ছাত্রজীবনে খেলাধুলার স্থান
Chatrajibane kheladhular sthan
[ ভূমিকা— সুস্থ দেহমন ও মানসিক বিকাশ— দেহচর্চার সুফল – খেলাধুলার মাধ্যমে ঐক্য— খেলাধূলার মাধ্যমে শিক্ষা – শিক্ষা ও খেলাধুলোর সামঞ্জস্য বিধান – উপসংহার ]
ভূমিকাঃ বাঙালী–জীবন শান্ত–শালীনতা ভরা জীবন । দেশ কোমল–পেলব – পলিমাটির দেশ । বাংলার ভৌগোলিক পরিবেশ বাঙালী জাতিকে করেছে স্বভাব কোমল ৷ এই শান্ত সমাহিত পরিবেশের শিক্ষা সে গেয়েছে তার প্রাচীন ইতিহাসের পৌরাণিক আশ্রম জীবন থেকে। প্রাচীনকালের শিক্ষা গরু গৃহে — আশ্রম জীবন থেকে শুরু হোত । গুরুগৃহে বাস ও শিক্ষা বা ছাত্রের মধ্যে একটা নিটোল সুস্থ মানস প্রকৃতি গড়ে তুলত ৷
প্রাচীনকালে ছাত্রজীবনের আদর্শ ছিল অধ্যয়ন ৷ ছাত্রানাং অধ্যয়নং তপঃ– ছাত্রজীবনে অধ্যয়নই তপস্যা—এই সত্য প্রাচীনকাল থেকে প্রচারিত ৷ অনন্যমনা হয়ে ইন্দ্রিয়াদি সংযত করে ছাত্রগণ অধ্যয়নে আত্মনিবেশ করবে—এটাই ছিল প্রাচীন সমাজের বিধান। অধ্যয়নের সাথে শরীর চর্চা—যোগ ব্যায়াম প্রভৃতিও ছাত্রেরা করত। তার ফলে সুস্থ দেহ ও মন গঠনের দ্বারা শিক্ষা গ্রহণ তাদের সার্থক ও সস্পষ্টভাবে নিষ্পন্ন হোত ।
সুস্থ দেহমন ও মানসিক বিকাশঃ শুধু অধ্যয়নই ছাত্রদের একমাত্র চরম লক্ষ্য একথা মনে করা একান্ত ভুল। কেবল অধ্যয়ন ছাত্রকে গ্রন্থকীট করে তোলে । গ্রন্থকীট যারা হয় তারা স্বাস্থ্যহীন, দুর্বল–রোগজীর্ণ দেহ নিয়ে সমাজের বোঝা হয়ে দাঁড়ায় ৷ তারা কখনোই সমাজ জীবনের কাজে কর্মে— অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করতে পারে না।প্রকৃত মননুষ্যত্ব অর্জন করতে হলে সবার আগে চাই সুস্থ দেহ ও মন । আর সুস্থ দেহ ও মন গড়ে উঠে সার্থক শরীরচর্চা খেলাধূলার মধ্যে দিয়ে ! শরীর যদি সুস্থ না হয়—তাহলে লেখাপড়া নির্বিঘ্ন হয় না। কারণ সুস্থ দেহই সুস্থ মন গঠন করে । দেহ ও মনের সাথে একাত্ম সম্পর্ক আছে। কাজেই উপযুক্ত মানসিক বিকাশে লেখাপড়ার সাথে খেলাধুলারও আবশ্যিক প্রয়োজনীয়তা আছে এটা আমাদের অবশ্যই মনে রাখা উচিত ।
দেহচর্চার সুফলঃ আধুনিক বিজ্ঞান লেখাপড়ার সাথে খেলাধূলোকেও বেশ গরুত্বপূর্ণ স্থান দিয়েছে। ছেলেবেলায় খেলাধূলার মাধ্যমে শিক্ষা অর্থাৎ play- way-in-education প্রথম থেকেই শিক্ষায় খেলাধুলোর স্বীকৃতি দান করে ।
সভ্যতার অগ্রগতির সাথে সাথে খেলাধূলার নতুন নতুন নিয়ম ও পদ্ধতি সেই সঙ্গে ছাত্রদের মধ্যে খেলাধুলার প্রসার ঘটানোর চেষ্টা আমাদের বুঝিয়ে দেয় ছাত্রাবস্থাতেও খেলার গুরুত্ব কত বেশী ।সভ্যতার গুরুত্ব বিচারের পরিপ্রেক্ষিতে খেলাধূলার স্থান আজ অনেক ঊর্ধে। প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক পর্যন্ত স্তরে খেলাধূলাকে আবশ্যিক করা হয়েছে। তাহা ছাড়া উচ্চ–বিদ্যালয় ও কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয়ও খেলাধুলার গুরত্ব বলে শেষ করা যায় না। শরীর শিক্ষা, শরীর শিক্ষার শিক্ষণ বিদ্যালয় শিক্ষার সাথে খেলাধূলার অবশ্য প্রয়োজনীয়তার কথা মনে করিয়ে দেয়। প্রতি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে আজ তাই শরীর–শিক্ষক নিয়োগ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে ।
