ফেলে আসা বিদ্যালয়ের দিন
Phele asa bidyalayer din rochona bengali
[ ভূমিকা—স্কুল জীবন ও তার প্রভাব—নানা ঘটনা ও বিশেষ পাওয়া —বিদায় লগ্নে বিশেষ অনুভতি — উপসংহার ]
ভূমিকাঃ মানুষের জীবন–পথ পরিক্রমায় কত না পরিবর্তন। নদীর মত বাঁক আর বৈচিত্রহীন জীবন তো নেয় বারবার নতুন পথে।—বৈচিত্র তো সেইখানেই ! মরুভূমি জীবন। নানা ছন্দ, গতি আর মিলের সমবায়ে এগিয়ে চলে জীবনের চলার পথ। কত সকরুণ বীণার সুর তাকে করে অশ্রু সজল ; আবার কত আনন্দের স্রোত জীবন পাত্রকে ভরিয়ে তোলে কানায় কানায়।“কান্না হাসির দোল দোলান” জীবনই তো জীবন । যা চলে যায় তা কখনও চিরকালের মত হারিয়ে যায় না। শুধু, আবরণে ঢাকা পড়ে মাত্র । তার, অস্তিত্ব থাকে অন্তরালে। রাতের সব তারাই তো দিনের আলোর গভীরে রয়ে যায়। ‘কি পাইনি‘র হিসাব যেমন সেখানে আনে ব্যথার বেহাগ ; তেমনি হাসি–কান্নার হীরে–পান্নাতো থাকে স্মৃতির ভালে। তাই পিছনের ‘আমিটা’ বারবার ডাক দেয়—চলে স্মৃতি রোমন্হন। এই স্মৃতি–সুধায় ভরা জীবন–পাত্র মানব জীবনের পরম আদরের ধন । তাকে ধরে রাখতে হয় সোহাগে–আদরে ।
স্কুল জীবন ও তার প্রভাবঃ সংদীর্ঘ দশ বছর যেখানে চলেছে ভবিষ্যৎ তৈরীর প্রস্তুতি, আজ সেই স্কুল ছেড়ে আসতে হচ্ছে। যদিও শুরু, হবে নতুন পথ– পরিক্রমা, তবুও ভুলতে পারছি না শৈশবে, বাল্য কৈশোরের বহু স্মৃতি বিজড়িত ইস্কুলকে । বার বার সে হাতছানি দিয়ে ডাকে, আর চোখ দুটোকে ঝাপসা করে দিয়ে যায় । সেই কবে প্রথম শ্রেণীতে মায়ের হাত ধরে ঢুকেছিলাম ইস্কুলের চার দেওয়ালের মধ্যে ; তার পর কত দিনের কত স্রোত চলে গেল । পরিবর্তনের কত না দখিনা বাতাস লেগেছে জীবনের পালে । কত না খুসির তুফান উঠেছে আমার ছোট্ট জীবনে । আনন্দ আমায় করেছে আবিল। আবার যখন ব্যথা এনে দিয়েছে হতাশ‘, তখন ভেবেছি— “আসুক হতাশা শ্রাবণ–মেঘের থমথমে বেশ পরে। গলে গিয়ে মেঘ আলো ঝরবে আমার টিনের চালে।” তাই আজ বিদায় লগ্নে বার বার মনে হচ্ছে “দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায় রইল না।” সুদীর্ঘ দশ বছরের স্মৃতিকে মুছে ফেলা কি সম্ভব ! কতো সফলতা–ব্যর্থতার স্বাক্ষর চেপে বসে আছে এই দশ বছরে ৷ জীবন পথের পথিক আমি আর আমার দশ বছরের জীবন– সাকিন আমার এই স্কুল । আজ মনে হচ্ছে “হাজার বাঁধনে গিঠাতে গিঠাতে” বাঁধা পড়ে গেছি।
