
Uttar-aupanibesika-bharata-(1947-1964)
উত্তর ঔপনিবেশিক ভারত (1947-1964)
Uttar-aupanibesika-bharata-(1947-1964)
অতিসংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর
শেখ আবদুল্লা কে ছিলেন?
উত্তর কাশ্মীরের ‘ন্যাশনাল কনফারেন্স‘ দলের নেতা।
হরি সিং কে ছিলেন?
উত্তর কাশ্মীরের রাজা।
হায়দরাবাদ অভিযানে কে ভারতীয় বাহিনীর নেতৃত্ব দেন ?
উত্তর জেনারেল জে. এন. চৌধুরী।
হায়দরাবাদে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অভিযান কী নামে পরিচিত?
উত্তর অপারেশন পোলো ।
গোয়া কাদের উপনিবেশ ছিল ?
উত্তর পোর্তুগিজদের।
কবে স্বাধীন হায়দরাবাদ রাজ্য প্রতিষ্ঠা হয় ?
উত্তর 1724 খ্রিস্টাব্দে।
নেহরু–লিয়াকত চুক্তিটির অপর নাম কী ?
উত্তর দিল্লি চুক্তি।
কত খ্রিস্টাব্দে ভারতীয় স্বাধীনতা আইন পাশ হয় ?
উত্তর 1947 খ্রিস্টাব্দের 18 জুলাই।
হরি সিং কত খ্রিস্টাব্দে ভারতভুক্তির দলিলে স্বাক্ষর করে ভারতে যোগ দেন ?
উত্তর 1947 খ্রিস্টাব্দের 26 অক্টোবর।
ভি.পি. মেনন কে ছিলেন?
উত্তর ভি.পি. মেনন ছিলেন ভারতের স্বরাষ্ট্র দপ্তরের সচিব।
জুনাগড় কত খ্রিস্টাব্দে ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয় ?
উত্তর 1949 খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে।
‘রাজ্য পুনর্গঠন আইন‘ কবে পাশ হয়?
উত্তর 1956 খ্রিস্টাব্দে।
রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন–এর সভাপতি কে ছিলেন?
উত্তর বিচারপতি ফজল আলি৷
বর্তমানে ভারতীয় সংবিধান স্বীকৃত সরকারি ভাষা কয়টি?
উত্তর 22টি।
ভারতের প্রথম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কে ছিলেন?
উত্তর সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল।
কবে, কার নেতৃত্বে দেশীয় রাজ্য দপ্তর গঠিত হয় ?
উত্তর 1947 খ্রিস্টাব্দে সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের নেতৃত্বে।
ভারতের ‘লৌহমানব‘ কাকে বলা হয় ?
উত্তর সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলকে।
স্বাধীন ভারতের প্রথম স্বরাষ্ট্রসচিব কে ছিলেন?
উত্তর ভি. পি. মেনন ।
লিয়াকত আলি কে ছিলেন?
উত্তর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী।
পত্তি শ্রীরামালু কে ছিলেন?
উত্তর পত্তি শ্রীরামালু ছিলেন অন্ধ্রের গান্ধিবাদী নেতা এবং বিখ্যাত স্বাধীনতা সংগ্রামী।
কত খ্রিস্টাব্দে চন্দননগর ফরাসি নিয়ন্ত্রণমুক্ত হয় ?
উত্তর 1954 খ্রিস্টাব্দে।
সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর
দেশীয় রাজ্যগুলির ‘ভারতভুক্তির দলিল‘ বলতে কী বোঝায় ?
উত্তর স্বাধীনতালাভের পরবর্তীকালে বিভিন্ন দেশীয় রাজ্য যে চুক্তিপত্রে স্বাক্ষরের মাধ্যমে ভারতে যোগদান করে তা ‘ভারতভুক্তির দলিল‘ বা ‘ইন্সট্রুমেন্ট অব অ্যাকসেশন‘ নামে পরিচিত
1950 সালে কেন নেহরু–লিয়াকত চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছিল ?
অথবা, কবে এবং কী উদ্দেশ্যে নেহরু–লিয়াকত চুক্তি বা দিল্লি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় ?
উত্তর 1950 খ্রিস্টাব্দে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে নেহরু–লিয়াকত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় যা দিল্লি চুক্তি নামেও পরিচিত। এই চুক্তি স্বাক্ষরের উদ্দেশ্য ছিল ভারত এবং পাকিস্তানের সংখ্যালঘু উদ্বাস্তুদের স্বার্থরক্ষা করা।
কী পরিস্থিতিতে রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন গঠিত হয় ?
অথবা, ‘রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন‘ কবে ও কেন গঠিত হয় ?
উত্তর 1953 খ্রিস্টাব্দের 22 ডিসেম্বর সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ফজল আলির নেতৃত্বে ভাষাভিত্তিক ‘রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন‘ গঠিত হয়। এর উদ্দেশ্য ছিল ভাষাভিত্তিক রাজ্য পুনর্গঠন করা।
কী পরিস্থিতিতে রাজা হরি সিং ভারতভুক্তির দলিলে স্বাক্ষর করেছিলেন ?
উত্তর 1947 সালের 22 অক্টোবর পাকমদতপুষ্ট হানাদার ও সেনাবাহিনী কাশ্মীরে প্রবেশ করে ব্যাপক হত্যা ও লুঠ চালালে রাজা হরি সিং সপরিবারে শ্রীনগর ত্যাগ করেন এবং ভারত সরকারের কাছে সহায়তা চান। এইসময় জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের ভারতে অন্তর্ভুক্ত হওয়া ছাড়া মাউন্টব্যাটেন ও জওহরলাল নেহরু রাজাকে কোনো ধরনের সাহায্য করতে অস্বীকৃতি জানান বাধ্য হয়ে 1947 সালের 26 অক্টোবর হরি সিং কাশ্মীরের ভারতভুক্তির চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন।
পত্তি শ্রীরামালু কে ছিলেন?
