আমার দেখা একটি বিজ্ঞান প্রদর্শনী
Amar dekha ekti bigyan pradarsani
[ভূমিকা — প্রদর্শনীর স্থান ও বর্ণনা—প্রদর্শনীর বিভিন্ন জিনিসের বর্ণনা – অভিজ্ঞতা ও অভিমত—মেলা প্রদর্শনীর প্রভেদ – উপসংহার]
ভূমিকাঃ মানুষের জীবনধারাকে সহজ ও আরামবহাল করেছে বিজ্ঞানের নব নব অবিষ্কার। বিজ্ঞান আজ মানুষের পরম বন্ধু। বিজ্ঞান—শিল্পে এনেছে এক মহাবিস্ময়কর উন্নতি। এই উন্নতির বিষয় অনেক মানুষ জানতে পারে না। আর জানতে না পারার জন্য সেই সমস্ত বিজ্ঞান সৃষ্ট শিল্প সামগ্রীর ব্যবহার শিখছে না । এই অসুবিধার জন্য প্রয়োজন প্রকাশ ও প্রচার। বিজ্ঞান শিল্পের বিভিন্ন শাখায় চর্ম শিল্প, সূচীশিল্প, হস্তশিল্প, লৌহ ও ইস্পাতশিল্প, বাঁশ, বেত–কাগজশিল্প প্রভৃতিতে যেসব অত্যাশ্চষ আবিষ্কার করেছে তার জনগোচর করার জন্যই প্রয়োজন প্রচারের। এই প্রচার কাগজে—মাইক্রোফোনের ঘোষণায় কিছটা হয়। কিন্তু সবচেয়ে বেশী হয় যদি এইসব আবিষ্কারের কিছু, মডেল জনসাধারণকে চাক্ষুষ দেখানোর ব্যবস্থা করা যায় কোন নির্দিষ্ট স্থানে। এই ব্যবস্থার নাম প্রদর্শনী। এরূপ এক বিজ্ঞান প্রদর্শনী দেখার সুযোগ হয়েছিল কিছুদিন আগে। তার কথাই জানাবার ইচ্ছা জাগছে বা আছে। সুযোগও পেয়ে গেছি।
প্রদর্শনীর স্থান ও বর্ণনাঃ দেখা ও দেখান প্রদর্শনীর মস্তবড় কাজ । এর মাধ্যমে যে প্রচার কাজটি হয় তার ব্যাপ্তি ও গুরুত্ব অনেক বেশী। ব্যবসায়িক স্বার্থে‘র কথা যদিও এর এক উল্লেখযোগ্য বিষয়, তবুও শিক্ষা অভিজ্ঞতা ও মনোরঞ্জনের দিকটা খুব কম নয় । এইটাই পেয়েছিলাম আমাদের বাড়ী থেকে মাইল পাঁচেক দূরে এক বিজ্ঞান প্রদর্শনীতে। একটা গোটা ফুটবল মাঠ জুড়ে আয়োজন হয়ে ছিল এই প্রদর্শনীর, গ্রামের পরিবেশ—শহরের মানুষ কিভাবে নেবে জানিনা। তবুও এটা ঠিক, আয়োজকরা স্থানটি বেছেছিলেন ভালই । বাম পাশে প্রশস্ত বাস রাস্তা — ডান পাশে কৃষিপল্লী — সামনে উদার মাঠ আর পিছনে মৃদ স্রোতা এক অখ্যাত শাখা নদী। নদী না বলে খাল বলাই ভাল ।
পরিচ্ছন্ন প্রশান্ত পরিবেশের ছত্রছায়ায় মাঠের মাঝে ত্রিপলবেষ্টিত বিশাল প্যাণ্ডেলের নীচে বিজ্ঞান শিল্পকর্ম ও তার প্রদর্শনের যে বিশাল আয়োজন করা ” হয়েছিল তা সত্যিই বিস্ময়ের। গ্রামের সাধারণ মানুষ মাসাবধিকাল এই প্রদর্শনী দেখে অপার আনন্দ ও অভিজ্ঞতা লাভ করেছিল। আয়োজক সংস্থার সভ্যবৃন্দ গ্রামের মানুষের হস্তশিল্পের দ্রব্য থেকে শুরু করে গভর্নমেন্টের বিভিন্ন শিল্পের ও বেসরকারী বিভিন্ন শিল্পের বড় বড় ও ছোট ছোট বিভিন্ন দ্রব্যের সমাবেশ করেছিলেন। আর সেগুলি ভালভাবে দর্শকদের বুঝিয়ে দেবার জন্য উপযুক্ত শিক্ষণ প্রাপ্ত গাইডেরও ব্যবস্থা করেছিলেন ।
প্রদর্শনীর বিভিন্ন জিনিষের বর্ণ নাঃ প্রদর্শনীটা বিজ্ঞান বিষয়ের জন্য বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের বিভিন্ন দ্রব্যাদির সমাবেশ সেখানে হয়েছিল। পরিষ্কার দুটি ভাগে প্রদর্শনীর বিশাল মণ্ডপটি ভাগ করা হয়েছিল। একদিকে কুটির বা ছোট শিল্পের প্রদর্শনীর দোকান, অন্য দিকে বৃহৎ শিল্প অর্থাৎ হেভি ইন্ডাস্ট্রি, মেশিন ও যন্ত্রপাতির প্রদর্শনীর দোকান। প্রদর্শনীতে আছে ছোট—মাঝারি—বড় নানা আকারের আরও অনেক