সাম্প্রতিক বনভোজন
Sampratika banabhojana Rochona Bengali
[ ভুমিকা– বনভোজনের ইতিহাস—সাম্প্রতিক বনভোজনের স্থান– গমন—বিবরণ—অভিজ্ঞতা—উপসংহার ]
ভূমিকাঃ কর্মবহুল জীবনে মানুষের কর্মের শেষ নেই। বিশেষ করে বর্তমান যুগ গতির যুগে বলে মানুষের বিরাম নেই কাজের, বিশ্রাম নেবার নেই অবসর । বিরাম বা ছুটি বা সাময়িক কাজ থেকে অবসর আমাদের দেহ ও মনের স্বাস্থ্যরক্ষার প্রয়োজনে একান্ত দরকার । আমরা ছাত্র। কোন বড় পরীক্ষার আগে বা পরে আমরা তাই ছুটি পাই ৷ গরমের ছুটি সেই সুযোগ আমাদের দেয় । তাছাড়া ছাত্র-ছাত্রী ও শিক্ষক স্কুল থেকে বনভোজনে বেরিয়েছিলাম নতুন উদ্যম আর প্রেরণা লাভের আশায় ৷ সামনে ফাইন্যাল পরীক্ষা । তাই চাই বাড়তি রসদ ।
বনভোজনের ইতিহাসঃ বনভোজন মানে বনে ভোজন নয় । ধরা বাঁধা পরিবেশের গতানুগতিক নিয়মের গণ্ডী পেরিয়ে কোন নতুন স্থানে প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্যে নদীর তীরে কোন গাছের নীচে অবাধ স্বাধীনতাকে মূলধন করে সকলে মিলে রান্নাবান্না করে ভোজন করার নামই বনভোজন। বনভোজনের এক প্রাচীন ইতিহাস আছে। প্রাচীনকালে রাজা মহারাজারা কিছুদিন অন্তর অন্তর লোক– লস্কর, সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে মৃগয়ায় যেতেন এবং সেখানে যাওয়ার মধ্যে দিয়ে যে আনন্দ পেতেন তা তাঁদের রাজকার্য চালানোর একঘেয়েমিতা থেকে মুক্তি দিত। বর্তমান য়ুগের বনভোজন রাজা মহারাজাদের মৃগয়া যাত্রারই নবরূপ বলা যায়।
বনভোজনের স্থানঃ বনভোজনের স্থান নির্বাচন নিয়ে অনেক আলোচনার পর ঠিক হোল ছাত্রদের মত নিয়ে মিল হওয়া খুব কঠিন ব্যাপার। তাই মাস্টার মশাইদের ইচ্ছানুযায়ী স্থির হোল হাওড়া জেলার দক্ষিণে রূপনারায়ণ নদের ধারে পাণিগ্রাস। যেখানে কথা–সাহিত্যিক শরৎচন্দ্রের স্মৃতিবিজড়িত এক দ্বিতল টিনের বাড়ী আছে—তারই কাছাকাছি এক বাগানে । এক ঢিলে দুই পাখী মারার মত— বনভোজন এবং শরৎচন্দ্রের পুণ্য পরশ বিজড়িত ভ্রমণ দুই–ই হবে ৷ যাওয়া হবে নদীপথে নৌকাইয় ।
পাণিত্রাস গমনঃ আমাদের যাত্রাপথ জয়পুর হয়ে খালপথে নৌকাইয় বাক্সীর পুরানো হাটের কাছে রূপনারায়ণ ধরে গন্তব্যস্থানে যাওয়ার ঠিক হয়।দু খানি বড় নৌকা ভাড়া করা হোল। সঙ্গে জনা পনের ছাত্রী, জনা দশেক শিক্ষক মশাই এবং বাকী—২৬৷২৭ জন ছাত্র ৷ আমাদের সব দায়–দায়িত্ব মাস্টার মশাই সুনীলবাবুর উপর ন্যস্ত করা হয়। ছাত্রীরা ও মাস্টারমশাইরা একটা নৌকায় এবং বাকী ছাত্রেরা তাপর একটা নৌকায় । আমাদের যাত্রা শুরু, হোল ঠিক সকাল ৬টায়। ভোরের কুয়াশা তখনো কাটেনি,। দপাশে মাঠ। মাঠের বুক চিরে জলভরা খালের উত্তরে বাতাস পেছনে করে আমাদের নৌকাযুগল দখিন মুখে তরতরিয়ে চলতে লাগল । কুয়াশার ঘোমটা খুলে সর্যদেব যখন মুখ দেখালেন তখন বেলা সওয়া ৯টা। খিদে পেয়েছিল। তাই