বন–সৃজন ও বন–মহোৎসব
Bana srijan o bana mahotsab Rochona bengali
[ ভূমিকা– বন–মহোৎসবের প্রয়োজনীতা—অরণ্যের কোলে ভারতীয় সভ্যতার বিকাশ—বনভূমি ও মানব জীবন —বন–মহোৎসবের গর্ত্বে—বন–সৃজনের সূত্রপাত ও প্রচলন—উপসংহার ]
ভূমিকাঃ পৃথিবীর সৃষ্টির পর জীব সৃষ্টির অনেক পূর্বে অরণ্যের সৃষ্টি হয় । অরণ্যভূমিই পৃথিবীতে প্রথম আগন্তুক । এই অরণ্যই মানুষের নিকটতম প্রতিবেশী। মানষের আসার বহু পূর্বেই তার আশ্রয়, আত্মরক্ষা, খাদ্য যোগান, শীতল ছায়া প্রদান এবং মানব জীবনকে আরামদায়ক করার পিছনে অরণ্যভূমির অবদানের শেষ নেই । অরণ্যভূমিকে তাই বলা হয় অরণ্য সম্পদ । ভারতের সভ্যতা অরণ্য সভ্যতা । গাছের পাতায় লেখার সূত্রপাত হয় তখন যখন কাগজের অস্তিত্বই ছিল না । তাই প্রাচীন যুগ থেকে বৃক্ষ দেবতা হিসাবে, ধাত্রী হিসাবে মানষের কাছে পূজো ও শ্রদ্ধা পেয়ে আসছে। পুত্র–কন্যাহীন রমণী বৃক্ষ প্রতিষ্ঠা করত, বৃক্ষকে সন্তানরূপে প্রতিপালন ও রক্ষণাবেক্ষণ করত । এই সব থেকেই বুঝা যায় সুদূর প্রাচীনকাল থেকে বৃক্ষ আমাদের কতখানি আপন হয়ে আছে । আর সেই কারণেই প্রাচীনকাল হতেই মহাসমারোহে বৃক্ষরোপণ উৎসব বা বন–মহোৎসব উদযাপন করা হোত ।
বন–মহোৎসবের প্রয়োজনীয়তাঃ মানুষ আজ অরণ্য ধ্বংসের নেশায় মেতে উঠেছে। এ যে তার কত বড় সর্বনাশ তা সে বঝতে পারছে না । অরণ্যই মানষের সমুখে দঃখে প্রধান সাহায্যকারী। মরুভূমি প্রতিরোধ একমাত্র অরণ্যের মাধ্যমেই সম্ভব। দেশকে সুজলা–সুফলা করতে বৃষ্টির প্রয়োজন। তাই বৃষ্টিপাতের জন্য অরণ্যভুমির প্রয়োজন । বৃক্ষ আমাদের মায়ের কাজ করে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত বৃক্ষ নানাবিধ কাজে আমাদের উপকারে লাগে। তাই অরণ্য সংরক্ষণের প্রয়োজন, তাই প্রয়োজন অরণ্য সৃজন, তাই প্রয়োজন বন মহোৎসব। প্রয়োজন হলে আইন করে অরণ্য সংহার–নিরোধ করতে হবে। পরিবর্তে বন–সৃজনে উৎসাহ দিতে হবে ।
অরণ্যের কোলে ভারতীয় সভ্যতার বিকাশঃ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সভ্যতা বিভিন্ন প্রাকৃতিক পরিবেশের উপর নির্ভর করে গড়ে উঠেছে। ভারতের সভ্যতা প্রকৃতি নির্ভর । অরণ্যের মাঝে তপোবন সৃষ্টি হয়েছে । এই তপোবনেই মুনি–ঋষি তাদের সাধনার মধ্য দিয়ে সৃষ্টি করেছেন ভারতীয় সভ্যতার। ভারতবর্ষ অরণ্যভূমির শ্যামল ছায়ায় ভারতীয় সভ্যতার আশ্চর্য স্বপ্নকে মূর্ত করে তুলেছে । বেদ নির্দেশিত মানব জীবনের চারিটি ভাগের মধ্যে বাণপ্রস্থ ও সন্ন্যাসে আধ্যাত্মিক সাধনার প্রয়োজনে বনে গমনের কথা আছে । কাজেই বন ভারতীয় জীবনের সাথে ওতঃপ্রোতভাবে জড়িত। এই বন–সংরক্ষণ বা বন–সৃজন বন–মহোৎসবের মধ্যেই করতে হবে। ভারতীয় কবির কণ্ঠে তাই উদাত্ত স্বরে ধ্বনিত হয়েছিল :-
‘দাও ফিরে সে অরণ্য লও এ নগর,
লও যত লৌহ, লোষ্ট্র, কাষ্ঠ ও প্রস্তর ।
হে নব সভ্যতা, হে নিষ্ঠুর সর্বগ্রাসী,
দাও ফিরে তপোবন, পণ্যেছায়া রাশি,
গ্লানিহীন অতীতের দিনগুলি ।
গ্লানিহীন অতীতের দিনগুলি ফিরে পাবার এহেন চাহিদার কারণ বন কেটে নগর বসানর উন্মত্ততার বহর ইউরোপীয়দের মত ভারতীয়দেরও নগ্নভাবে প্রকাশিত দেখে ।