উত্তর পত্তি শ্রীরামালু ছিলেন দক্ষিণ ভারতের একজন গান্ধিবাদী নেতা। মাদ্রাজ প্রদেশের তেলুগু ভাষাভাষী অঞ্চল নিয়ে পৃথক রাজ্য গঠনের দাবিতে তিনি 58 দিন অনশন করে 1952 খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন।
সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলকে ভারতের ‘লৌহমানব‘ বলা হয় কেন ?
উত্তর ভারতের স্বাধীনতালাভের পর দেশীয় রাজ্যগুলির ভারতভুক্তির ক্ষেত্রে তিনি অনমনীয় মনোভাব এবং লৌহকঠিন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। তাই সর্দার প্যাটেলকে ভারতের ‘লৌহমানব‘ বলা হয়।
1947 খ্রিস্টাব্দে সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল ভারতের দেশীয় রাজ্যগুলির স্বাধীনতার দাবিকে অগ্রাহ্য করেছিলেন কেন?
উত্তর 1947 খ্রিস্টাব্দে সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল ভারতের দেশীয় রাজ্যগুলির স্বাধীনতার দাবি অগ্রাহ্য করেছিলেন। এক্ষেত্রে তাঁর অভিমত ছিল যে ভারতের দেশীয় রাজ্যগুলির স্বাধীনতার দাবি মেনে নিলে স্বাধীন ভারতের জাতীয় সংহতি, নিরাপত্তা এবং অখণ্ডতা বিঘ্নিত হবে।
রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন কেন গঠিত হয়েছিল?
উত্তর স্বাধীনতার পরে 1953 সালের 22 ডিসেম্বর ভারত সরকার রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন গঠন করে। এটি রাজ্যের সীমানা পুনর্নির্ধারণের বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য গঠিত হয়েছিল। ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠনের দাবির বিষয়টি সমাধানের জন্য এটি গঠিত হয়েছিল।
দেশীয় রাজ্যগুলির ভারতভুক্তির দলিল বলতে কী বোঝায় ?
অথবা, ইন্সট্রুমেন্ট অব অ্যাকসেশন (IOA) কী ?
উত্তর ভারতের দেশীয় রাজ্য দপ্তরের প্রধান সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল দেশীয় রাজ্যগুলিকে ভারতভুক্তির জন্য কয়েকটি শর্তযুক্ত যে চুক্তিপত্র তৈরি করেন তা ‘ভারতভুক্তির দলিল‘ বা ইন্সট্রুমেন্ট অব অ্যাকসেশন‘ নামে পরিচিত। প্রথমত, এই চুক্তিপত্রে স্বাক্ষরকারী দেশীয় রাজারা নিজ রাজ্যকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করতে বাধ্য এবং ভারত সরকারের কাছ থেকে তাঁরা ভাতা, খেতাব ও অন্যান্য সুযোগসুবিধা লাভ করেন। দ্বিতীয়ত, কয়েকটি দেশীয় রাজ্য ব্যতীত অধিকাংশ দেশীয় রাজ্যের রাজারা এই চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন।
কোন ঘটনা, কেন বিশ্ব ইতিহাসে ‘বৃহত্তম গণ পরিযান‘ নামে পরিচিত?
উত্তর 1947 খ্রিস্টাব্দে ধর্মের ভিত্তিতে ভারতবিভাজন, ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টি এবং স্যার সিরিল র্যাডক্লিফের সীমানা কমিশনের রিপোর্টের ভিত্তিতে বঙ্গ ও পাঞ্জাব বিভাজন করা হয়। এভাবে দেশভাগজনিত কারণে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও নির্যাতন, লুঠ ও ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ প্রভৃতি ঘটনায় আতঙ্কিত হয়ে নিরাপত্তার স্বার্থে ভারত ও পাকিস্তানের প্রায় 1 কোটি মানুষ নিজের ভিটেমাটি ছেড়ে উদ্বাস্তুরূপে ভারতে অথবা পাকিস্তানে চলে যায়। এই ঘটনা বিশ্ব ইতিহাসে ‘বৃহত্তম গণ পরিযান‘ বা অভিপ্রয়াণ নামে পরিচিত।
উদ্বাস্তু বলতে কী বোঝায় ?
উত্তর দেশভাগ কথাটির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত কথাটি হলো উদ্বাস্তু। দেশভাগের ফলে নিরাপত্তাজনিত কারণ বা ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বা অন্য কোনো কারণে যখন নাগরিকরা মাতৃভূমি পরিত্যাগ করে অন্য দেশে আশ্রয় নেয়, তখন তারা উদ্বাস্তু নামে পরিচিত হয়। ছিন্নমূল এই মানুষগুলি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জাতিবিদ্বেষের শিকার হয় বা বিভিন্নভাবে অত্যাচারিত হয়।
মাউন্টব্যাটেন প্রস্তাব বা মাউন্টব্যাটেন রোয়েদাদ কী?
উত্তর ভারতের বড়োলাট লর্ড মাউন্টব্যাটেন 1947 খ্রিস্টাব্দের 3 জুন ভারতবিভাগের পরিকল্পনা ঘোষণা করেন। এই ঘোষণা মাউন্টব্যাটেন প্রস্তাব বা মাউন্টব্যাটেন রোয়েদাদ নামে পরিচিত।
‘দেশীয় রাজ্য বলতে কী বোঝো?
