বিজ্ঞানের জয়যাত্রা ও মানুষের ভবিষ্যৎ
Bigyaner jayayatra o manuser bhabisyat
[ ভূমিকা (বিজ্ঞান ও সভ্যতা) – বিজ্ঞানের জয়যাত্রা ও সভ্যতার অগ্রগতি— বিজ্ঞানীর সাধনা, সত্যসন্ধানে আত্মত্যাগ– বিজ্ঞানশক্তি ও রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ–বিজ্ঞান শক্তির পরস্পর বিরোধী চিত্ররূপ–বিজ্ঞানীর সত্যানুসন্ধান, পরহিতব্রত – বিজ্ঞানের অগ্রগতির দুটি প্রধান দিক—উপসংহার ]
ভূমিকাঃ ( বিজ্ঞান ও সভ্যতা ) – বিজ্ঞান সভ্যতার বাহন। প্রাগৈতিহাসিক যুগে, যখন মানুষ নিজ বাহুবলে শিকার করে জীবনধারণ করত, তখনকার কথা বাদ দিলে আমরা দেখি, যেদিন থেকে মানুষ আগুন জ্বালাতে শিখল, ঠিক সেদিন থেকেই বিজ্ঞান মানব সভ্যতার চালক হয়ে গেল। বর্তমান সভ্যতা মানুষের বহু শতাব্দীর স্বপ্ন ও সাধনার ক্রমপরিণাম। মানুষ তার যুগ–যুগান্তরের স্বপ্ন ও সাধনার অনবদ্য ফসল দিয়ে গড়ে তুলেছে সভ্যতার এই বিশাল ইমারত । সে সভ্যতার ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে তার বাহুর শক্তি, মস্তিষ্কের বুদ্ধি, ইন্দ্রিয়ের আনুভূতি আর হৃদয়ের ভালোবাসা দিয়ে। আধুনিক বিজ্ঞান মানুষের অতন্ত্র সাধনার পরিণাম ৷ বলাবাহলো বলাবাহুল্য, মানুষের সভ্যতার এই উন্নতির মূলে আছে বিজ্ঞানের অপরিসীম বিস্ময় ।
বিজ্ঞানের জয়যাত্রা ও সভ্যতার অগ্রগতিঃ আজ পৃথিবীতে বিজ্ঞান দুর্জয়রূপে প্রতীত হলেও তার সূচনা হয়েছিল অত্যাত দীনহীনভাবে। সর্বত্যাগী জ্ঞান– তপস্বীদের যুগে–যুগান্তরের সাধনায় বিজ্ঞান রূপকথার দৈত্যপুরী থেকে এনেছে সোনার কাঠি আর রূপার কাঠি। তারই ব্যবহারে সভ্যতার প্রত্যুষ লগ্নের সেই মানুষ আজ অমিত শক্তিধর। সেদিনের সেই অরণ্যচারী মানুষ, গুহাবাসী মানুষ আকাশের মেঘ–বৃষ্টি দেখলে ভয় পেত। সর্যগ্রহণ, চন্দ্রগ্রহণ, ধমকেতু এসব ছিল বিভীষিকা। আজ মানুষ বিজ্ঞানের বলে বলীয়ান হয়ে সেই মেঘ থেকে কৃত্রিম– ভাবে জল ঝরাচ্ছে, বিদ্যুৎকে করেছে পদানত । যে অহল্যাভুমি গুল্ম–ক্যাকটাসের আবাসস্থল ছিল, তাতে আজ শষ্য উৎপন্ন হচ্ছে । যে উচ্ছৃঙ্খল নদী, বছরের পর বছর মানুষের দুর্দশার কারণ ছিল, তা আজ হয়েছে সবার্থ সাধক এক একটি প্রকল্পের সার্থক জন্মদাত্রী। ঊষর মরু হয়েছে জলসিক্ত, ভূগর্ভের শষ্য সম্ভবনা হয়েছে সার্থক। হয়েছে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প। অন্যদিকে মানুষের জীবনযাত্রার উপর একটা বিরাট প্রভাব পড়েছে। মানুষের গড় পরমায়, বেড়ে গেছে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের বিস্ময়কর উন্নতির একটি প্রসিদ্ধ উদাহরণ মৃত্যুহার বৃদ্ধি রোধ। পারিপার্শ্বিক জগত সম্বন্ধে মানুষ আজ অনেক বেশী পরিচিত। এই বিশ্বে আমরা কি নিঃসঙ্গ ? এই জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে আজ ভয়েজার ছুটে চলেছে অতহীন যাত্রাপথে।যন্ত্রগণক লক্ষ লক্ষ আঙ্কিক গণনা কয়েক মুহূর্তে সম্পন্ন করে শ্রম–শক্তির অপচয় রোধ করছে। আজ আমরা কতটা এগিয়েছি এটা বুঝতে গেলে মাথাটা একবার ঝাঁকিয়ে নিতে হয়। এই উৎকর্ষের শেষ কি আমরা দেখতে পাব ?
