ভারতে পণপ্রথা ও তার বিষময় পরিণাম
Bharate panpratha o tar biṣamay parinam Rochona Bengali
[ ভূমিকা – অন্যতম সামাজিক কুপ্রথা— পণপ্রথার উৎস – উনিশ শতকে নারীমুক্তি ও পণপ্রথা—পণপ্রথার বিষময় পরিণাম – স্বাধীন ভারতে পণপ্রথার উচ্ছেদ সাধনের প্রয়াস—উপসংহার ]
ভূমিকাঃ ভারতে পণপ্রথা বলতে আমরা বুঝি ছেলে মেয়েদের বিয়ে উপলক্ষ্যে মেয়ের পক্ষ ছেলের পক্ষকে যে টাকা কড়ি, সোনাদানা, গহনাগাটি প্রভৃতি দিয়ে থাকে তাকেই বলে বিয়ের পণ্য । যে পদ্ধতি বহুকাল হতে চলে আসছে তাকে আমরা বলি পণপ্রথা। বিয়ের ব্যাপারে ঐ সমস্ত দেওয়া–থোওয়া দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে বলেই ঐ দেওয়াটাকেই পণপ্রথা বলা হয়। উচ্চ হিন্দু সমাজে ছেলের পক্ষ পণ পায় তাই তাকে বলা হয় বরপণ। নিম্ন হিন্দু, সমাজে মেয়ের পক্ষে ঐ পণ পায় তাই তাকে বলে মেয়ে পণ । বর্তমানে উচ্চ–নিম্ন নির্বিশেষে হিন্দু সমাজে সকল শ্রেণীর মধ্যে মেয়ে পণ আর নেই, আছে বরপণ । আর এই ‘বরপণ‘ যা এককালে ছিল ইচ্ছা ও খুশির আনন্দের উপহার তা কালের পরিবর্তনে রূপ পেয়েছে বাধ্যতার, জুলুমের। কন্যার পিতা বরপণ দিতে সক্ষম না হলে তার কন্যার বিয়ে হবে না। মেয়ের বাবা মা‘র তাই মেয়ের জন্ম থেকেই ভাবনা বাড়তে থাকে কি করে মেয়ের বিয়ে দেবেন সেই দুশ্চিন্তা তাদের অহরহ দগ্ধ করতে থাকে। বর্তমানে এই প্রথা এত নিষ্ঠুর আকার ধারণ করেছে যে, বিয়ের সময় প্রতিশ্রুতি মত জিনিষপত্র কিছু যদি বাকী থাকে তাহলে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তা না দিতে পারলে বিয়ের পর মেয়েকে নানা লাঞ্ছনা ও গঞ্জনা ভোগ করতে হয়। এমন কি অকথ্য বাক্য–বাণ বর্ষণ দিন–রাত চলতে থাকে। আর তারই বিষময় পরিণাম মেয়ের আত্মহত্যা জাতীয় অকাল মৃত্যু। রবীন্দ্রনাথ তাঁর দেনাপাওনা নামক এক ছোট গল্পের মাধ্যমে সেই বৃহৎ ও সর্বব্যাপী সামাজিক সমস্যার দিকেই অঙ্গগুলি নির্দেশ করেছেন।
অন্যতম সামাজিক কুপ্রথাঃ আমাদের সমাজ ব্যবস্হায় নারীকে আমরা উচ্চস্থান দিয়ে এসেছি সেই প্রাচীনকাল থেকে । নারী কখনো জায়া, কখনো জননী আবার কখনও বা কন্যা। কিন্তু বিবাহকালে এই কল্যাণী নারীকে ঘিরে যে ঘৃণা দেওয়া–নেওয়া ক্রিয়া চলে তাকেই দেনা–পাওনা বা পণ নেওয়া ও দেওয়া বুঝায় । আর এই পণ দেওয়া–নেওয়া নিয়ে কল্যাণী নারীর প্রতি যে তীব্রতম অপমান নিক্ষেপ করা হয় তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আমাদের জাতীয় জীবনে এটি একটি দীর্ঘস্থায়ী কলঙ্ক রূপে বিরাজ করছে। শত চেষ্টাতেও আজ পর্যন্ত তা সমাজ জীবন থেকে মুছে ফেলা সম্ভব হয়ে উঠেনি ।
