুষের জন্ম হয়নি। ‘আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়াতে পারলেই তো বুকের মাঝে বিশ্বলোকের সাড়া পাওয়া যায়। আর তখনই সার্থক হয় মনুষ্যজন্ম, সার্থক হয় উপনিষদের সেই বাণী— শৃণ্বন্তু বিশ্বে অমৃতস্য পুত্রাঃ।’
‘ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়
পূর্ণিমা-চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি।’
আমাদের চেতনার গভীরে ‘মন‘ নামে একটি গাছ আছে। সেখানেও মুকুলিত হতে চায় ভাবের কুসুম। উপযুক্ত পরিবেশে সে গাছেও ভাবের ফুল ফোটে থোকায় থোকায়। আর যদি হৃদয়ের দহনবহ্নি জ্বলে ওঠে দাবানল হয়ে, তবে অকালেই ঝরে যায় কল্পনার পাপড়ি। ভাবুক মানুষের কাছে পূর্ণিমার চাঁদ সৌন্দর্যের আকর। তার স্নিগ্ধ কিরণছটায় রঞ্জিত হয় চেতনা। তখনই পান্না হয় সবুজ, চুনি হয়ে ওঠে রাঙা— গোলাপের দিকে চেয়ে মনে হয় সুন্দর সে। আসলে সমাজ ও রাষ্ট্রের পরিবেশ যদি হয় ‘শান্তির নীড়‘, তবে মানুষের কল্পনার বৃত্তে ফুটে ওঠে কাব্য-কুসুম। রসসিক্ত না হলে বাক্য কখনও কাব্য হয় না। দয়াহীন, রুক্ষ সমাজ কঠোর কঠিন গদ্যের জন্ম দেয়। কবিতা হল ভাবের মুকুল। হৃদয়ের ক্ষুধাবহ্নি সেই ভাবের মুকুলকে দগ্ধ করে। তখন দহন আর দাহ থেকে তৈরি হয় কঠিন কঠোর গদ্য। চির সৌন্দর্যের আকর পূর্ণিমার চাদকে মনে হয় ক্ষুন্নিবৃত্তির একটুকরো পোড়া রুটি। রাষ্ট্রীয় সংকট, দুর্ভিক্ষ, মহামারি মানুষের মনকে নির্বাসিত করে এক তপ্ত বালুকাময় মরুপ্রান্তরে। এখানে মানুষের একমাত্র আর্তি, ‘অন্ন চাই, প্রাণ চাই’। সৃষ্টির কিশলয় এখানে পরিণত হয় কাঁটায়। জীবন ঝুলে থাকে কার্নিশে বেড়ে ওঠা বিবর্ণ বটগাছের মতো। আকাঙ্ক্ষার শিকড় নেমে যায় কংক্রিটের গভীরে একবিন্দু জলের প্রত্যাশায়। সৌন্দর্যময় পৃথিবীকে তখন মনে হয় ‘কিনু গোয়ালার গলি‘। আর মানুষ তখন নিজেকে ভাবে হরিপদ কেরানি।
‘চান ভগবান প্রেম দিয়ে তাঁর গড়া হবে দেবালয়,
মানুষ আকাশে উঁচু করে তোলে ইট পাথরের জয়।’
মানুষের ধর্মবোধ একটি আদিম সংস্কার। সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকেই সে খুঁজতে শুরু করেছে ঈশ্বরকে রণে, বনে, জলে, জঙ্গলে। তৈরি করেছে ইট-পাথর দিয়ে গগনচুম্বী দেবালয়, ভেবেছে রত্নখচিত বেদিতে ঈশ্বর আপনিই এসে বসবেন। কিন্তু ঈশ্বর তো তা চাননি। তিনি চেয়েছেন তাঁর মন্দির তৈরি হোক প্রেম-ভক্তি দিয়ে। সেই মন্দিরের ভিত্তি হবে সত্য, শান্তি, দয়া, প্রেম। কিন্তু মানুষ ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী হয়ে ভগবানকে বন্দি করতে চেয়েছে চার দেওয়ালের গণ্ডিতে। সৃষ্টির মাঝেই স্রষ্টার প্রকাশ। বিশ্বস্রষ্টা কখনও মন্দিরের ক্ষুদ্র প্রকোষ্ঠে অবস্থান করেন না। নিখিল বিশ্বের প্রতিটি সৃষ্টির মাঝেই তাঁর অস্তিত্ব।