বনভূমি ও মানব জীবনঃ মানব জীবনের সাথে বৃক্ষের এক গভীর যোগ আছে । মানষের ছন্দোবদ্ধ জীবনের প্রকাশ বৃক্ষের পাতায় মম‘র ধ্বনির মধ্যে। তাই আমাদের জীবনের আচার–অনুষ্ঠানের সব কিছুতেই বৃক্ষ, বৃক্ষের পাতা, পল্লব, ফুল, ফল, এমন কি কাষ্ঠও ব্যবহৃত হচ্ছে অনন্তকাল থেকে। মানুষের ধ্যান, জ্ঞান, তপস্যা, মানুষের কল্পনা–চিন্তা–চিত্র–সংগীত–কবিতা সবকিছুর মধ্যে বৃক্ষ আছে। গাছ আমাদের জীবন রক্ষার একান্ত সহায়। আমাদের দেহ নিঃসৃত দূষিত গ্যাসকে গ্রহণ করে আমাদের প্রাণরক্ষার অক্সিজেন ফেরৎ দিয়ে আমাদের অপরিশোধ্য ঋণে বেধে রেখেছে। তাই বনভূমি ও মানব জীবন শত নয় সহস্র পাকে বাঁধা আছে । বনকে রক্ষা করা আমাদের প্রাণরক্ষার মতই সমান গুরুত্বপূর্ণ একথা আমাদের মনে রাখা উচিত।
বন–মহোৎসবের গুরুত্বঃ আজ যে হারে অরণ্য ধ্বংসের উন্মত্ততায় মানষ মেতে উঠেছে—তা থেকে তাকে নিরস্ত না করলে মানব সভ্যতাই ধ্বংস হয়ে যাবে । স্নিগ্ধ শীতল ছায়া থেকে শরণ করে প্রাণরক্ষার অক্সিজেন প্রদান করা খাদ্য–বাসগৃহ, ওষুধপত্র পর্যন্ত সবই অরণ্য আমাদের যোগায়। অরণ্যই প্রাণের অর্থাৎ প্রাণরক্ষার চাবিকাঠি — সোনার কাঠি । নব–সংহারের ব্যাপকতায় প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিনষ্ট হতে চলেছে । এমতাবস্হায় বন–সংরক্ষণের কারণে বন–মহোৎসবের বিশেষ প্রয়োজন ।
বন–সৃজনের সূত্রপাত ও প্রচলনঃ বর্তমানে অরণ্য সম্পদের ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর অবস্থা হওয়ার একমাত্র কারণ পাশ্চাত্ত্য সভ্যতার দ্রুত বিকাশ । এই সভ্যতার প্রসারে আমরা নিজেদের ক্ষতি নিজেরাই করে চলেছি। এখনই যদি আমরা সতর্ক‘ না হই তাহলে আমাদের পরিণাম অতি ভয়াবহ হয়ে উঠবে । রবীন্দ্রনাথ বহুদিন পূর্বেই এই বিষয় উপলব্ধি করে শান্তিনিকেতনে ভারতীয় প্রাচীন ধারায় আশ্রমিক শিক্ষা ও আশ্রম জীবনের পনেঃপ্রচলন করেন । প্রকৃতিকে দূরে সরিয়ে নয়, কাছে টেনে প্রকৃতির অমলিন ও স্নেহমধুর দানে মানব জীবনকে পূর্ণ করার প্রয়াস তিনিই প্রথম শুরু করেন । এখন আমাদের দেশে যে বন–মহোৎসব পালনের কথা শুনি তার সূত্রপাত রবীন্দ্রনাথই করেছিলেন।
দেশ স্বাধীন হবার পর ১৯৫০ সাল থেকেই আমাদের দেশে বন–মহোৎসব পালন করা হচ্ছে। আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে বৃক্ষ–রোপণের অসীম গুরুত্বের কথা স্মরণ রেখেই জনসাধারণের মধ্যে এই চেতনা ছড়িয়ে দেবার জনাই প্রতি বছর জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে বন–মহোৎসবের জন্য বিভিন্ন ব্লক থেকে সরকারী খরচে গাছের চারা বিলি করা হয়। শুধু বৃক্ষ–রোপণই নয় তাকে রক্ষা করার ব্যবস্থাও দরকার । প্রতি বছর যে পরিমাণ গাছের চারা বিলি হয় তার অনেক অংশই শুকিয়ে যায় অথবা গরু–ছাগলে খেয়ে নেয় । কাজেই গাছকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টাও দরকার ।
উপসংহারঃ অরণ্য আমাদের প্রাণ, অরণ্য আমাদের সভ্যতার বিকাশ একথা যদি আমরা মনে রাখতে পারি তখনই একটি গাছ কাটবার আগে আমরা চিন্তা করব কটি গাছ আমরা আমাদের জীবনে এমনই বড় করেছি। একটি প্রাণসংহার যেমন পাপ, ঠিক একটি বক্ষ–সংহারও সমান পাপ এই মনোভাব যদি আমরা সৃজন করতে পারি তাহলে পরিবেশ দূষণ তথা প্রাকৃতিক ভারসাম্যের অস্থিরতা, মরভূমির বিস্তার সবই ঠেকান যাবে । প্রয়োজনে পরিণত বৃক্ষ কাটা চললেও—বৃক্ষ রোপণের মাধ্যমে তার সে শূন্য পরণের জন্যই বন–মহোৎসবের এত গুরুত্ব ।
অনুরূপ প্রবন্ধ : অরণ্য সংরক্ষণ ।
[ ভূমিকা—সংরক্ষণ কাকে বলে—সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা – সংরক্ষণের ব্যবস্থা ( সমাজ ভিত্তিক বনসৃজন ); কতখানি কার্যকরী হয়েছে—আরও কি কি ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে—উপসংহার ]