ঐতিহাসিক স্থানে ভ্রমণ– (পুরী)
Aitihasik sthane bhramaṇ-(Puri)
[ভূমিকা –উড়িষ্যার উত্থান ও পতন—পরীতে গন – পরীর চারিদিকের পরিচয়–পরীর মন্দির—ভ্রমণের শিক্ষা ও আনন্দ–উপসংহার ]
ভূমিকাঃ মানুষ ভ্রমণ পিয়াসী। নতুন দেশ, নতুন মানুষ, নতুন দৃশ্যে দেখার ইচ্ছা মানুষের চিরকালের। অজানাকে জানার আকাঙ্ক্ষায় মানুষ তাই ছিটকে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে। অচেনাকে চিনতে মানুষ শত শত মাইল পাড়ি দেয় স্থলে– অন্তরীক্ষে। এই যাওয়ার বিরাম তার নেই। একবার যে বাইরে বের হয়েছে অচেনার টানে—আর তাকে ঘরে রাখে কে? বার বার বাইরে বের হবার নেশা তাকে পেয়ে বসে। আজ থেকে ঠিক দুইবছর আগে অমনই এক নেশার টানে বাইরে বেরিয়ে পড়েছিলাম । স্থানটি একই সঙ্গে ঐতিহাসিক ও সৌন্দর্য রসিক মানুষের মনকে ভরিয়ে দেয় জ্ঞানে ও আনন্দে। স্থানটির নাম পুরী। পরী ভ্রমণের সুযোগ এল গরমের ছনটিতে । বাড়ীর লোকজনের সাথে ভ্রমণের সেই প্রথম সুযোগ ৷ সঙ্গে বাবা মা দাদা ও ঠাকুমা ৷ আমাকে নিয়ে পাঁচজন ।
উড়িষ্যার উত্থান ও পতনের কাহিনীঃ ইতিহাস এগিয়ে চলে। একটা ঘটনা ঘটে । রেখে যায় তার প্রতিশ্রুতি অন্য একটা ঘটনা ঘটাবার জন্য । তাই উড়িষ্যার কাহিনী অর্থাৎ উত্থান পতনের কাহিনী বড় রোমাঞ্চকর, বড় আকর্ষণীয়। কলিঙ্গ যুদ্ধে অশোকের বিজয়ের কাহিনী সবাই জানে ৷ চন্দ্রগুপ্ত মৌর্ষে‘র উড়িষ্যা জয়ের প্রবল ইচ্ছা ছিল। ভবনেশ্বর থেকে মাইল পাঁচেক দূরে ধৌলগিরিতে আজও সম্রাট অশোকের রাজাজ্ঞার বিষয় পাথরের গায়ে খোদিত আছে । বৌদ্ধধর্মে‘র প্রভাব, জৈন– ধর্মে‘র প্রভাব, বাংলার রাজা শশাংক, হর্ষ বর্ধন সবার লক্ষ্যবস্তু হয়েছিল উড়িষ্যা তথা উৎকল দেশ। চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ–এর বিবরণী উড়িষ্যার উত্থান– পতনের অনেক কথাই আমাদের উপহার দেয়। উড়িষ্যার শেষ হিন্দু রাজা মুকুন্দ দেব কালা পাহাড়ের কাছে পরাজিত হবার পর উড়িষ্যায় আতংকের দিন ঘনিয়ে আসে। কালা পাহাড় কোণারকের সার্যমন্দির অপবিত্র করে। আফগান মোঘল ও শেষে বৃটিশের আক্রমণে উড়িষ্যার প্রাণপুরুষ তিতিবিরক্ত ও লাঞ্ছিত হয়েছে কতবার—ইতিহাস তার সাক্ষী। এর পর এল স্বাধীনতার বছর। ১৯৪৭ সালের পর উড়িষ্যার রাজধানী হল ভবনেশ্বর । নতুন রাজধানী। ভুবনেশ্বর পেল নতুন মর্যাদা। পুরানো রাজধানী কটক হোল পরিত্যক্ত, অবহেলিত ।
পুরী গমনঃ ইতিহাসের কতশত কাহিনীর, লক্ষ লক্ষ ধর্ম প্রাণ মানষের পণ্যে অর্জনের আর সৌন্দর্য পিয়াসী সৌন্দর্য আহরণের উপযুক্ত ও সার্থক স্থান পুরী ভ্রমণের সুযোগ পেয়ে মন আনন্দে উদ্বেল হয়ে উঠল । ঠিক একমাস দশদিন পূর্বেই আমাদের রিজার্ভেশন পর্ব শেষ হয়। দক্ষিণ–পূর্বে রেলের প্রধান এবং পৃথিবীর বিখ্যাত হাওড়া ১৪নং প্ল্যাটফরম থেকে রাত ৮টা ১৫মিঃ এ পুরী এক্সপ্রেস আমাদের নিয়ে হাওড়া স্টেশন ত্যাগ করল। রাতের ট্রেনে ভ্রমণের প্রথম সুযোগ অনাবিল আনন্দে মন ভরিয়ে দিল। রেলের ঘর্ষণের খটাখট শব্দ, তীব্র গতির ঝাঁকুনি, নাম না জানা স্টেশনের আলো রাশির ঝলকানির মধ্যে দিয়ে কাটিয়ে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি জানি নি। শেষে ভোরে মহানন্দা ব্রীজের ধীর গতি গাড়ীর শান্ত স্বভাব অবাক করে জাগ্রত ছিল যারা তাদের। দাদা ভোরের মহানন্দার অপরূপ রূপ দেখবার জন্য এক ধাক্কায় আমাকে ডেকে তুলল । দুচোখ মিলবার সাথেই ট্রেনের গতি বাড়ল এবং ঘণ্টা খানেকের মধ্যে প্রায় সওয়া সাতটার কাছাকাছি সময়ে আমরা পুরী স্টেশনে পৌঁছে গেলাম । পরে রিকশায় স্বর্গদ্বারের কাছে যেতে যেতে সমদ্রের গুরু গম্ভীর গর্জন আমার মনকে অজানা আনন্দে ভরিয়ে তুলল ।
