
অ্যাকোয়ারিয়ামের জলজ উদ্ভিদ
অ্যাকোয়ারিয়ামের জলজ উদ্ভিদ
অ্যাকোয়ারিয়ামের মাছের পরে অন্যতম সজীব উপাদান হলো জলজ উদ্ভিদ। রঙিন মাছ অ্যাকোয়ারিয়ামের শোভাবর্ধন করে আর জলজ উদ্ভিদ অ্যাকোয়ারিয়ামের শোভার পরিপূর্ণতা দেয়। এছাড়া জলের গুণাগুণ নিয়ন্ত্রণে ও মাছের প্রয়োজনে অ্যাকোয়ারিয়ামে জলজ উদ্ভিদের ব্যবহার করতে হয়। যেমন–
(ক) সালোকসংশ্লেষ প্রক্রিয়ায় খাদ্য তৈরি করার সময় জলের দ্রবীভূত অক্সিজেন মাত্রা বাড়ায় ।
(খ) বিভিন্ন প্রকার জলের দূষিত পদার্থ শোষণ করে জল পরিশুদ্ধ করে।
(গ) মাছের আশ্রয়স্থল হিসাবে কাজ করে।
(ঘ) মাছের প্রজনন ক্ষেত্র হিসাবে কাজ করে।
বিভিন্ন ধরনের জলজ উদ্ভিদ আছে। বিভিন্ন ভৌগোলিক অঞ্চলে জলজ উদ্ভিদের বৈচিত্র্য বিভিন্ন রকম। উষ্ণমণ্ডলে নাতিশীতোষ্ণমণ্ডলের তুলনায় জলজ উদ্ভিদের বৈচিত্র্য বেশি। উপমণ্ডলের উল্লেখযোগ্য জলজ উদ্ভিদ হলো আমাজন সোর্ড প্ল্যান্ট, ভ্যালিসনারিয়া, লুডুইগিয়া, ওয়াটার স্প্রাইট, ক্রিপটোকোরিন এবং নাতিশীতোষ্ণমণ্ডলের ক্যাবোম্বা ও ফক্সটেইল ইত্যাদি। আবার জলে অবস্থান অনুযায়ী জলজ উদ্ভিদের প্রকৃতি বিভিন্ন হয়।
যেমন–
(1) ভাসমান জলজ উদ্ভিদ : যেসব জলজ উদ্ভিদ মূলসহ জলের ওপরে ভাসে তাদের ভাসমান জলজ উদ্ভিদ বলে। যেমন—কচুরিপানা, পিস্টিয়া, লেমনা, অ্যাজোলা ইত্যাদি।
(2) আংশিক নিমজ্জিত জলজ উদ্ভিদ : যেসব জলজ উদ্ভিদের অগ্রভাগ জলের ওপরে ভাসে ও মূল মাটিতে আবদ্ধ থাকে তাদের আংশিক নিমজ্জিত জলজ উদ্ভিদ বলে। যেমন—হাইগ্রোফিলা, জলজ লিলি, পদ্ম ইত্যাদি।
(3) সম্পূর্ণ নিমজ্জিত জলজ উদ্ভিদ : যেসব জলজ উদ্ভিদ সম্পূর্ণরূপে জলের মধ্যে নিমজ্জিত থাকে তাদের সম্পূর্ণ নিমজ্জিত জলজ উদ্ভিদ বলে। যেমন—হাইড্রিলা, কারা, ক্যাবোম্বা ইত্যাদি।
অ্যাকোয়ারিয়াম বিভিন্ন প্রকার জলজ উদ্ভিদ দিয়ে সাজানো যায়। এই বিভিন্ন প্রকার জলজ উদ্ভিদ এমনভাবে সাজানো হয় যাতে সবরকম উদ্ভিদের সৌন্দর্য দৃষ্টিগোচর হয়। যেমন—
(A) পশ্চাৎপট সাজানোর জলজ উদ্ভিদ : দ্রুত বাড়ে ও লম্বা পাতা এমন উদ্ভিদ অ্যাকোয়ারিয়ামের পিছন দিকে স্থাপন করতে হয়। যেমন—ভ্যালিসনারিয়া, স্যাজিটারিয়া ইত্যাদি।
(B)সম্মুখভাগ সাজানোর জলজ উদ্ভিদ : খুব ধীরে বাড়ে ও কম লম্বা জাতের জলজ উদ্ভিদ অ্যাকোয়ারিয়ামের সামনের দিকে স্থাপন করতে হয়। যেমন—মাইক্রোস্পোরিয়াম ইত্যাদি।