ভগবান নিজেও বলেছেন–
‘পথের প্রান্তে আমার তীর্থ নয়,
পথের দু’ধারে আছে মোর দেবালয়।’
ইট-পাথরে তৈরি পাষাণ চত্বরে নয়, ঈশ্বর থাকেন ‘সবার পিছে, সবার নীচে, সব হারাদের মাঝে। যারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ভূমি কর্ষণ করে ফলাচ্ছে সোনার ফসল, পাথর ভেঙে তৈরি করছে পথ—ঈশ্বর আছেন তাদের সাথে। তারও দু’হাতে লেগেছে ধুলো। মাটিমাখা ঈশ্বর তো কখনও স্বর্ণমন্দিরের রত্নবেদিতে থাকতে পারেন না। তাঁর মন্দির ধুলামন্দির‘। কর্মযোগে তাঁর সঙ্গে এক হতে পারলেই মানুষের ঈশ্বর প্রাপ্তি। তা না হলে ইট-পাথরের দেবালয় মানুষের শূন্যগর্ভ আস্ফালন আর মূঢ়তার প্রতীক হয়ে চিরদিন তাকে ভ্রান্তপথে ঘুরিয়ে মারবে।
‘কেন পান্থ ক্ষান্ত হও হেরি দীর্ঘপথ
উদ্যম বিহনে কার পুরে মনোরথ?’
জীবন তো রণক্ষেত্রে। এখানে কেউ ঘুমিয়ে কাটাতে আসেনি। প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করেই সকলকে বেঁচে থাকতে হয়। বিজ্ঞানীরাও স্বীকার করেছেন, পৃথিবীতে যোগ্যতমেরই জয় হয়। যোগ্যতম হতে গেলে মানুষকে উদ্যমী ও পরিশ্রমী হতে হবে। শ্রমবিমুখ মানুষের এই পৃথিবীতে কোনো স্থান নেই। কথায় আছে, ‘যে শুইয়া থাকে তাহার ভাগ্যও শুইয়া থাকে।’ বাস্তবিকই, প্রবল পরাক্রমশালী সিংহকেও শিকার খুঁজে নিতে হয়। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথও একসময় ভেবেছিলেন জীবন বোধ হয় আরামের শয্যাতল, সুখবিলাসের অমরাবতী। কিন্তু আত্মচেতনায় বলীয়ান হয়ে তিনি এক সময় উপলব্ধি করলেন—এ জগৎ স্বপ্ন নয়।’ তাই ঈশ্বরের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে বললেন–
‘তোমার কাছে আরাম চেয়ে পেলেম শুধু লজ্জা,
এবার সকল অঙ্গ ছেয়ে পরাও রণসজ্জা।’
সত্যিই তো, জীবন যদি যুদ্ধক্ষেত্র হয়, তবে রণসাজ তো পরতেই হবে। না হলে পরাজয় অবশ্যম্ভাবী। কিছু মানুষ এই সত্য-উপলব্ধি করতে না পেরে কর্মভারকে অসহ্য মনে করে হতাশার অন্ধকারে নিমজ্জিত করে নিজেকে। আর তখনই তার জীবনে নেমে আসে চূড়ান্ত পরাজয়। কর্মোদ্যম, সাহস, আত্মপ্রত্যয় এবং লক্ষ্যে পৌঁছানোর ইস্পাত-কঠিন মনোবল নিয়ে এগিয়ে যেতে পারলেই সাফল্যের বিজয়মুকুট আপনা থেকেই শোভা পাবে মস্তকে।
‘যত বড়ো হোক ইন্দ্ৰধনু সে সুদুর আকাশে আঁকা,
আমি ভালোবাসি মোর ধরণীর প্রজাপতিটির পাখা।
সূত্র: সুদুরের আকর্ষণ অমোঘ। কিন্তু অপ্রাপ্তিতে হতাশা দেখা দেয়। দেখার চোখ থাকলে হাতের কাছেই সুন্দরের অঢেল প্রাপ্তি।
‘রাত্রে যদি সূর্যশোকে ঝরে অশ্রুধারা
সূর্য নাহি ফেরে, শুধু ব্যর্থ হয় তারা।’
সূত্র: যে জিনিস নেই, যাকে পাওয়া যাবে না, তার জন্য কেঁদে অযথা সময় নষ্ট করার অর্থ জীবনে ব্যর্থতা ডেকে আনা।
‘দ্বার বন্ধ করে দিয়ে ভ্রমটারে রুখি।
সত্য বলে আমি তবে কোথা দিয়ে ঢুকি?’
