একটি বর্ষণ মুখর রাত্রি
Ekti barsan mukhar ratri
[ ভূমিকা– দুর্যোগের সূচনা পর্ব—দুর্যোগের ঘনঘটা—দুর্যোগের রূপ ও মনের উপর প্রভাব – রূপসী রাত্রির ভয়ংকরী রূপে ও মনের উপর প্রতিক্রিয়া —উপসংহার ]
ভূমিকাঃ “সেদিন চৈত্রমাস।”প্রকৃতি নিজের মধ্যে যেন দেখতে চায় নিজের ভয়ঙ্কর রূপে ; যা আনে সর্বনাশ । তার রূপের মাঝে যে শান্তশ্রী আছে, তা রূপে, রসে, গন্ধে, বর্ণেভরা অপার্থিব আনন্দলোকের বার্তাবাহী । প্রাণের গোপন গভীরে তোলে সুর, “কত বিস্ময় লাগে হেরি তোমারে।” আবার যখন প্রলয়ঙ্কররপে দেখা দেয়, “পিনাকেতে লাগে টঙ্কার”, তখন মনে হয় ভাঙ্গনের খেলায় মেতেছে বুঝি শিল্পী আজ। সেদিন সেই ভাঙ্গনের খেলায় দেখলাম ৷
দুর্যোগের সূচনা পর্বঃ স্কুলের একটা অনুষ্ঠান ছিল। গিয়েছিলাম যোগদান করতে । মাঝে একবার বাইরে এলাম । ঘন কালো মেঘ আস্তে আস্তে আসছে এগিয়ে। বাতাস বন্ধ। রুদ্ধ নিঃশ্বাসে যেন আশে–পাশের গাছগুলো স্তব্ধ হয়ে ভাবছে—কি জানি কি হয়! ভাবলাম বাড়ী চলে যাওয়া উচিৎ। কিন্তু অনুষ্ঠানের শেষপর্বে‘র আকর্ষণে আবার হলে ঢুকলাম। অনেকেই কিন্তু বৃষ্টির ভয়ে তখনই বাড়ীর দিকে রওনা দিল। অল্পক্ষণ পরে অনুষ্ঠান যখন শেষ হলো তখনই সবাই ছুটতে শুরু, করেছে। হাঁটতে লাগলাম। ভাবলাম, ঠিক বাড়ী পৌঁছে যাব। কিন্তু আমার সব নিশ্চিন্তভাব ভেঙ্গে শুরু, হল প্রচণ্ড ঝড়। বাতাসের বেগে রাস্তার ধুলো চোখ অন্ধ করে দিতে চাইলো । বাধ্য হয়ে আশ্রয় নিলাম একটা গাড়ী বারান্দার নিচে।
দুর্যোগের ঘনঘটাঃ শরু হলো বৃষ্টি। অঝোর ধারায় নেমে এলো জলধারা। আকাশকে ফালা ফালা করে দিতে লাগল মেঘসখা বিদ্যুৎ। বজ্রের প্রচণ্ড শব্দে ভয়ে প্রাণ শুকিয়ে গেল । রাস্তায় জল জমতে শুরু করেছে। অটোগুলোর আজ আর পাত্তা নাই। বাস যাত্রীঠাসা। জল ছিটিয়ে, রাস্তায় জলে ঢেউ খেলিয়ে বাসগুলো ছটে চললো। আর অপেক্ষা করা ঠিক হবে না ভেবে হাঁটা শুরু করলাম । রাস্তার জল তখন আমার হাঁটু পেরিয়েছে। বৃষ্টির ফোটাগুলো যেন তীরের মত বিধছে। হঠাৎ সব অন্ধকার–লোডশেডিং। মাঝে মাঝে বিদ্যুতের চমক অন্ধকার আরও বাড়িয়ে তুলছিল। বৃষ্টির বেগ ক্রমশঃ বেড়েই চলেছে। তারই সাথে সমান তালে চলছে দমকা হাওয়া। কোন রকমে জল ভেঙ্গে বাড়ী পৌঁছালাম ।
দুর্যোগের রূপ ও মনের উপর প্রভাবঃ মা প্রচন্ড উদ্বেগ নিয়ে অপেক্ষা করছিল। তাড়াতাড়ি জামা–প্যান্ট পাল্টে খেয়ে নিলাম। তখনও ঝড় বৃষ্টি চলছে। বিরাম–বিহীন। জানালার ধারে দাঁড়ালাম । আমাদের বাড়ী প্রায় গঙ্গার ধারে। মাঝে মালগাড়ীর লাইন, আর লাইনের দুপাশে রাস্তা ।জানালার ধারে তখন খই ভাজার আওয়াজ । দুরে বৃষ্টির জলধারা যেন গঙ্গার জল আর আকাশকে মিশিয়ে দিয়েছে। ঝড়ের দাপটে গাছগুলো পরম্পরকে জড়িয়ে ধরে শক্তভাবে দাঁড়ানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে চলেছে। ঝড়ো বাতাস বন্ধ জানলা দরজায় অক্ষম আক্রোশে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। মনে হল পৃথিবীর বুকে অজস্র অন্যায়ের প্রতিবাদে ভেঙ্গে পড়তে চাইছে উদ্দাম–উল্লাসে। ঝড়ের গোঁ–গোঁ শব্দ প্রকৃতির উদ্দামতার জান্তব শব্দ–প্ৰকাশ ৷