স্টল। মাত্র এক মাসের জন্য এই প্রদর্শনীর ব্যবস্থা হলেও বেশ পরিপাটি করে সাজানো হয়েছিল এখানের স্টলগুলি। স্টলগুলিতে ক্ষুদ্র শিল্পের মিনি জেনারেটর, স্পিনিং মেশিন, সেলাই কল, পাম্পিং মেশিন প্রভৃতির সমাবেশ হয়েছে ৷ এক একটা এলাকা নিয়ে একজন করে গাইড প্রতিটি দ্রব্যের বিশেষ গুণাগুণে, ব্যবহারের সুবিধার বিষয় মুখে মুখে উপদেশ ও কৌশল শিক্ষা দিচ্ছেন। এই সব গাইড নিজেরা দক্ষ কারিগরও বটে। অনেক লোক আগ্রহ সহকারে তাঁদের কথা শুনছে ও নানাবিধ প্রশ্নও করছে। বিশেষ বিশেষ দ্রব্যাদি শহরের কোথায় পাওয়া যাবে তাও দর্শকেরা জেনে নিচ্ছে। ধারে বা নগদে বা ইনস্টলমেন্টে কেনার সুবিধা আছে কিনা তাও জেনে নিচ্ছে। অন্যদিকে বৃহদায়তন শিল্পের যন্ত্রপাতির স্টলগুলিতে বড় মেশিন, বড় জেনারেটর, বড় পাম্পিংসেট এবং আরও নানান জিনিষ । ঐ সব যন্ত্রের ব্যবহার, মূল্য, কার্যকারিতা, উৎপাদন ব্যবস্থা, মেরামতির সুযোগ প্রভৃতি নানান উপদেশ পরামর্শ ও শিক্ষার ব্যবস্থা কোথায় কিভাবে হচ্ছে তাও স্টল গুলিতে বলে দেওয়া হচ্ছে। আগের দিনের “লিস্টার মেশিন”, বর্তমানকালের “কিলোস্কার মেশিনের” বিবরণ আমার খুব ভাল লেগেছিল। পশ্চিম বাংলা তথা ভারতের বিভিন্ন স্থানে নির্মিত নানা বিজ্ঞানের দানে সৃষ্ট যন্ত্রপাতির বিপল সমাগমের ব্যবস্থা যেভাবে প্রদর্শনী কর্তৃপক্ষ করেছেন তা ভাবলে অবাক মনে হয় ।
অভিজ্ঞতা ও অভিমতঃ এই প্রদর্শনী দেখে নানা লোক নানা মন্তব্য করেছে। কিন্তু আমার মনে হয় এই প্রকারের শিল্প প্রদর্শনী গ্রামাঞ্চলের শিক্ষক–ছাত্র, অভিভাবক সর্বস্তরের মানুষের নানান উপকার করতে ও শিক্ষা দিতে পারে। সেই কারণে মাসাধিককালের এই প্রদর্শনী সাধারণ লোক শেষ দিনটি পর্যন্ত সমান আগ্রহে দেখেছে । শহরে প্রায়ই এই প্রকার প্রদর্শনীর ব্যবস্থা এখানে সেখানে হলেও গ্রামে এর ব্যবস্থা করা খুবেই অসুবিধাজনক।
মেলা ও প্রদর্শনীর প্রভেদঃ প্রদর্শনীতে মেলার মত বহু লোকের আসা–যাওয়া হলেও মেলা ও প্রদর্শনী এক জিনিষ নয় কখনই। এখানে আদর্শগত ও অঙ্গিকগত যথেষ্ট পার্থক্য আছে। মেলার একটা সার্বজননীরূপ আছে। প্রদর্শনীর মতও এখানে প্রচার কাজ, শিক্ষাদান কাজ চলে । কিন্তু সেটা প্রধান নয়। প্রদর্শনীর মুখ্য বিষয় একটা সামনে থাকে ৷ একটা নতুন চিন্তা, নতুন বিষয় বড় করে দেখানো এবং লোকচক্ষুর সামনে তুলে ধরার প্রয়াস তার মধ্যে আছে । মেলায় আবেগ ও উচ্ছাস বেশী। নিছক আনন্দ ও প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি কেনার আগ্রহ বেশী। প্রদর্শনীতে বিশেষ উদ্দেশ্য সামনে থাকে, তাই উচ্ছাস বিহীন এবং শান্ত সংহত তার রূপ ।
উপসংহারঃ প্রদর্শনী গুরুত্ব ও উপকারিতা অনেক বেশী। একে হালকাভাবে কখনই দেখা উচিত নয়। জাতি ও সমাজজীবনের উপকারে যা লাগবে, যাতে ভার শ্রীবৃদ্ধিসাধন, জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার বৃদ্ধি হবে সেই দিক লক্ষ্য রেখে প্রদর্শনীর ব্যবস্থা হওয়া উচিত। পরোতন যন্ত্র পরোতন শিল্প দ্রব্য ব্যবহারের অসুবিধা ও নতুন যন্ত্রপাতি ব্যবহারের সুবিধা কোথায় তা সহজেই এই প্রকার প্রদর্শনীর দ্বারা দেখানো যেতে পারে । গ্রামাঞ্চলের বহুলোক এর দ্বারা উপকৃত হবে।