উত্তর ভারতবর্ষ স্বাধীনতালাভের আগে ভারতীয় ভূখণ্ডে ব্রিটিশদের প্রত্যক্ষ শাসনের বাইরে প্রায় 565টি স্বায়ত্তশাসিত রাজ্যের অস্তিত্ব ছিল। এগুলি ‘দেশীয় রাজ্য‘ নামে পরিচিত।
ব্রিটিশ ভারতের সর্বাধিক বৃহৎ চারটি দেশীয় রাজ্যের নাম লেখো।
উত্তর ব্রিটিশ ভারতের সর্বাধিক বৃহৎ চারটি দেশীয় রাজ্য ছিল হায়দরাবাদ, মহীশূর, বরোদা ও জম্মু–কাশ্মীর।
লাইন অব কন্ট্রোল বা LOC কী ?
উত্তর 1947 খ্রিস্টাব্দে স্বাধীন ভারত ও পাকিস্তানের আত্মপ্রকাশের পর কাশ্মীরের ওপর অধিকার প্রতিষ্ঠা নিয়ে দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়। শেষপর্যন্ত জাতিপুঞ্জ যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে। জাতিপুঞ্জ নির্ধারিত সীমারেখা লাইন অব কন্ট্রোল বা LOC নামে পরিচিত।
আজাদ কাশ্মীর কী?
উত্তর পাকিস্তান কাশ্মীর আক্রমণ করলে কাশ্মীরের রাজা হরি সিং ও ভারত সরকার অভিযান চালিয়ে কাশ্মীরের দুই–তৃতীয়াংশ মুক্ত করে। পাকিস্তান তার দখলে থাকা কাশ্মীরের বাকি অংশকে ‘আজাদ কাশ্মীর’ নাম দেয়।
দেশভাগের পর ভারতে কারা ‘উদ্বাস্তু বা ‘বাস্তুহারা নামে পরিচিত হয় ?
উত্তর 1947 খ্রিস্টাব্দে দেশভাগের পর যারা সাম্প্রদায়িক কারণে পাকিস্তানে তাদের মাতৃভূমি ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নেয় তারা উদ্বাস্তু বা বাস্তুহারা নামে পরিচিত হয়।
কোন সময়কে ‘পুনর্বাসনের যুগ‘ হিসেবে চিহ্নিত করা হয় ?
উত্তর দেশভাগের পর পাকিস্তানের প্রচুর সংখ্যালঘু মানুষ ভারতে আশ্রয় নেয়। ভারত সরকার প্রথম পাঁচ বছর যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে এই উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করে। এজন্য 1947 খ্রিস্টাব্দ থেকে 1952 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কালকে ‘পুনর্বাসনের যুগ‘ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
‘রাজাকার‘ কারা ?
উত্তর কাশিম রিজভি নামে একজন উগ্র সাম্প্রদায়িক ব্যক্তির প্রভাবাধীনে হায়দরাবাদের নিজাম একটি উগ্র সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাবাহিনী গড়ে তুলেছিলেন। এই বাহিনী ‘রাজাকার‘ নামে পরিচিত ছিল।
কে, কবে ‘দেশীয় রাজ্য দপ্তর‘ স্থাপন করেন? এর সেক্রেটারি কে ছিলেন?
উত্তর সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল 1947 খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে ‘দেশীয় রাজ্য দপ্তর‘ প্রতিষ্ঠা করেন। দেশীয় রাজ্য দপ্তরের সেক্রেটারি বা সচিব ছিলেন ভি. পি. মেনন ।
রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন–এর সদস্য কারা ছিলেন?
উত্তর রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন–এর তিনজন সদস্য ছিলেন—ফজল আলি, কে. এম. পানিক্কর ও হৃদয়নাথ কুঞ্জর।
কাশিম রিজভি কে ছিলেন?
উত্তর উগ্র মৌলবাদী মুসলিম সংগঠন ‘মজলিস ইত্তেহাস–উল–মুসলিমিন‘-এর সভাপতি ছিলেন কাশিম রিজভি। রিজভির নেতৃত্বে ‘রাজাকার’ বাহিনী হায়দরাবাদে ব্যাপক অত্যাচার ও সন্ত্রাস সৃষ্টি করে।
হায়দরাবাদ কীভাবে ভারতভুক্ত হয় ?
