বাংলার ঋতুচক্র
Banglar Rituchakra
[ভূমিকা – গ্রীষ্ম–বর্ষা–শরৎ–হেমন্ত–শীত — বসন্ত – উপসংহার ]
ভূমিকাঃ প্রকৃতির মাঝে বিশ্বপিতার অসীম লীলার অসীম প্রকাশ ; তাঁর প্রাণের সঙ্গে প্রাণের খেলা । একহাতে ধ্বংস, অন্য হাতে সৃষ্টি—এই তো নিত্য দিনের খেলা–ঘরের খেলা । বিনাশের গর্ভে‘ নবীন প্রাণের ভ্রূণ আত্মপ্রকাশ করে । জীর্ণ–পাতা ঝরে গেলেই তো হয় নবীন কিশলয় সম্ভাবিত । এক যায়, আর এক আসে । পরোতন চলে যায় তার জীর্ণ, ক্লান্ত, ধূলিমলিন, ধূসর হৃত সর্বস্বরূপে নিয়ে—আসে নূতন। ঠিক এমনি করে চলে বিভিন্ন ঋতুর আসা–যাওয়ার আবর্তন ছেড়ে আবর্তন। বাংলার মতো এমন বিভিন্ন ঋতুর আসা–যাওয়ার স্পষ্ট প্রতীয়মান রূপ আর কোথাও দেখা যায় না। গ্রীষ্ম থেকে বসন্ত পর্যায়ক্রমে চলে আনাগোনা তাদের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য, রূপ মাধুর্য নিয়ে।এ যেন বিচিত্র সম্ভারে বাংলার রূপ বন্দনা ৷
গ্রীষ্মঃ গ্রীষ্ম আসে তার প্রচণ্ডতা নিয়ে । দারুণ অগ্নিবাণে পৃথিবীকে করে দগ্ধ । তৃষিত মাটির বুকে দেখা যায় ফাটল যেন মাটির শেষ রসটুকু শুষে নিতে চায়। পাতা ঝরা গাছগুলো যেন হৃত–সব স্বরূপ ধারণ করে। মানুষ তাকায় বার বার আকাশপানে ; বলে, “আল্লা মেঘ দে, পানী দে, ছায়া দেরে তুই।” এ অগ্নিধারা শুধু ধ্বংসের জন্য নয়, সৃজনের জন্যেও। তাই কালবৈশাখীর বৃষ্টির ধারায় তৃষিত ধরা হয় তৃপ্ত। গ্রীষ্মের ফল সম্ভার আকর্ষণীয়। আম, জাম, কাঁঠালের গন্ধ, ভরিয়ে তোলে গৃহপ্রাঙ্গন ।
বর্ষাঃ গ্রীষ্ম যায়, বর্ষা আসে। বাঁধ ভাঙ্গা জলস্রোত নেমে আসে পৃথিবীর বুকে। সে আসে ‘অতি ভৈরব হরষে‘ পৃথিবীকে করতে জল–সিঞ্চিত। নিবিড় শ্যামলিমায় ভরে যায় পৃথিবী। বন্যার প্রকোপ, সরীসৃপের ভয়, তত্ত্বও কবির মন মেতে উঠে ভাবের দোলায়। এ বৃষ্টি ধারা যেন চির–বিরহীর অশ্রুধারা। শ্রাবণের ধারা আনে বিষাদ মগ্নতা। প্রকৃতি কিন্তু মেতে উঠে নতুন ফসলের আনন্দে। বর্ষা‘ নব জীবনের শুভ সংকেতের বাহক। নতুন প্রাণের বীজ আত্মপ্রকাশ করে বর্ষা‘র স্নিগ্ধ শীতল জলধারায়। নীল শাখায় দোলায়িত ছন্দ জানায় সেই বারতা ।
শরৎঃ শরৎ আসে যেন কৈশোরের মতো নিঃশব্দ চরণে। এ যেন সুন্দরের উপাসনা। আকাশে–বাতাসে অশ্রুতে আহ্বান, – “এসো গো শারদ লক্ষ্মী তোমার শুভ্র মেঘের রথে।” নদী কানায় কানায় পূর্ণ, অথচ নেই বন্যার ভয় । – “তীর ছাপি নদী কল–কল্লোলে এল পল্লীর কাছেরে।” হাল্কা হাওয়ায় মেঘের দোলা কাঁপন লাগায় প্রাণের পাখায় । আকাশে কাল–মেঘের ভেলা, আর মাটিতে কাশ ফলের দ্যোদুল দোলা। শরৎ–পূর্ণিমার পূর্ণ চাঁদের মায়া অভাবনীয় । সারা আকাশ জুড়ে ছিলকে মেঘ, চাঁদের আলো পারেনা ঢাকতে । শুধ নেয় আলো আঁধারের মাঝে এক রহস্যলোকের চেহারা। শরৎ আনে প্রাণের ধন, অন্নপূর্ণা