খেলাধূলার মাধ্যমে ঐক্যঃ খেলাধুলার মাধ্যমে শরীরচর্চা দেহগঠনের সাথে ছাত্রদের চরিত্র বিকাশও ঘটে থাকে। খেলাধুলার মাধ্যমে ছাত্রদের হৃদয় ও মন প্রফল্ল থাকে, শৃংখলা ও নিয়মানুবর্তিতার দ্বারা তাদের চরিত্র গঠন, উদারতা ও সঙ্ঘবদ্ধতার শিক্ষাও সেই সাথে হয়ে থাকে। খেলাধুলার মাঠের ঐক্য আদর্শ হিসেবে ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করতে পারে। শিক্ষার পাশাপাশি খেলাধূলো ছাত্রদের মধ্যে দলগত ঐক্য স্থাপন রক্ষার সুযোগ দিয়ে থাকে ৷
খেলাধূলার মাধ্যমে শিক্ষাঃ খেলাধূলাকে আজকাল শুধু খেলা রূপেই দেখা হয় না। আধুনিক শিক্ষা–বিজ্ঞানীরা খেলাকে শিক্ষার বাহন করে তুলেছেন। বাল্য– ও কিশোর বয়সের কঠোর সাধনায় শিক্ষালাভের পথ সুগম করার জন্য শিক্ষা– বিজ্ঞানীরা খেলাভিত্তিক শিক্ষার ব্যবস্থা করেছেন । নানা ঘরোয়া খেলার সাহায্যে বিজ্ঞান, অঙ্ক প্রভৃতি বিষয়ের প্রতি ছাত্রদের কৌতুহল বৃদ্ধির চেষ্টা চলছে । খেলার ছলে শিক্ষাদানের নতুন নতুন বইও রচিত হয়েছে । খেলা ও শিক্ষা উভয়ে একাত্ম হয়েছে বর্তমানে। তাই একটাকে বাদ দিয়ে অন্যটাকে এখন আর চিন্তা করা যায় না।
উভয়ের সামঞ্জস্য বিধানঃ শিক্ষার সাথে খেলার সম্পর্ক— গভীরতর হওয়ায় এখন দেখা দরকার খেলার চাপে শিক্ষা যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয় । খেলার সময় খেলা ও পড়ার সময় পড়া করা উচিত। ছাত্র জীবন স্বভাবচঞ্চল । চঞ্চল মন লেখাপড়ায় বাধা আনে। স্বাস্থ্যচর্চা করতে গিয়ে খেলাধুলায় অত্যধিক মনোযোগী হলে ছাত্রদের লেখাপড়া ক্ষতিগ্রস্ত হয় ৷ তাই খেলাধূলা ও লেখাপড়ার মধ্যে নির্দিষ্ট মাত্রায় একটা সামঞ্জস্য বিধান করা অবশ্য প্রয়োজন । তা নইলে শুধু, দেহচর্চার মাধ্যমে দৈহিক সামর্থের অধিকারী হয়ে মানবিক গুণাবলী–বঞ্চিত হলে তা সমাজ জীবনকে অভিশপ্ত করে তুলবে । অধ্যয়নের দ্বারা মানসিক উন্নতি ও চরিত্রের অন্যান্য গুণাবলী অর্জন করা এবং সেই সাথে খেলাধুলোর মাধ্যমে দেহের স্বাস্থ্যের উন্নতি বিধান করা উভয়ের মাত্রা মত সামঞ্জস্য সাধন প্রচেষ্টার সাফল্যেই একমাত্র হতে পারে ।
উপসংহারঃ ছাত্রজীবনে শরীরচর্চা ও অধ্যয়ন একই সাথে সমান গুরুত্বপূর্ণ। এদের উভয়ের মধ্যে কোন বিরোধ নেই। তাই অধ্যয়ন ও খেলাধুলোর মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করে চলতে পারলে ছাত্রজীবন সুন্দর ও সার্থক হয়ে উঠতে পারে। সুস্থদেহ সুস্থমনের সৃষ্টি করে। আর সুস্থমন লেখাপড়ার একান্ত প্রয়োজন। শিক্ষা ও খেলাধূলা একটি অপরটির পরিপূরক একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।