পণ প্রথার উৎসঃ যে কল্যাণময় সামাজিক অনুষ্ঠানটির সঙ্গে এই পণপ্রথাটি জড়িত সেই বিবাহ অনুষ্ঠানটি পণপ্রথার আবিশ্যিক অঙ্গ নয়। এই অনষ্ঠানটির সাথে নর–নারী তাদের জীবনের এক গরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে উপনীত হবার এক পবিত্র অধিকার লাভ করে থাকে । এই শুভ অনুষ্ঠান উপলক্ষে ছেলে মেয়ে উভয় পক্ষের আত্মীয় স্বজন, পিতামাতা তাদের স্নেহ–প্রীতির নিদর্শন স্বরূপে নবদম্পতিকে কিছু উপঢৌকন স্বেচ্ছায় দান করতেন । এই দানে কোন জোর–জুলম বা বাধ্য–বাধকতা থাকত না। কিন্তু কালক্রমে সামাজিক অবস্থার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক মূল্যবোধের পরিবর্তন হওয়ায় এক কালের স্বেচ্ছা দান আবশ্যিক সামাজিক প্রথায় পরিবর্তিত হয়েছে । সমাজে নারীর মূল্যের অবমূল্যায়নের সাথে–সাথে পণপ্রথা আজ তার ভয়ংকর রূপ নিয়ে সমাজে বিভীষিকার সৃষ্টি করেছে ।
উনিশ শতকে নারী মুক্তি ও পণ প্রথাঃ ঊনবিংশ শতকে ইংরেজ তথা পাশ্চাত্য সভ্যতার সংস্পর্শে এসে বাঙালীর চেতনায় যে নবজাগরণের উন্মেষ ঘটলো তারই প্রভাবে বাঙালী সমাজে নানা সামাজিক সংস্কার সাধিত হল। নারীর মল্যে ও অধিকার নিয়ে নতুন ভাবনার উদবোধন ঘটল। রামমোহন বিদ্যাসাগর প্রভৃতি মহামানব সমাজে নারীর মূল্য ও স্থান বিষয়ে সচেতন হয়ে, কুপ্রথা ও সামাজিক অনাচারের হাত থেকে নারী সমাজকে মুক্ত করার জন্য বিবিধ সংস্কার আন্দোলন চালালেন। সতীদাহ প্রথা নিবারণ, বাল্যবিবাহ নিবর্তন, বিধবা বিবাহ প্রচলন, স্ত্রী শিক্ষার প্রবর্তন, বিভিন্ন সামাজিক ক্ষেত্রে নারীর সমানাধিকারের প্রতিষ্ঠার চেষ্টায়– নারী সমাজকে দাসত্বের শৃংখল থেকে মুক্তির প্রেরণা দিল। বিবাহ পণপ্রথা নিয়ে অনেক আলোচনা সত্তেও বাস্তবে এই প্রথাটি তুলে দেওয়া সম্ভব হোল না ।