বিজ্ঞানের সাধনা, সত্যসন্ধানে আত্মত্যাগঃ আজকের এই সাফল্য ও আগামী দিনের সম্ভাবনা কি হঠাৎ সংঘটিত হবার জিনিস? এর উত্তর খুজতে গেলে আমরা দেখতে পাই শত শত, হাজার হাজার বছর আগেও বিজ্ঞানীরা সত্য অনুসন্ধানে ব্যাপৃত। সামাজিক সংস্কার, ধর্মীয় হস্তক্ষেপ তাঁদের লব্ধ সাফল্যকে চিরকাল বাধা দিয়ে এসেছে। তাঁদের প্রাণসংশয়ও হয়েছে। কিন্তু তাঁরা সত্য থেকে বিচ্যুত হননি। ব্রুনোকে মারা হয়েছিল আগুনে পাড়িয়ে, ল্যাভরসিয়ারকে গিলোটিনে; সক্রেটিসের বিষপান, গ্যালিলওর কারাবরণ, এসব অজস্র উদাহরণ । বিজ্ঞান সাধনায় মগ্ন বিজ্ঞানী টমাস আলভা এডিসনের বাসস্থল রেলের পরিত্যক্ত বগি সামান্য ভুলে অগ্নিদগ্ধ হওয়ায়, আশ্রয়দাতা স্টেশন মাস্টার ক্রুদ্ধ হয়ে তাঁকে প্রহার করেন, তাতেই তিনি চিরকালের জন্যে বধির হয়ে যান। তন্ময় আর্কিমিদিস বিপক্ষ সেনাদলের উপস্থিতির প্রতি মনোযোগ না দেওয়ায় তরবারির আঘাতে তাঁর দেহ খণ্ডবিখণ্ড হয়েছিল। তাঁদের এই অনুসন্ধান ব্যক্তিগত লাভ লোকসানের উদ্ধে ছিল। আইভান পাভলভ না খেয়ে গবেষণার জিনিসপত্র কিনতেন, নিউটনের খাবার যেত ডায়মণ্ডের পেটে। এইভাবেই তাঁরা গাণিতিক সূত্র, সংজ্ঞা রচনা করে গেছেন, যার ওপর নির্ভর করে আজকের তথাকথিত আধুনিক বিজ্ঞান এগিয়ে চলেছে ।
বিজ্ঞান শক্তি ও রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপঃ বিজ্ঞান ও রাজনীতি সম্পূর্ণ আলাদা দুটি দিক। কিন্তু যেদিন থেকে রাজনীতির কর্তৃত্বে বিজ্ঞানের ওপর প্রসারিত হল সেদিন থেকেই মানব–সভ্যতা এক ভয়াবহ সমস্যার সম্মুখীন হল । সত্য সর্বত্রগামী । দেশ–কাল‘ পাত্র–পাত্রী বিচার না করেই বিজ্ঞান সব মানুষের গোচরে এসেছে, কিন্তু আজ রাষ্ট্রক্ষমতার শক্তিবিধানে গবেষণার ক্ষেত্র হয়েছে সঙ্কীর্ণ। তাই একই গবেষণা চলছে দেশে দেশে, ফল লাভ করেছে অর্থ বলে বলীয়ান দেশ, আর ফলশ্রুতি অপর রাষ্ট্রের ওপর প্রভাব খাটানোর সংযোগ। কিন্তু, বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানীরা যদি একসঙ্গে গবেষণা করার সুযোগ পান তাহলে সময় লাঘব হয়, সঙ্গে সঙ্গে ত্রুটি বিচ্যূতির সম্ভবনা কমে যায়। অন্যদিকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধন বাধা প্রাপ্ত হয়, তাই দেশে দেশে চলেছে একক গবেষণা । অত্যন্ত বুদ্ধিমান এই প্রাণীটি কি বোকা? নিজেকে ধ্বংস করার মারণ–যজ্ঞ চলেছে বছরের পর বছর। যার হোতা ঐ নির্বুদ্ধি রজনীতিকরা। ইতিহাস পুনরাবৃত্ত হয়‘ । এতো অভিজ্ঞতাই বলে । ধ্বংস হয়েছিলেন হিটলার, শেষ হয়েছিল অত্যাচারী জার শাসনতন্ত্র বলশেভিকদের তলোয়ারে, ধ্বংস হয়েছে ফ্রান্সের অত্যাচারী রাজতন্ত্র। বিজ্ঞানকে সাম্রাজ্যবাদের হাতিয়ার করলে ভবিষ্যতে ক্ষমতালিপশু, জাতিগালিও রক্ষা পাবে না। পৃথিবীতে বর্তমান মজুত পারমাণবিক অস্ত্রের সামান্য ভগ্নাংশ ব্যবহার করলে সুন্দর ও একমাত্র সজীব এই পৃথিবী মাত্র কয়েক মিনিটে ধ্বংস হয়ে ধুলোয় পরিণত হয়ে এর জন্যে দায়ী তো বিজ্ঞান নয়। বিজ্ঞান শক্তির অপপ্রয়োগই এর জন্যে দায়ী। পৃথিবীর কোটি কোটি নিরন্ন অসহায় মানুষ আজ বাঁচার আনন্দ উপলব্ধি করতে যদি পারে তবেই ক্ষমতার লোভ দূরে হয়।
বিজ্ঞান শক্তির পরস্পর–বিরোধী চিত্ররূপঃ বিজ্ঞান কিন্তু শুধু ধ্বংসের খেলায় মেতে নেই । তার মধ্যে আছে সুস্থ, সুন্দর জীবনধারণের আকাঙ্কা। তাই ডঃ শেঠির মত ব্যক্তি এগিয়ে এসেছেন প্রতিবন্দীদের আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে, তাঁদের দিয়েছেন আধুনিকভাবে প্রস্তুত কৃত্রিম অঙ্গ–প্রত্যঙ্গ। সামান্য ম্যাগসেসে পুরস্কার তাঁর এই প্রচেষ্টার স্বীকৃতি মাত্র ।
একদিকে পারমাণবিক বোমায় হিরোশিমা–নাগাসাকির মানষদের মৃত্যু, অন্য–দিকে মুমূর্ষু, অসহায় মানুষকে বাঁচিয়ে তুলতে আলেকজান্ডার ফোমিং–এর পেনিসিলিন আবিস্কার । যে পারমাণবিক গবেষণা মারণাস্ত্র প্রস্তুতে নিয়োজিত, সেই গবেষণারই ফসল তেজষ্ক্রিয় চিকিৎসা। সুস্থ হচ্ছেন ক্যান্সার রোগাক্রান্ত ব্যক্তি তারই বলে। বিস্ফোরক টি. এন. টি‘র স্রষ্টা আলফ্রেড নোবেলের টাকায় শান্তির জন্যে দেওয়া হচ্ছে নোবেল পুরস্কার, পাচ্ছেন বিজ্ঞানীরাও মানবকল্যাণে তাঁদের অবদানের জন্যে। কি অদ্ভুত বৈসাদৃশ্যে ।
বিজ্ঞানীরা সত্যনুসন্ধান ও পরহিব্রতঃ প্রত্যেক বিজ্ঞানীরই সাধনা গড়বার, ধ্বংসের নয় মুঢ়তা সেখানে রাজনীতিকের। অক্লান্ত গবেষণার ফসল শুধু নিজের সঙ্কীর্ণ পরিমণ্ডলে ভোগের প্রবণতা কোনোকালেই বিজ্ঞানীদের ছিল না । তাই মাইকেল ফ্যারাডে বিদ্যুৎশক্তি শুধু নিজের প্রয়োজনে কাজে লাগাব একথা বলেন নি, আলভা এডিসন বলেননি বৈদ্যুতিক আলো শুধু আমার ঘরটিরই জন্যে। বরং উল্টো কথাটাই ওরা বলেছেন। নিজেদের জানা সত্যকে সকলের কল্যাণে প্রয়োগ করতে দিয়েছেন। তাই জীবাণু সংক্রমণে সারা পৃথিবীর মানুষ পেনিসিলিন নেয় । আজ আমরা ইচ্ছে করলেই বেতারগ্রাহক যন্ত্র ঘরে তৈরী করতে পারি। জগদীশ বসু বা মার্কনি কোনো বিধিনিষেধ আরোপ করেন নি। পরহিতব্রতের এর চেয়ে বড় উদাহরণ আর কি ?