র ঝলি। চাষীর ঘরে ঘরে নবান্নের আয়োজন। সারা বছরের বাঁচার আশার বাণী । “জননী তোমার আহ্বান লিপি পাঠায়ে দিয়েছ ভুবনে, নতুন ধান্যে হবে নবান্ন তোমার ভবনে ভবনে।” শারদোৎসব—মহামায়া দূর্গে‘র বন্দনা যেন শরতের নিজস্ব পরিকল্পনা। বাঙালীর মন সারা বছর উম্মুখ হয়ে থাকে এই উৎসবের জন্য। তারা যেন বলে, “আমরা বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ, আমরা গেথেছি শেফালী মালা–নবীন ধানের মঞ্জুরী দিয়ে সাজিয়ে এনেছি ডালা” – এই শুভ উৎসবের জন্য। এ উৎসবের ভিতরে রয়েছে যেন বাঙালীর প্রাণের টানের টান । প্রাণের সঙ্গে প্রাণের, মনের সঙ্গে মনের মিলন–মেলা। কান্না ভুলে হাসি—বিদ্বেষ ভুলে ভাবের বিনিময়। সব কিছু ভুলে হৃদয়ের সাথে হৃদয় মাখামাখি হয় ‘বিজয়া‘ উৎসবে ।
হেমন্তঃ হেমন্ত যেন শীতের নকিব । সে আসে আর বলে যায়, “এলো যে শীতের বেলা ।” হেমন্তের স্পষ্ট–প্রতীয়মান কোন স্বত্তা নেই । যেন শরৎ আর শীতের সেতু–বন্ধন ওর কাজ। বড় মিষ্টি তার আসার ভাষা। শীতের কাঁপানি নেই, আছে শীতের আমেজ। তাই বড় স্নিগ্ধ–মধুর বেদনা–বিধরও নয় । নেই সৃষ্টির বৈভব, নেই ধ্বংসের রূপ। ও যেন নিজের সাথে নিজে করে খেলা । –যেন প্রৌঢ়ত্বের প্রশান্তি ওর “অঙ্গে অঙ্গে বাজায় বাঁশি।”
শীতঃ শীতের শঙ্কতা প্রকৃতিকে “ঝরা ফলদলে” নতুন অতিথির আগমনী শোনায়। গাছের পাতা–ঝরার খেলা। —“শীতের বনে সে কঠিন আসলো বলে— শীউলীগুলি ভয়ে মলিন বনের কোলে।” শীতে কাঁপনি আছে যেমন, তেমনি আছে পান, পানি, পিঠে—এই তিন মিঠের আকর্ষণ । পৌষ–পার্বনে রোদে পিঠ দিয়ে পিঠের মিঠে স্বাদ কোন বাঙালী না আস্বাদন করে! বাণী–বন্দনা বাঙালীর ঘরে ঘরে । এ উৎসব আবাল–বৃদ্ধ–বনিতার, তত্ত্বও পড়য়ারা মেতে উঠে অনেক বেশী।—যেন তাদের নিজস্ব উৎসব। শীত যায় চলে, আর যায় বলে, “আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে।”
বসন্তঃ বস্তুত প্রকৃতিকে রঙে রসে ভরিয়ে তোলে। ফুলের মেলা, হোলি খেলা—সব কিছুই প্রাণের উদ্দাম বন্যা। যৌবনের উন্মাদনা প্রকৃতির মাঝে এনে দেয় বসন্ত। কোকিলের কুহুতানে, আর শিরিষের শাখায় শাখায় নতুন বছরের আগমনী গান ৷ তাই বসন্ত রোগের প্রদুর্ভাব বাঙালীর মনকে পারে না বিষণ্ণতার ভারে ভারাক্লাত করে তুলতে। কারণ, বসন্ত তো শুধু প্রকৃতির বুকেই করেনা কাব্য রচনা, রচনা করে মানব মনেও। রাজকীয় অবস্থান তার ;—তাইতো সে ঋতুরাজ।
উপসংহারঃ প্রকৃতির মাঝে মানব মনে ঋতুর প্রভাব বাংলা ছাড়া এমন করে আর কোথাও উপলব্ধি করা যায় না। বিভিন্ন ঋতুর সরাইখানা যেন এই বাংলা । তাকে রূপে, রসে, গন্ধে ভরিয়ে তোলার জন্যই যেন সর্ব শ্রেষ্ঠা হয়েছেন ঋতুর স্রষ্টা। তাইতো সে “সকল দেশের রাণী”; যা মূর্ত্ত কবির বাণী !
ফিরেযাই আমাদের নির্বাচিত রচনার তালিকাতে