উত্তর জেনারেল জয়ন্তনাথ চৌধুরীর নেতৃত্বে ভারতীয় সেনাবাহিনী হায়দরাবাদ দখল করে। হায়দরাবাদের নিজাম ওসমান আলি ভারতভুক্তির দলিলে স্বাক্ষর করলে 1950 খ্রিস্টাব্দের 26 জানুয়ারি হায়দরাবাদ আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়
বিশ্লেষণধর্মী প্রশ্নোত্তর
টীকা লেখো— দেশভাগ ও উদ্বাস্তু সমস্যা।
অথবা, দেশবিভাগজনিত (1947) উদ্বাস্তু সমস্যার সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও।
উত্তর
সূচনাঃ প্রায় দুই শতকের পরাধীনতার পর ভারতবর্ষ যখন 1947 সালে ব্রিটিশ সরকারের অধীনতা থেকে বেরিয়ে এসে স্বাধীনতালাভ করে সেইসময় ভারতের সামনে সবচেয়ে বড়ো সমস্যা ছিল উদ্বাস্তু সমস্যা। কারণ সেইসময় পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান থেকে প্রচুর হিন্দু ও শিখ নিজের মাতৃভূমি ছেড়ে ভারতবর্ষে চলে আসে। ফলে বৃহত্তর জনগোষ্ঠী নতুন করে ভারতবর্ষে এক ভয়ংকর সংকট সৃষ্টি করে।
উদ্বাস্তু সমস্যার কারণ: পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সীমান্ত লাগোয়া ভারতবর্ষের দু‘টি রাজ্য বাংলা ও পাঞ্জাবে উদ্বাস্তু জনগণের সমাগম সবথেকে বেশি হওয়ায় এখানে উদ্বাস্তু সমস্যা সর্বাধিক লক্ষ করা যায়। এই সমস্যার প্রধান কারণ ছিল—
দেশভাগঃ 1947 সালে ব্রিটিশ সরকার সুপরিকল্পিতভাবে ভারতবর্ষের ভেতর থেকেই পৃথক পাকিস্তান রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটালে ভারত ও পাকিস্তান নামে দু‘টি পৃথক রাষ্ট্রের জন্ম হয় যা উদ্বাস্তু সমস্যা সৃষ্টি করে।
নিরাপত্তার অভাবঃ দেশভাগের পর সদ্য স্বাধীন হওয়া দু‘টি দেশে নিরাপত্তার অভাবেই শুরু হয় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা যা উদ্বাস্তু সমস্যার অপর একটি কারণ ।
বঙ্গ ও পাঞ্জাববিভাগঃ দেশভাগের সাথে সাথে একদিকে বাংলা অন্যদিকে পাঞ্জাব প্রদেশ দু‘টি ভাগ হয়ে যায়। ফলে অগণিত হিন্দু, শিখ যেমন ভারতবর্ষে চলে আসতে থাকে, মুসলিমরাও তেমনি পাকিস্তানে পাড়ি দেয় যা উদ্বাস্তু সমস্যার সৃষ্টি করে।
মূল্যায়নঃ উপরিউক্ত কারণগুলি ছাড়াও প্রাচীন ধর্ম, সংস্কৃতি, হিন্দু–মুসলিম–শিখ সম্প্রদায়ের ছিন্নমূল জীবনযন্ত্রণা উদ্বাস্তু সমস্যাকে বহুগুণে বৃদ্ধি করেছিল।
দেশীয় রাজ্য হায়দরাবাদ কীভাবে ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল ?
অথবা, হায়দরাবাদ রাজ্যটি কীভাবে ভারতভুক্ত হয়েছিল ?
উত্তর
সূচনাঃ 1947 খ্রিস্টাব্দের 15 আগস্ট ভারতবর্ষ স্বাধীন হবার সময়ে প্রায় সব দেশীয় রাজ্য ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আপসে যোগদান করলেও যে তিনটি দেশীয় রাজ্যের অন্তর্ভুক্তি নিয়ে সাময়িক সমস্যার সৃষ্টি হয়েছিল, তার মধ্যে অন্যতম ছিল হায়দরাবাদ। যদিও ভারতের ‘লৌহমানব’ সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের দৃঢ় হস্তক্ষেপে হায়দরাবাদ ভারতভুক্তির দলিলে স্বাক্ষর করতে বাধ্য হয়।
হায়দরাবাদের নিজামের পরিকল্পনাঃ ভারতবর্ষের স্বাধীনতাকালে হায়দরাবাদের নিজাম ওসমান আলি খান প্রথমাবস্থায় স্বাধীন থাকার পরিকল্পনা করেন। সেসময়ের হায়দরাবাদের 85 শতাংশ প্রজা ছিল হিন্দু যাদের দাবি ছিল ভারতবর্ষের সাথে থাকার।
‘রাজাকার’ বাহিনীর আক্রমণঃ এই 85 শতাংশ হিন্দু হায়দরাবাদের ভারতভুক্তির জন্য আন্দোলন শুরু করলে হায়দরাবাদের নিজামের নেতৃত্বে ‘রাজাকার‘ নামে সশস্ত্র দাঙ্গা বাহিনী চরম অত্যাচার করে হিন্দুদের জীবন দুর্বিষহ করে তোলে।
স্থিতাবস্থা চুক্তিঃ এই পরিস্থিতিতে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বল্লভভাই প্যাটেল 1947 খ্রিস্টাব্দে নিজামের সঙ্গে এক স্থিতাবস্থা চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এতে স্থির হয় নিজাম রাজাকারদের সাহায্য নিয়ে হিন্দুদের ওপর আক্রমণ চালাবেন না।
চুক্তির অবমাননাঃ কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই নিজাম স্থিতাবস্থা চুক্তি অমান্য করেন এবং পাকিস্তানের কাছ থেকে সাহায্য নিয়ে হায়দরাবাদে এক অস্থির পরিস্থিতি সৃষ্টি করেন।
অপারেশন পোলোঃ এইসময় ভারত সরকার কর্তৃক প্রেরিত চরমপত্র নিজাম অমান্য করলে হায়দরাবাদের বিরুদ্ধে ঘোষণা করা হয় ‘অপারেশন পোলো‘। এই ‘অপারেশন পোলো‘ অনুসারে সেনাপ্রধান জয়ন্তনাথ চৌধুরীর নেতৃত্বে ভারতীয় সেনাবাহিনী হায়দরাবাদ দখল করে।
হায়দরাবাদের ভারতে অন্তর্ভুক্তিঃ অবশেষে 1950 খ্রিস্টাব্দের 26 জানুয়ারি সম্পূর্ণ লিখিত আকারে হায়দরাবাদের নিজাম ভারতে অন্তর্ভুক্তির দলিলে স্বাক্ষর করেন। এইসময় এম. কে. ভেলোরির নেতৃত্বে হায়দরাবাদে একটি মন্ত্রীসভা গঠিত হয়।
ভারত সরকার কীভাবে দেশীয় রাজ্যগুলির ভারতভুক্তিজনিত সমস্যার সমাধান করেছিল ?