(C) স্থানপূরণকারী জলজ উদ্ভিদ : ঝুপো প্রকৃতির উদ্ভিদ অ্যাকোয়ারিয়ামের অবশিষ্ট জায়গায় স্থাপন করতে হয়। সাধারণত অ্যাকোয়ারিয়ামের কর্ণারগুলিতে রোপণ করা যায়। যেমন—লুডুইগিয়া ইত্যাদি।
(4) আশ্রয়স্থল হিসাবে ব্যবহৃত জলজ উদ্ভিদ : দীর্ঘপাতা বিশিষ্ট জলজ উদ্ভিদ মাছের আশ্রয়স্থল হিসাবে কাজ করে। যেমন—পিষ্টিয়া, ভ্যালিসনারিয়া ইত্যাদি।
জলজ উদ্ভিদের বংশবিস্তার ও চারা উৎপাদন
সাধারণত অ্যাকোয়ারিয়ামে ব্যবহৃত অধিকাংশ জলজ উদ্ভিদ অ্যাকোয়ারিয়ামেই বংশবিস্তার করতে সক্ষম।
(1) বীজ উৎপাদন করে বংশবিস্তার– সাধারণত অ্যাপানোগেটন, সেলোফেন সোর্ড প্ল্যান্ট ও স্প্যাটারডক্স ইত্যাদি জলজ উদ্ভিদ বীজ উৎপাদন করে বংশবিস্তার করে।
(2) শাখা বিভাজন পদ্ধতিতে বংশবিস্তার–সরু ও লম্বা কাণ্ড বা শাখাবিশিষ্ট জলজ উদ্ভিদের এই পদ্ধতিতে বংশবিস্তার হয়। শাখা বা কাণ্ডের কোনো অংশ কেটে অ্যাকোয়ারিয়ামের তলদেশে রোপণ করলে নতুন চারা উৎপন্ন হয়। যেমন— হাইগ্রোফিলা, ক্যাবোম্বা, লুডুইগিয়া, মাইরিওফাইলাম ইত্যাদি।
(3) মুকুল বিভাজন পদ্ধতি–সাধারণত ঝুপো উদ্ভিদের কেন্দ্রীয় মুকুল থেকে প্রচুর শাখা মুকুল বের হয়। এই শাখা মুকুল কেটে লাগালেই নতুন চারা উৎপন্ন হয়। যেমন—অ্যাকোয়ারিয়াম লিলি, ক্রিপটোকোরিন ইত্যাদি।
(4) ধারক বা রাখার বিভাজন পদ্ধতি—এসব উদ্ভিদ সরু আনুভূমিক শাখা উৎপন্ন করে। মাটির সংস্পর্শে এই শাখায় মূল উৎপন্ন হয়। মূল উদ্ভিদ থেকে এই শাখা আলাদা হয়ে নতুন চারা উৎপন্ন হয়। যেমন—স্যাজিটারিয়া, ভ্যালিসনারিয়া, একাইনোডোরাস ইত্যাদি।
(5) লাইন বিয়ারিং পদ্ধতি–আমাজন সোর্ড প্ল্যান্ট তার পুষ্প বৃত্ত থেকে সরাসরি নতুন চারা উৎপন্ন করে। ফুলের বৃত্তের সংযোগস্থল থেকে নতুন চারার জন্ম হয়। এছাড়া অ্যাম্মুলিয়া, এলিওক্যারিস ও লুডুইগিয়া ইত্যাদি উদ্ভিদও দেখা যায়।
(6) খণ্ডীকরণ পদ্ধতি—এই জাতীয় উদ্ভিদদের কাণ্ডে নিয়মিত ব্যবধানে দুর্বল অংশের সৃষ্টি হয় ও জলস্রোতে দুর্বল জায়গা থেকে খণ্ড বিচ্ছিন্ন হয়। প্রতিটি খণ্ড থেকে নতুন চারা উৎপন্ন হয়। যেমন—অ্যালাকারিনা।
(7) উইন্টার বাড পদ্ধতি–কিছু কিছু জলজ উদ্ভিদের উইন্টার বাড জলে সুপ্ত অবস্থায় থাকে ও গ্রীষ্মকালে ঐ বাড থেকে নতুন চারা উৎপন্ন হয়। যেমন—পোটামোগেটন, স্পাইরোডেল্লা, মাইরিওফাইলাম ইত্যাদি।
অ্যাকোয়ারিয়ামে ব্যবহৃত জলজ উদ্ভিদ