রূপসী রাত্রির ভয়ংকরী রূপ ও মনের উপর প্রতিক্রিয়াঃ দূরে টিনের চালের বাড়ী গুলোর চালগুলো যেন উড়ে যাবে । অজানা আশঙ্কায় আতঙ্কিত প্রাণ আমার । বাইরে‘ নিকষকালো অন্ধকার। নানারকম শব্দ, অন্ধকার, মেঘের গর্জন আর বিদ্যুতের চমক—আমাকে নিয়ে চললো কোন এক অদৃশ্য–লোকের পথে । তারই সাথে মনে হলো, এতো বৃষ্টি নয় হাজার হাজার বছর ধরে জমে থাকা মানুষের দঃখ, ব্যথা, বেদনার অশ্রু, যেন বৃষ্টি হয়ে ঝড়ে পড়ছে ধরার ধূলিতে। আবার মনে হলো কবিগুরুর কথা, “বরিষ ধরার মাঝে শান্তির বারি”। তাহলে একি অশ্রু জলে শোকের তর্পণে! তখনও আলো জ্বলেনি। মোমবাতিও শেষ হয়ে এসেছে। বাড়ির সকলে পড়েছে ঘুমিয়ে। শান্তি এসে হরণ করেছে শ্রান্তিকে। আমি যেন জাগর রক্ষক, অতন্দ্র প্রহরী। এ রাত্রির বুঝি পার নেই; নেই কোন শেষ। সুখের রাত্রি তো চঞ্চলাবিলাসিনী।‘ সোনার নুপুর বাজিয়ে পায়ে পায়ে যায় চলে । কখন যে ফুরিয়ে যায়, যায় না বোঝা। চমক ভাঙ্গে যখন যায় ফুরিয়ে। দঃখের রাত্রিও কি বসে থাকে ? তারও শেষ আছে। শুধু, বিষণ্ণ ক্লান্তি অসহনীয় । আজকের রাত রূপসী নয় । ধ্বংসলীলার প্রতিমূর্তি‘। মনে হল সবকিছু ভেসে যাবে। এরই মধ্যে চারিদিকে জল জমে সব কিছু কে যেন ভরিয়ে দিতে চাইছে । প্রকৃতি তুমি কত লীলাই না জান!“যে জলেতে তুমি তৃষ্ণা মিটাও সেই জলেতে কেন মরণ আনো।”
ঝড় গেছে থেমে ৷ তখনও বৃষ্টি পড়ছে ঝরে। জানালাটা দিলাম খুলে । রিমঝিম শব্দে পৃথিবী যেন কথা কইছে বৃষ্টির সাথে। তখনও চাদরে ঢাকা পৃথিবী। সব আলোই কি পৃথিবীর বুকে থেকে নিবে গেল চিরদিনের মতো। দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়লাম । শুয়ে জানালা দিয়ে দেখতে লাগলাম অন্ধকারকে। য়ে রূপ কবি সাহিত্যিকদের মুগ্ধ করে তাকে খুজতে চাইলাম । মনে হ‘ল কবির কথা, “গভীর রাত্রির শেষে দিনের প্রকাশ, তার পিছনে আছে রাত্রির তপস্যা/ তারও আছে আছে শেষ ; তাইতো রাত্রির শেষ।” এ রাতেরও তাহলে শেষ আছে। দু‘চোখে আমার ক্লান্তি। কখন যে নিজেকে হারিয়ে ফেললাম, নিজেই জানিনে।
উপসংহারঃ চোখের উপর এসে পড়লো আলো। সুপ্তির সোহাগ গেল টুটে। ‘বাইরে তাকালাম । সূর্য উঠছে। সপ্তরঙের রথে চড়ে তার আগমন। বিগত রাত্রির দুঃস্বপ্নের জঞ্জাল ঝেটিয়ে দিয়ে পঃথিবীর আঙ্গিনাকে বরছে বিধৌত নতুন সকালের জন্যে। চারিদিকে পাখীর কল–কাকলী। রেডিওতে বাজছে প্রভাতী– প্রার্থনা সঙ্গীত ;– “এই আকাশে আলোর বন্যা / মাটিতে প্রাণের ঝরণা, /ভূবন ভরানো গান, /প্রভু সকলি তোমারই দান।”