উত্তর
সূচনাঃ 1947 সালের 15 আগস্ট ভারতবর্ষ স্বাধীনতালাভ করলেও দেশীয় রাজ্যগুলির অস্তিত্ব, তার সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রে কিছু প্রশ্ন থেকে যায়। এইসময় ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল ও স্বরাষ্ট্রসচিব ভি. পি. মেনন–এর উদ্যোগে এই সমস্যা সমাধানে ভারতবর্ষ সচেষ্ট হয়।
সমাধানের পথ
জুনাগড়ের ভারতভুক্তিঃ 1947 সালে জুনাগড়ের নবাব পাকিস্তানে যোগদানের সিদ্ধান্ত নিলে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল–এর নেতৃত্বে ভারতীয় সেনাবাহিনী জুনাগড় দখল করে ভারতীয় ভূখণ্ডের সাথে একে যুক্ত করে।
হায়দরাবাদ–এর ভারতভুক্তিঃ হায়দরাবাদের নিজাম না পাকিস্তানে না ভারতে যোগদান করে নিজের স্বাধীন অস্তিত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করেন। কিন্তু তৎকালীন ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রধান জয়ন্তনাথ চৌধুরীর নেতৃত্বে সৈন্যরা তিনদিন ধরে যুদ্ধ করে 1948 সালে হায়দরাবাদকে ভারতের সঙ্গে যুক্ত করে।
কাশ্মীরের ভারতভুক্তিঃ 1947 খ্রিস্টাব্দের 22 অক্টোবর পাকমদতপুষ্ট হানাদার ও সেনাবাহিনী কাশ্মীরে প্রবেশ করে ব্যাপক হত্যা ও লুঠ চালালে রাজা হরি সিং সপরিবারে শ্রীনগর ত্যাগ করেন এবং ভারত সরকারের কাছে সহায়তা চান। এইসময় জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের ভারতে অন্তর্ভুক্ত হওয়া ছাড়া মাউন্টব্যাটেন ও জওহরলাল নেহরু রাজাকে কোনো ধরনের সাহায্য করতে অস্বীকৃতি জানান। বাধ্য হয়ে 1947 সালের 26 অক্টোবর হরি সিং কাশ্মীরের ভারতভুক্তির চুক্তিতে
স্বাক্ষর করেন।
উপনিবেশসমূহের ভারতভুক্তিঃ তৎকালীন স্বাধীন ভারতের ফরাসি ও পোর্তুগিজ উপনিবেশ যেমন—চন্দননগর, পন্ডিচেরি, মাহে, কারিকল 1954 সালে ভারতভুক্তির চুক্তি স্বাক্ষর করে। অন্যদিকে গোয়া, দমন ও দিও 1961 সালে ভারতভুক্তির দলিলে স্বাক্ষর করে।
মন্তব্যঃ এইভাবে ভারত সরকারের ঐকান্তিক প্রয়াসে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল ও স্বরাষ্ট্রসচিব ভি. পি. মেনন–এর উদ্যোগে ভারতকে যুক্তরাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছিল।
জুনাগড় রাজ্যটি কীভাবে ভারতভুক্ত হয় ?
উত্তর স্বাধীনতালাভের পর ভারতের প্রথম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল দেশীয় রাজ্যগুলিকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে কঠোর মনোভাব গ্রহণ করেন। রাজ্যগুলিতে প্রজাবিদ্রোহের আশঙ্কা সহ অন্যান্য কারণে স্বাধীনতালাভের মাত্র তিন সপ্তাহের মধ্যে অধিকাংশ দেশীয় রাজ্য ভারতভুক্তির দলিলে স্বাক্ষর করে ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়। তবে জুনাগড়, কাশ্মীর, হায়দরাবাদ ভারতে যোগ দিতে অস্বীকার করে।
গুজরাট অঞ্চলে অবস্থিত জুনাগড় রাজ্যের অধিকাংশ বাসিন্দা হিন্দু হলেও এর শাসক ছিলেন মুসলমান। পশ্চিমে আরবসাগর ছাড়া অন্য সবদিকে রাজ্যটি ভারতীয় ভূখণ্ড দিয়ে ঘেরা। তা সত্ত্বেও এই রাজ্যের নবাব তৃতীয় মহম্মদ মোবারক পাকিস্তানে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। পাকিস্তানও এই সিদ্ধান্ত মেনে নিলে রাজ্যের ভিতরেই গণঅসন্তোষ শুরু হয়। নবাব পাকিস্তানে পালিয়ে যান। ভারত ঘোষণা করে জনগণের ইচ্ছার অমর্যাদা না করে তাদের মর্যাদা রক্ষার জন্য গণভোট নেওয়া প্রয়োজন। ইতিমধ্যে জুনাগড়ের সঙ্গে ভারত সমস্ত বাণিজ্য বন্ধ করে দিলে সেখানকার খাদ্য পরিস্থিতির অবনতি হতে শুরু করে। এমতাবস্থায় প্যাটেল জুনাগড়ে সৈন্য পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিলে সেখানকার প্রশাসন ভারত সরকারকে নিয়ন্ত্রণ গ্রহণের অনুরোধ করে। এইসময় ভারত সরকারের উদ্যোগে জুনাগড়ে একটি গণভোট অনুষ্ঠিত হয় (1948 সালের ফেব্রুয়ারি মাসে)। তাতে অধিকাংশ মানুষ ভারতে যোগদানের ইচ্ছাপ্রকাশ করলে জুনাগড় 1949 সালের জানুয়ারি মাসে ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়।
উদ্বাস্তু সমস্যার সমাধানে ভারত সরকার কী কী উদ্যোগ গ্রহণ করে?
অথবা, উদ্বাস্তু পুনর্বাসনে ভারত সরকারের ভূমিকা ও পদক্ষেপগুলি উল্লেখ করো।
অথবা, স্বাধীন ভারত সরকার উদ্বাস্তু সমস্যার সমাধানে কী ধরনের উদ্যোগ নিয়েছিল ?