অ্যাকোয়ারিয়ামে বিভিন্ন প্রকার জলজ উদ্ভিদের ব্যবহার হয়। অ্যাকোয়ারিয়ামের আকৃতি, আকার ও যে যে রঙিন মাছ পালন করা হবে তার ওপর জলজ উদ্ভিদ নির্বাচন নির্ভর করে। অ্যাকোয়ারিয়ামে জলজ উদ্ভিদ দেওয়ার কারণগুলি হলো–
(1) অ্যাকোয়ারিয়ামটিকে যেন একটি প্রাকৃতিক জলাশয় বলে মনে হয়।
(2) মাছের আশ্রয়স্থল ও প্রজননে সহায়তা করে।
(3) জল পরিষ্কার রাখে।
(4) জলে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
জলজ উদ্ভিদগুলি হলো—
(ক) ওয়াটার উইস্টারিয়া : পাতা ডিম্বাকৃতির হয়। কাণ্ডের দু‘পাশে পরিবর্ত পদ্ধতিতে পাতা বিন্যস্ত থাকে। জলে নিমজ্জিত পাতার রঙ ধূসর–সবুজ ও জলের ওপরে থাকা পাতার কিনারা কালচে রঙের হয়। ফুলের রঙ গোলাপী, সাদা বা হাল্কা নীল।
(খ) অ্যাপোলোগেটন : পাতা সমান ও বৃহদাকারের হয়। কিনারা ঢেউ খেলানো। পাতার রঙ সবুজ ও জালিকাকার শিরা বিন্যাস। ছোট ছোট ফুল হয়। ফুলের রঙ হলুদ। ক্ষুদ্রাকৃতির মূল।
(গ) ব্যাকোপা : বর্ষজীবী উদ্ভিদ। কাণ্ডে খাঁজ থাকে। পাতা বৃন্তবিহীন। কাণ্ডের দু‘পাশে পরিবর্ত পদ্ধতিতে পাতা বিন্যস্ত থাকে। পাতার রঙ হালকা সবুজ ও অনেকটা ডিম্বাকৃতির হয়। অঙ্গজ জনন পদ্ধতিতে বংশবিস্তার করে।
ঘ) অ্যারোউইড : বর্ষজীবী এবং আংশিক বা সম্পূর্ণ নিমজ্জিত উদ্ভিদ।, পাতা ধনুকাকৃতির হয়। ফুলের রঙ সাদা ও তিনটি পাঁপড়িবিশিষ্ট। বীজের দ্বারা বংশবিস্তার
করে।
(ঙ) ক্যাবোম্বা বা ওয়াটার স্প্রাইট : পাতা খুব নরম ও মসৃণ প্রকৃতির। পাতার রঙ হাল্কা সবুজ। ফুলের রঙ হলুদ বা হাল্কা লাল। ফুলে ক্ষুদ্র বৃত্ত থাকে। রাইজোম থাকে। অঙ্গজ জনন পদ্ধতিতে বংশবিস্তার করে।
(চ) ইল গ্রাস : জলে নিমজ্জিত উদ্ভিদ। পাতা লম্বা ও ফিতাকৃতির। পাতার রঙ সবুজ ও পাতার অগ্রভাগ জলের ওপরে ভাসে। পুরুষ ও স্ত্রী গাছ পৃথক হয়।
(ছ) ল্যান্স লিফ প্ল্যান্ট : বর্ষজীবী উদ্ভিদ। পাতা নরম ও কাণ্ডের দু‘পাশে পরিবর্ত পদ্ধতিতে বিন্যস্ত থাকে। ফুল ক্ষুদ্রাকার। ফুলের রঙ হলুদ বা সবুজ। অঙ্গজ জনন পদ্ধতিতে বংশবিস্তার করে।
(জ) ওয়াটার মিলিফয়েল : নিমজ্জিত বা আংশিক নিমজ্জিত উদ্ভিদ। পাতা কাণ্ডের দু‘পাশ বরাবর বিন্যস্ত থাকে। অঙ্গজ জনন পদ্ধতিতে বংশবিস্তার করে।
(ঝ) আমাজন সোর্ড : একবীজপত্রী উদ্ভিদ। পাতা ফিতাকৃতির। কাণ্ডের পর্ব থেকে গুচ্ছাকারে পাতা বের হয়। ফুলের রঙ সাদা। বৃত্ত থাকে। মূল মাটিতে আবদ্ধ থাকে।