পাঁউরু টি, কলা, সিদ্ধ ডিম ও দানাদার সহযোগে টিফিন সারা হোল। ছেলেরা কিছু চালভাজা ও নারকেল ছাড়িয়ে এনেছিল । তাদের বাড়তি খাবার অপর নৌকারোহীদেরও ভাগ দিয়েছিল। লাগাম ছাড়া আনন্দে ছেলেরা রবীন্দ্রসংগীত গাইছে, সুকান্ত, নজরুল, রবীন্দ্রনাথের কবিতা আবৃত্তি করছে। বাক্সীর পরানো হাটে পৌঁছানো গেল বেলা ১০টায়। রূপনারায়ণ তখন শান্ত। মেঘলা ভাব কিছটা ছিল। ঘণ্টাখানেক হাটে বেড়িয়ে, বিশ্রাম নিয়ে আবার যাত্রা শত্রু করার সময় দেখা গেল আকস্মিক ঘন কালো মেঘে আকাশ ঢেকে গেল । জোর দখিনা বাতাস আমাদের এগতে বাধা দিল। অকাল বর্ষণেও দেখা গেল । শীতের বৃষ্টি। দঃসহ কনকনে ঠাণ্ডা বাতাস আমাদের আনন্দকে নিঃশেষ করতে চাইলো । মানকুরা ঘাট পর্যন্ত যাবার পর নৌকা নোঙ্গর করা হল । মাঝিরা রণক্লান্ত । আর এগোন তাদের দ্বারা সম্ভব নয়। বৃষ্টি থামলো। দাপটে দক্ষিনা বাতাস বইছে । তাই পাণিন্ত্রাস যাওয়ার মতলব ত্যাগ করে কাছাকাছি ভাল স্থান বাছার চেষ্টা হোল । স্কুলের ছেলে মেয়ে—মাস্টারমশাই দেখে স্থানীয় লোকেরা স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে এগিয়ে এসে জানালো কাছেই মানকুরা ডাক বাংলোয় পিকনিক করার স্থান আছে। সবরকম ব্যবস্থা সেখানে আছে। তাই ঠিক হলো । সবাই হাতাপাতি করে কাঠ, কড়া, বালতি যাবতীয় জিনিসপত্র নিয়ে ডাকবাংলোয় পৌঁছানো গেল ১২টা নাগাদ । সুনীলবাব, রান্নার তোড়জোড় শুরু করলেন।
পাণিন্ত্রাসের বিবরণঃ ছাত্র–ছাত্রীরা পাণিন্ত্রাস যাবেই। তাই লরী ভাড়া নিয়ে, মানকুরা থেকে সদলবলে আবার পাণিগ্রাস যাত্রা। সুনীলবাবু ও ২ জন মাস্টারমশাই ও ঠাকুর চাকর রান্নার তদারকিতে রয়ে গেলন। বেলা একটা নাগাদ পাণিন্ত্রাস পেছিলাম। খুব তাড়াতাড়ি শরৎস্মৃতিসদন দেখে নিয়ে—সেখানের পরিদর্শন বহিতে আমাদের মন্তব্য লিখে রেখে আমরা আবার মানকুরে ফিরলাম। পেটে তখন ক্ষুধার জালা প্রচণ্ড আকার ধারণ করেছে । বেলা দুটোয় ডাকবাংলোয় ফিরে স্নান তার পর গরম মাংসের ঝোল, ভাত, চাটনী সহযোগে সে কি খাওয়া। দেড়া–ডবল খেয়ে ছেলেরা খাওয়ার রেকর্ড করল যেন।
অভিজ্ঞতাঃ খাওয়ার পর দল বেধে নদীর ধার ধরে বেড়ানোর আনন্দই কি কম ? আকাশ তখন পরিষ্কার অস্তগামী, সূর্যে‘র ম্লান–রক্তিম আলো নদী জলে পড়ে লক্ষ চুমকীর রং–এর খেলা দেখালো ।নাম না জানা নদীর তীরে চরাই পাখী তাদের ঘরে ফেরার দৃশ্যে আমাদের ঘরে ফেরার তাগিদ এলো। ক্যাপ্টেন সুনীলবাবু হুশিয়ার দিয়ে জানালেন নৌকায় উঠতে হবে এবার ।
উপসংহারঃ“বন্দর ছাড় যাত্রীরা সব সময় হয়েছে আজি”—এই মন্ত্র সোচ্চারে গেয়ে নৌকা আমাদের ছাড়ল সন্ধ্যা ৬টায় । যাওয়া ও আসার আনন্দের মাঝে খাওয়ার সময়ের সীমাহীন সুখ বলতে অনেক বাকী রয়ে গেল ৷ মনের পর্দায় কথা কতই ভেসে আসছে। সীমায় বাঁধা পরিসর এমনিতে বেশী হোল । তাই এখানেই থামতে হচ্ছে ।