উত্তর
সূচনাঃ 1947 খ্রিস্টাব্দে ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হলে একদিকে পশ্চিম পাকিস্তান অন্যদিকে পূর্ব পাকিস্তান (পূর্ববঙ্গ) থেকে লক্ষ লক্ষ মানুষ ভারতের সীমান্তবর্তী পাঞ্জাব, পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ও আসাম প্রভৃতি রাজ্যে আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করে। ফলে তৎকালীন সময়ে ভারতের সামনে খুবই বড়ো সমস্যা হয়ে দেখা দেয় উদ্বাস্তু সমস্যা।
আশ্রয়দানঃ পাকিস্তানের দুই অংশ থেকে আগত উদ্বাস্তুদের সামনে প্রধান সমস্যা ছিল নিরাপদ আশ্রয় পাবার চেষ্টা। এইসময় ভারত সরকার বিভিন্ন স্থানে উদ্বাস্তু শিবির প্রতিষ্ঠা করে আপাতত সেখানে উদ্বাস্তুদের বসবাসের ব্যবস্থা করে দেয়।
ত্রাণঃ সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন ত্রাণশিবিরের মাধ্যমে উদ্বাস্তুদের জন্য খাদ্য, পোশাক, পানীয় জল, আলো, ঔষধপত্র প্রভৃতি সরবরাহ করার ব্যবস্থা করা হয়। এ ছাড়া উদ্বাস্তু পরিবারগুলির বালক–বালিকাদের জন্য শিক্ষাদানেরও ব্যবস্থা করা হয়।
পুনর্বাসনঃ ধীরে ধীরে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে উদ্বাস্তু পরিবারগুলিকে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করে তাদের জীবিকানির্বাহের জন্য কিছু আর্থিক সাহায্য করা হয়।
মন্তব্যঃ উপরিউক্ত আলোচনা থেকে বোঝা যায় যে স্বাধীনতার পরক্ষণেই ভারতের সামনে উদ্বাস্তু সমস্যার সঠিক সমাধান ছিল একপ্রকার চ্যালেঞ্জস্বরূপ যা ভারতের তৎকালীন সরকার ধীরে ধীরে সমাধান করতে পেরেছিল।
কী কারণে দেশীয় রাজ্যগুলির ভারতভুক্তির প্রয়োজন ছিল?
অথবা, দেশীয় রাজ্যগুলির ভারতভুক্তির কারণ বিশ্লেষণ করো।
উত্তর
সূচনাঃ ভারতবর্ষ স্বাধীনতালাভের পর যেসকল সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিল তার মধ্যে অন্যতম ছিল দেশীয় রাজ্যগুলির ভারতভুক্তি সংক্রান্ত সমস্যা। বিভিন্ন কারণে এই দেশীয় রাজ্যগুলিকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করা অত্যন্ত প্রয়োজন হয়ে উঠেছিল। যেমন—
নিরাপত্তার সংকটঃ ভারত স্বাধীনতালাভ করলেও ভারতের নিরাপত্তাজনিত কারণে দেশীয় রাজ্যগুলিকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করার প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল।
ঐতিহ্যের সংকটঃ 1947 খ্রিস্টাব্দ নাগাদ স্বাধীন ভারতের ভৌগোলিক মানচিত্র অনুযায়ী দীর্ঘদিন যাবৎ একই ইতিহাস ও ঐতিহ্য বহন করার জন্য দেশীয় রাজ্যের ভারতে অন্তর্ভুক্তির প্রয়োজন ছিল। কারণ তা না হলে ভারতীয় ঐতিহ্যের অবসান ঘটত।
জাতীয়তাবাদঃ ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে ভারতের প্রত্যেক প্রদেশের জনগণ ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে শামিল হয়েছিল। তাই জাতীয় নেতৃবৃন্দ ভারতীয় ভূখণ্ডের অখণ্ডতায় বিশ্বাসী ছিলেন। এ কারণে সমস্ত প্রদেশ ভারতের অন্তর্ভুক্ত করে জাতীয়তাবাদী ভাবধারার প্রকাশ সম্ভব বলে দেশীয় রাজ্যগুলির ভারতে অন্তর্ভুক্তির দরকার ছিল।
প্রজা আন্দোলনঃ স্বাধীনতাকালে ভারতীয় প্রতিটি প্রদেশে প্রজা আন্দোলন শুরু হয় যা দেশীয় রাজ্যগুলির ভারতভুক্তির পথ প্রশস্ত করে।
মূল্যায়নঃ দেশীয় রাজ্যগুলির ভারতে অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে তৎকালীন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে বিস্তর বিতর্ক সৃষ্টি হলেও ভারতের প্রথম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের সুদৃঢ় পদক্ষেপের ফলে এগুলি ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল।
স্বাধীনোত্তর ভারতের প্রধান সমস্যাগুলি সংক্ষেপে বর্ণনা করো।
অথবা, 1947 খ্রিস্টাব্দের পর ভারতের উদ্বাস্তু সমস্যা সম্পর্কে বিশ্লেষণ করো।
অথবা, পূর্ব পাকিস্তান থেকে আগত উদ্বাস্তু সমস্যা কেন তীব্র হয়ে উঠেছিল ?