পুরীর চারিদিকের পরিচয়ঃ পুরী পোঁছেই অনেক চেষ্টায় স্বর্গদ্বারের কাছেই বিনোদিনী হোটেলে একটা ঘর পেলাম । কিছু গোছগাছের পরেই সমদ্র দেখার জন্য সবাই বেরিয়ে এলাম । স্নানও সারা হোল। হোটেলে খাওয়া সেরে একটা বিশ্রাম নিয়ে পুরীর আশপাশের এলাকা দেখার জন্য তিনটা রিকশায় বোরয়ে পড়লাম বিকাল ৪টায়। সূর্যয়ের পড়ন্ত আলোর ঝাঁঝ তখনো কমেনি। পুরীর চারপাশের উল্লেখযোগ্য স্থান মাসীর বাড়ীর গুণ্ডিকাবাড়ি, বিদুর পুরী আঠার নালা, লোকনাথ মন্দির, শ্বেতগঙ্গা, যশেশ্বর প্রভৃতি। পরের দিনের জন্য রইল প্রধান আকর্ষণ পুরীর মন্দির ।
পুরীর মন্দিরঃ পরদিন সকাল সাতটায় সমদ্রস্নান সেরে সদলবলে আমরা পারীর মন্দিরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম। মন্দির সংলগ্ন এলাকায় গিয়ে পাগড়ি খোলা উচ্চতার বিশাল মন্দির দেখে, অবাক হলাম । নির্দিষ্ট স্থানে জুতো চামড়ার জিনিস গচ্ছিত রেখে আনন্দও বিস্ময় নিয়ে এপাশ ওপাশ দেখতে দেখতে আমরা এগতে লাগলাম । শ্লেট রং এর পাথরের সি*ড়ি বেয়ে আমরা মূল মন্দির এলাকার চত্বরে পৌঁছতেই এক পাণ্ডার খপ্পরে পড়লাম । যথাসাধ্য পূজা দিয়ে পাণ্ডার সাহায্যে দ্বারুব্রহ্মা নারায়ণ শ্রীজগন্নাথ দর্শন সে এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা । চারপাশে চারটি দ্বার অর্থাৎতোরণ। সিংহদ্বার, হস্তীদ্বার, অশ্বদ্বার ও খাঞ্জাদ্বার । মুল মন্দিরের রত্নবেদীতে জগন্নাথদেব, সুভদ্রা ও বলভদ্র। এঁদের পাশে সুদর্শন চক্র। রামের বামে সোনার লক্ষ্মী, ডানে রূপার সরস্বতী এবং পিছনে নীলমাধব । অন্ধকার গোলকধাঁধার পথে দেবতার চারপাশ প্রদক্ষিণ পাণ্ডার হাত ধরে সে এক ভয়ঙ্কর সুন্দর অভিজ্ঞতা।
ভ্রমণের শিক্ষা ও আনন্দলঃ দেশভ্রমণ মানুষের মনকে উদার ও প্রশস্ত করে অভিজ্ঞতা বৃদ্ধি করে ও জ্ঞানের পরিপক্কতা আনে। তার সাথে আছে সীমাহীন আনন্দ। পুরীর স্থানীয় লোকদের জীবনযাত্রা, বিশেষ করে মন্দির যাবার পথের দুধারে পা–ফোলা অগুনতি ভিখারীর সমাবেশে পুরীর সাধারণ মানুষের দৈন্যতাকে প্রকট করে তোলে। পুরীর মন্দিরের কারুকার্য দেখার মত। পাথরের গায়ে আঁচড় কেটে মানষ কি জীবত সব মূর্তি তৈরী করেছে তা না দেখলে ভাষায় বোঝান যায় না ।
উপসংহারঃ পুরী ইতিহাস প্রসিদ্ধ স্থান। শ্রীশ্রীগৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর পূণ্য পরশ এখানের মাটিতে আছে। সেই ছোঁয়া পাবার একান্ত বাসনা মনের মাঝে উঁকি দিত মাঝে মাঝে। সে বছরের গরমের ছুটি সে সংযোগ করে দিয়েছিল। স্বর্গদ্বারের কাছে বঙ্গোপসাগরের সফেন নীল বারি রাশি, তার মুহুর্মুহু ভয়ঙ্কর গর্জন, অপরূপ তরঙ্গলীলা সব মিলিয়ে পূরীর আকর্ষণ অনির্বচনীয়। বার বার দেখলেও ‘পরী‘ দেখার ক্ষুধা যেন মিটতে চায় না ।