বিজ্ঞানের অগ্রগতির দুটি প্রধান দিকঃ আজকের বিজ্ঞান সাধনার দুটি প্রধান প্রকাশ হল মহাকাশ গবেষণা ও পারমাণবিক গবেষণা। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বস্তুকণা পরমাণুও যে ভাঙা যায়, এ সত্য যেদিন থেকে মানুষের গোচরে এসেছে, সেদিনই বিজ্ঞান জগতে এক বিশেষ পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। পরমাণ, ভাঙার ফলে যে বিশাল শক্তির উৎপত্তি হবার খবর বিজ্ঞানীদের হস্তগত, তা আমাদের জানিয়ে দিচ্ছে, আমাদের প্রচলিত জীবাশ্ম জানালানীর ওপর ভবিষ্যতে আর নির্ভর করতে হবে না। কারণ এটা অবশ্যই চিন্তার কথা যে, সঞ্চিত পেট্রোলিয়ামে আর পচিশ বছর ও কয়লায় শ–দই বছর চলতে পারে। অতএব পারমাণবিক গবেষণার মাধ্যমে সেই ঘাটতি রোধ করা যাবে। আর মহাকাশ গবেষণা এখন শুধু অনুসন্ধিৎসু মনের খোরাকই যোগায় না। এর ফলে আমরা আবহাওয়া সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে পারি। জৈব রাসায়নিক পরীক্ষা যা মাধ্যাকর্ষণের প্রভাবে ব্যাহত হয়, তা মহাকাশে সংঘটিত করে মানব কল্যাণে নিয়োজিত হচ্ছে। যে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপ আমাদের চিন্তিত করছে, তা লাঘব হবে আগামী শতাব্দীতে মানুষের চাঁদে বসবাসের মাধ্যমে। এগুলো কল্পনা নয়। মানষ দশ লক্ষ টাকা গাড়ী ভাড়া দিয়ে মহাকাশ পর্যবেক্ষণ করে পৃথিবীতে ফিরে আসবে। এর জন্যে বিরাট এক প্রকল্পে হাত দিয়েছে আমেরিকা যাক্তরাষ্ট্র। মহাকাশ গবেষণা আমাদের শখে, কৌতূহল নিবৃত্ত না করে অসংখ্য উপকারে আসবে। বহু, খনিজ প্রাকৃতিক উপকরণ যা মূল্যবান অথচ দপ্রাপ্য, তা পৃথিবীতে আনা যাবে ভিনগ্রহ থেকে।
উপসংহারঃ বিভিন্ন দেশে মহাকাশ গবেষণার এই যে বিপুল খরচ তাকে আমাদের অপব্যবহার বলা উচিত নয়। এই পৃথিবীতে যে শষ্য সম্পদ উৎপন হয়, তার সুষম বণ্টন যদি সম্ভব হতো, তাহলে ইথিওপিয়ার দুর্ভিক্ষ আমাদের পীড়িত করত না। পৃথিবীতে যে পরিমাণ শষ্য মজুত আছে তাতে সমগ্র তৃতীয় বিশ্বকে খাদ্যে স্বয়ম্ভর করে ফেলা যেত। কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে আমাদের সঙ্কীর্ণ মনোভাব। যেখানে কাজ করছে উগ্র জাতীয়তাবাদ, সঙ্কীর্ণ প্রাদেশিকতা– বাদ, নিকৃষ্ট ধর্মান্ধতা, সর্বোপরি ব্যক্তিগত হিংসা ও দ্বেষ। বিজ্ঞান আজ আমাদের দুহাত ভরে অনেক কিছু দিয়েছে, আরো দেবে। কিন্তু তার যদি সুষম বণ্টন, নিদেনপক্ষে কল্যাণকর কার্যে ব্যবহারের প্রয়াস না দেখা যায়, তাহলে বুদ্ধিমান প্রাণী হিসেবে আমরা মহাকালের কাছে কি কৈফিয়ৎ দেব ?
ফিরেযাই আমাদের নির্বাচিত রচনার তালিকাতে