উত্তর
সূচনাঃ 1947 সালে ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক জারি করা ভারতশাসন আইন অনুসারে ভারতবর্ষ স্বাধীন হবার পাশাপাশি পাকিস্তান নামে এক নতুন স্বাধীন রাষ্ট্রেরও সৃষ্টি হয়েছিল।
স্বাধীনতালগ্ন থেকেই ভারতবর্ষে বেশ কিছু সমস্যা নজরে পড়েছিল যা ছিল নিম্নরূপ—
উদ্বাস্তু সমস্যাঃ স্বাধীন ভারতের প্রাথমিক সমস্যা ছিল উদ্বাস্তু সমস্যা। এইসময় পাকিস্তান থেকে আগত অসংখ্য মানুষ এক চরম উদ্দ্বাস্তু সমস্যার সৃষ্টি করেছিল। আগত মানুষের খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থানের ব্যবস্থা করে দেওয়া ছিল ভারতবর্ষের সামনে অন্যতম প্রধান সমস্যা।
কৃষিসংকটঃ পাকিস্তান রাষ্ট্রের পৃথক্করণের দরুন পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থিত উর্বর কৃষিজমি ভারতের বাইরে চলে যায়। এটা ভারতের কৃষি উৎপাদন যথেষ্ট ব্যাহত করে এবং পূর্ব ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে একপ্রকার খাদ্যাভাব দেখা যায়।
প্রয়োজনীয় কাঁচামালের অভাবঃ পূর্ব ভারতের পাট ও বস্ত্রশিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামালের বেশিরভাগই উৎপন্ন হতো পূর্ববাংলায়। কিন্তু সেই জায়গা পাকিস্তান রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় প্রয়োজনীয় কাঁচামালের অভাব দেখা দেয় ৷
মূল্যায়নঃ উপরিউক্ত সমস্যাগুলি ছাড়াও সদ্য স্বাধীন ভারতবর্ষের সামনে পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টি অন্যতম প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। কারণ এর ফলে হিন্দু–মুসলিম জাতীয় ঐক্য কিছুটা হলেও বিনষ্ট হয় যা তাৎক্ষণিকভাবে ভারতবর্ষের সামনে এক বড়ো সমস্যার সৃষ্টি করে।
পোর্তুগিজ ও ফরাসি উপনিবেশগুলি কীভাবে ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয় ?
উত্তর
সূচনাঃ 1947 খ্রিস্টাব্দে ভারত স্বাধীন হলেও ভারতীয় ভূখণ্ডের বিভিন্ন প্রান্তে পোর্তুগিজ ও ফরাসি উপনিবেশগুলি স্বাধীন অবস্থাতেই রয়ে গিয়েছিল। এই উপনিবেশগুলির জনগণ স্বাধীনতালাভের জন্যে একদিকে যেমন ব্যাকুল হয়ে ওঠে, অন্যদিকে তেমনই স্বাধীন ভারতে যোগদানের ইচ্ছাপ্রকাশ করে। এক্ষেত্রে ফরাসি সরকার তাদের উপনিবেশগুলি ভারতের হাতে তুলে দিলেও পোর্তুগিজরা তা করেনি।
ফরাসি উপনিবেশগুলির সংযুক্তিঃ স্বাধীনতার প্রথম পর্বে ভারতীয় ভূখণ্ডের অন্তর্ভুক্ত মাদ্রাজের পন্ডিচেরি, পশ্চিম উপকূলের মাহে এবং বাংলার চন্দননগর ছিল ফরাসি উপনিবেশ। 1948 খ্রিস্টাব্দে ভারত ও ফ্রান্সের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যার দ্বারা স্থির হয় ফরাসি উপনিবেশগুলি ভারতের সাথে যুক্ত হবে কি না তা স্থির হবে গণভোটের মাধ্যমে।
1948-এর ইঙ্গ–ফরাসি চুক্তিঃ1948-এর চুক্তি অনুসারে গণভোটের মাধ্যমে 1949 খ্রিস্টাব্দে চন্দননগর ভারতের সাথে যুক্ত হয়। 1954 খ্রিস্টাব্দে মাহে, পন্ডিচেরি ও কারিকল ভারতের সাথে যুক্ত হয়।
পোর্তুগিজ উপনিবেশগুলির ভারতভুক্তিঃ স্বাধীন ভারতে প্রথম পর্বে গোয়া, দমন, দিউ, দাদরা–নগর হাভেলি প্রভৃতি ছিল পোর্তুগিজদের উপনিবেশ।
দাদরা–নগর হাভেলি–র ভারতভুক্তিঃ 1954 খ্রিস্টাব্দে এক বিদ্রোহের মাধ্যমে দাদরা–নগর হাভেলির জনগণ স্বাধীন হতে চাইলে পোর্তুগিজরা তা পুনরায় দখল করার চেষ্টা করে। কিন্তু ভারত তাদের বাধা দেয়। 1961 খ্রিস্টাব্দে এগুলি ভারতের কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত হয়।
গোয়া–র ভারতভুক্তিঃ 1947 খ্রিস্টাব্দে গোয়ায় প্রায় 5000 মানুষ ভারতভুক্তির দাবিতে সত্যাগ্রহ শুরু করে। সেখানে পোর্তুগিজ সেনার গুলিতে প্রায় 22 জনের মৃত্যু হয়। অবশেষে ভারতীয় সেনাপ্রধান জয়ন্তনাথ চৌধুরীর নেতৃত্বে 1961 খ্রিস্টাব্দে গোয়ায় সামরিক অভিযান শুরু হয়। গোয়া–র পোর্তুগিজ বাহিনী শীঘ্রই পরাজিত হয়ে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। ফলে গোয়া ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়।
মূল্যায়নঃ উপরিউক্ত আলোচনায় স্পষ্ট, 1947 খ্রিস্টাব্দে ভারত স্বাধীন হলেও ভারতীয় ভূখণ্ডের ফরাসি ও পোর্তুগিজ উপনিবেশগুলি একবারে না হলেও পর্যায়ক্রমে সবক‘টি উপনিবেশই ভারতীয় ভূখণ্ডের মধ্যে যুক্ত হয়েছিল।
নেহরু–লিয়াকত চুক্তির বিষয়বস্তু কী ছিল ?