সূত্র: ভুল–ভ্রান্তির মধ্যে দিয়েই তো সত্যকে লাভ করতে হবে। জীবনের সব দ্বার রুদ্ধ করে দিয়ে ভ্রান্তিকে ঠেকাতে গেলে সত্য লাভ করা যায় না।
‘চোর দোষী বটে; কিন্তু কৃপণ ধনী তদপেক্ষা শতগুণে দোষী।‘
সূত্র: সামাজিক ন্যায়–নীতির বিচারে চোর দোষী। কিন্তু যাবতীয় ধনসম্পত্তি কুক্ষীগত করে যারা অঢেল সম্পত্তির মালিক, তারাই চোর অপেক্ষা বহুগুণে দোষী।
‘জীবনের মূল্য আয়ুতে নয়, কল্যাণপুত কর্মে।’
সূত্র: পরামায়ুর ব্যাপ্তিতে জীবনের মূল্য নিরূপিত হয় না। মানুষের কল্যাণের জন্য জীবন উৎসর্গ করতে পারলে মৃত্যুর পরও বেঁচে থাকা যায় ৷
‘মেঘ দেখে কেউ করিস নে ভয়
আড়ালে তার সূর্য হাসে।’
সূত্র: কাজ করতে গেলে বাধা–বিপত্তি আসবেই। তাকে অতিক্রম করতে পারলেই লক্ষ্যে পৌঁছানো সহজ হবে।
‘চন্দ্র কহে, বিশ্বে আলো দিয়েছি ছড়ায়ে,
কলঙ্ক যা আছে, তাহা আছে মোর গায়ে।’
সূত্র: মহৎ চরিত্রে নিম্নার দাগ লাগে না। নিন্দার গরল পান করেই তারা নীলকণ্ঠের মতো মানবকল্যাণে আত্মনিয়োগ করেন।
‘যারা শুধু মরে কিন্তু নাহি দেয় প্রাণ
কেহ কভু তাহাদের করেনি সম্মান।‘
সূত্র: মরা আর প্রাণ দেওয়া এক জিনিস নয়। দেশ ও দশের কল্যাণে জীবন উৎসর্গ করার নামই প্রাণদান। আর তাতেই মানুষ অমরত্বের অধিকারী হয়।
‘এ জগতে হায় সেই বেশি চায় আছে যার ভুরি ভুরি,
রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি।‘
সূত্র: মানুষের চাওয়া–পাওয়ার শেষ নেই। ধনী চায় আরও ধনী হতে। এই বাসনা থেকেই সে আরও ধন অপহরণে প্রবৃত্ত হয়।
‘যে নদী হারায়ে স্রোত চলিতে না পারে,
সহস্র শৈবালদাম বাধে আসি তারে।
যে জাতি জীবনহারা অচল অসাড়
পদে পদে বাঁধে তারে জীর্ণ লোকাচার।‘
সূত্র: চলমানতাই জীবনের ধর্ম। গতিহীন জীবনে কুসংস্কার আর অন্ধবিশ্বাস বাসা বাঁধে। জীর্ণ লোকাচারের পাঁকে তার স্থান হয়।
Click on the link below for more collections of ভাবসম্প্রসারণ | Vab Somprosaron in Bengali Grammar.
Also Read : ভাবসম্প্রসারণ-Vab Somprosaron in Bengali
Also Read : ভাবসম্প্রসারণ-Bhabsomprosaron
Vab Somprosaron-bhabsomprosaron-Vab Somprosaron-bhabsomprosaron-Vab Somprosaron-bhabsomprosaronVab Somprosaron-bhabsomprosaron-Vab Somprosaron