পণপ্রথার বিষময় পরিণামঃ কৌলিন্য প্রথা ও জাতিভেদ প্রথার জন্য পণপ্রথা, দিনে দিনে আরও জোরদার আধিপত্য অর্জন করল। তার ফলে সমাজের লোভ তীব্র আকার ধারণ করল। বর্তমানে মেয়ের বিয়েতে চাই অর্ধেক রাজত্বের সাথে সোনার সিংহাসন । বেকার, অপদার্থ ছেলের হাতে মেয়েকে তুলে দিতে গেলেও মেয়ের বাবাকে সারা জীবনের সঞ্চয়ের ভাঁড়ার শূন্য করে দিতে হয়। কৌলিন্য প্রথার নিদারুণ অভিশাপ আজ নবরূপে লাভ করে পণপ্রথারূপে সমাজে ‘নিরুপমা’র মত মেয়েদের ভাগ্যকে পরিবারের সকলের লাঞ্ছনা–গঞ্জনার ঘাঁটি করে তুলেছে । তার ফলে কন্যার পিতা–মাতা কন্যার বিবাহের দেনা মেটাতে পথের ভিক্ষুকে পরিণত হচ্ছে। তাতেও হয় না, বিবাহের পণ ঠিক ঠিক দেওয়া হয়নি বলে বধূর উপর অকথ্য অত্যাচার, দৈহিক ও আত্মিক পীড়ন এবং যার ফলে ঘটে নাশংস হত্যা কিংবা দঃসহ আত্মহত্যা। এই নগ্ন বর্বরতা আমাদের ভারতীয় সমাজের বহুদিনের কলঙ্কিত ইতিহাস । প্রতিদিনের সংবাদ পত্রের পাতায় পাতায় বধূ হত্যা, বধূ নির্যাতন, বধূর আত্মাহূতির কটা বিবরণই প্রকাশ হয়— বাস্তবে হয় তার চেয়ে অনেক অনেক বেশিই—কে তার হিসেব পায় ?
স্বাধীন ভারতে পণপ্রথার উচ্ছেদ সাধনের প্রয়াসঃ অতি সম্প্রতি স্বাধীন ভারতে পণপ্রথা দণ্ডনীয় অপরাধ বলে ঘোষিত হয়েছে। আইনও পাশ হয়েছে। কিন্তু শুধু, আইন পাশ করে এই জগদ্দল প্রথা নড়ানো যাবে না ৷ এর জন্য প্রয়োজন মনোভাবের পরিবর্তন। নারী যে সমাজের কল্যাণী প্রতিমা, এই বোধ জাগ্রত না হলে পণপ্রথার উচ্ছেদ সাধন বাস্তাবায়িত হওয়া সম্ভব নয় । সমাজের প্রতিটি মানুষ যদি এই মর্মে শপথ নেয় – ”পণ নেব না, পণ দেব না”—তবেই এই সামাজি কু প্রথার উচ্ছেদ সম্ভব ।
উপসংহারঃ তবে এই কাজ একদিনে সম্ভব নয় ৷ এর জন্য চাই দীর্ঘস্থায়ী সামাজিক আন্দোলন। রেডিও, টিভি–র প্রচার, সংবাদ পত্র ও সরকারী বেসরকারী পত্র পত্রিকায় এর বিরুদ্ধে জনমত গঠন, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সভা, পথসভায় এবং মিছিলে মিছিলে এর বিষময় পরিণামের কথা জনগণকে বুঝিয়ে বলা—এ সবও করতে হবে । এই কুপ্রথা দূরীকরণে ছাত্র সমাজের দায়িত্বও কম নয়। গুণীজনের মতামত—উপদেশও দরকার। মোট কথা, এই বিষময় প্রথা সমাজ থেকে উৎখাত করতে না পারলে স্বাধীন দেশের সার্বিক উন্নয়ন কখনই হতে পারে না। নারী ও পরুষের সমান মূল্যে স্বীকার আমরা যদি না করি তাহলে জাতীয় জীবনের অগ্রগতির রথের চাকা স্তব্ধ হয়ে যাবে ।
অনরূপে প্রবন্ধ :
সতীদাহ প্রথা
[ ভুমিকা—সতী কাকে বলে— সতীদাহের প্রথম প্রচলন – সতীদাহ বন্ধের বিভিন্ন প্রচেষ্টা – সামাজিক কলঙ্ক —এখনও সতীদাহ প্রথা বন্ধের উপায়—উপসংহার ]