অথবা, দিল্লি চুক্তির বিবরণ দাও ।
অথবা, নেহরু–লিয়াকত চুক্তিকে কেন্দ্র করে কেন বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছিল ?
উত্তর
সূচনাঃ স্বাধীন ভারতবর্ষের সূচনাপর্বে সমকালীন উদ্বাস্তু সমস্যা সমাধানের জন্য 1950 সালের 17 এপ্রিল ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খানের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যা দিল্লি চুক্তি নামে পরিচিত।
দিল্লি চুক্তির বিষয়বস্তুঃ 1950 খ্রিস্টাব্দে স্বাক্ষরিত দিল্লি চুক্তির শর্তাবলি বা বিষয়বস্তু হলো
ধনসম্পত্তি ফেরতঃ এই চুক্তি অনুসারে স্থির হয়েছিল 1950 খ্রিস্টাব্দের 31 মার্চ পর্যন্ত দেশত্যাগ করে আসাদের মধ্যে যারা নিজ দেশে ফিরে যাবে তাদের স্থাবর সম্পত্তি প্রত্যেককে ফিরিয়ে দেওয়া হবে।
সংখ্যালঘু শ্রেণির নিরাপত্তা সুনিশ্চিতঃ এই চুক্তিতে স্থির হয় পাকিস্তান ও ভারতবর্ষের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষদের নিজ দেশেই নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা হবে, যাতে তাদেরকে নিজ দেশত্যাগ করতে না হয় ।
রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্যঃ 1950 সালের এই চুক্তি অনুসারে স্থির হয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় নিজ রাষ্ট্রের প্রতি অনুগত থাকবে এবং তারা নিজ রাষ্ট্রের কাছেই সমস্যার সমাধান চাইবে।
মূল্যয়নঃ 1950 সালের নেহরু–লিয়াকত চুক্তি অনুসারে সদ্য স্বাধীন ভারতবর্ষ ও পাকিস্তানের মধ্যে সৃষ্টি হওয়া সমস্যাগুলির সমাধানের পথ প্রশস্ত হয়েছিল। তবে চুক্তিটি যথেষ্ট কঠোর না হওয়ায় ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ও ক্ষিতীশচন্দ্র নেহরুর মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করেছিলেন।
দেশীয় রাজ্যগুলির ভারতভুক্তি সম্পর্কে ব্রিটিশ সরকার ও ভারতীয় নেতাদের দৃষ্টিভঙ্গি বিশ্লেষণ করো।
উত্তর
ভূমিকাঃ দেশীয় রাজ্যগুলির ভারতভুক্তি সম্পর্কে ব্রিটিশ সরকার ও ভারতীয় নেতাদের দৃষ্টিভঙ্গি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়—
ব্রিটিশ সরকারের দৃষ্টিভঙ্গিঃ ভারতীয় স্বাধীনতা আইনের একটি ধারায় বলা হয়েছিল দেশীয় রাজ্যগুলির ওপর ব্রিটিশ সার্বভৌমত্বের অবসান হবে এবং এই রাজ্যগুলি নিজেদের পছন্দমতো ভারত বা পাকিস্তান ডোমিনিয়নে যোগদানের অধিকার পাবে অথবা স্বাধীন থাকবে।
এটলির দৃষ্টিভঙ্গিঃ ‘ভারতীয় স্বাধীনতা আইন‘ সংক্রান্ত বিলটি ইংল্যান্ডে আলোচনাকালে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্লিমেন্ট এটলি ঘোষণা করেছিলেন–
প্রথমত, ব্রিটিশ সরকার কোনোভাবেই দেশীয় রাজ্যগুলির অস্তিত্ব মেনে নেবে না।
দ্বিতীয়ত, ভারত ও পাকিস্তান এই দুই রাষ্ট্রের মধ্যে অবস্থিত দেশীয় রাজ্যগুলির স্বাধীন অস্তিত্ব বিপন্ন হওয়া স্বাভাবিক মনে করে তিনি দেশীয় রাজ্যগুলিকে ভারত অথবা পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পরামর্শ দেন।
জাতীয় কংগ্রেসের দৃষ্টিভঙ্গিঃ ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের পক্ষ থেকে স্পষ্টভাবে ঘোষণা করা হয়েছিল, স্বাধীনতার পর ভারতে কোনো দেশীয় রাজ্যের স্বাধীন অস্তিত্ব স্বীকার করা হবে না। মহাত্মা গান্ধি দেশীয় রাজ্যের স্বাধীন থাকার ইচ্ছাকে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার সমতুল্য ঘটনা বলে মতপ্রকাশ করেন।
ভারতের অন্তর্বর্তী সরকারের বক্তব্যঃ ভারতের স্বাধীনতা আইনের অনেক আগে থেকেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সহসভাপতি জওহরলাল নেহরু ঘোষণা করেন, দেশীয় রাজ্যগুলির কাছে দু‘টি বিকল্প রয়েছে : এক তারা ভারতীয় ইউনিয়নে যোগদান করতে পারে, নতুবা তাদের ভারতের কেন্দ্রীয় প্রশাসনের সঙ্গে সংঘর্ষে যেতে হবে।
মূল্যায়নঃ দেশীয় রাজ্যগুলির স্বাধীন অস্তিত্বকে অস্বীকার করে তাদের ভারতভুক্ত করতে ভারত সরকার ‘দেশীয় রাজ্য দপ্তর‘ প্রতিষ্ঠা করে। এই দপ্তরের মন্ত্রী বল্লভভাই প্যাটেলের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে শেষপর্যন্ত দেশীয় রাজ্যগুলি ভারতভুক্ত হয় ।