নানা ঘটনা ও বিশেষ পাওয়াঃ নিরবিচ্ছিন্ন উচ্ছাসময় আমার জীবন নয়। অনেক চড়াই–উৎরাই পার হতে হয়েছে। সব কথা কি বলা যায়, না মানুষ পারে সব বলতে ! সেই না বলা কথার বোঝা থাক না একান্তই আমার হয়ে। তারই মাঝে পেয়েছি কত ছেলের সাহচর্য, কত শিক্ষকের স্নেহমাখা সান্নিধ্য। কত দিন মনে হয়েছে, “কবে যে স্কুলের গন্ডী ছেড়ে বেরোবো।” আর আজ যখন সত্যিই ছেড়ে চলে আসছি তখন বার বার মনে হচ্ছে, “জড়ায়ে আছে বাধা ছাড়ায়ে যেতে চায়—ছাড়াতে গেলে ব্যথা বাজে।” কত দিনের ছোট–ছোট কথা আজ বড় ব্যথা হয়ে বাজছে । যখন অজস্র হাত তালির ভিতর দিয়ে দু’হাত ভরে পুরস্কার নিয়েছি তখন মনে হয়েছে আজকের আসরে আমিই তো নায়ক। তবুও জীবন–চাহিদায় আমার সাফল্যের পীঠস্থান ছাড়তে হবেই। চলে গেলেও কি ভুলতে পারব আমাদের বাংলার শিক্ষক মানস বাবুকে। বাংলার শিক্ষক, কিন্তু যে কোন অঙ্ক কতো সহজেই সমাধান করে দিতেন। কাছে ডেকে কতদিন স্নেহমাখা গভীর স্বরে বলতেন “ভালো করে পড়। রেজাল্ট বের হলে যেন তোর মাথাটা উচুই থাকে! তোর যেখানে দঃখ, তার ভেতর থেকেই উঠে আসবে সাফল্য ।” ভাবতে গেলে আমার অনুভূতির শিকড়ে পড়ে টান ৷
বিদায়লগ্নে বিশেষ অনভূতিঃ“এ্যাডমিট কাড” নিয়ে বাইরে বেরিয়ে দেখি অনেক সহপাঠীর মেলা ; অনেক কল–কুঞ্জন। —তারই মাঝে একটা শাতশ্রী মাথা মুখে বার বার চোখের সামনে ভেসে উঠছে। সে আমার সহপাঠী ‘মাতনের মুখ । বড় আপন করতে জানা একটা ছেলে মাতন । কতদিন দুজেনের টিফিন এক করে দুজনে খেয়েছি । কত হাসির ফোয়ারা উঠতো আমাদের দ‘জনের মাঝে। কিছ না নিয়েই কত কিছুর আদান–প্রদান চলতো আমাদের দ‘জনের মাঝে। হঠাৎই একদিন হারিয়ে গেল জীবনের পথ থেকে হারিয়ে গেল চিরকালের মতো । আজ স্কুল থেকে শেষ–বিদায়ের ক্ষণে মনে হ‘ল, যেন ও আমাইয় হাতছানি দিয়ে ডাকছে । যেন জলভরা চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। ওর চোখের ভাষায় সেই না– বলা বাণী—“আমাকে ভুলে যাবি জানি। প্রাণের মাঝে কে যেন বেহালার ছড়ে বলে চলেছে” “কাঁদালে তুমি মোরে ভালবাসারই ঘায়ে।” ছিটকে বেরিয়ে এলাম স্কুলের গেট থেকে ৷ সামনের সবকিছ, অস্পষ্ট । চোখে আমার অবাধ্য জলধারা, নিজের বুকের মাঝে শুনতে পেলাম, “তোকে আমি ভুলিনি মাতন ? আমার মনের মাঝে তোর বসতি । এত বড় পাথরের পাঁচিল তুলতে পারিনি আমার মনের মধ্যে। তোকে আমি ভুলিনি, ভুলতে পারব না।”
উপসংহারঃ বাড়ী ফিরব বলে ট্রামে উঠলাম । মনে হল, মাতনকে কি সত্যিই ফেলে এলাম, না আমার ছোট্ট বুকে পুরে নিয়ে এলাম। আমার কাছে ও তো হারায়নি । ও লুকিয়ে আছে আমার শিরায় শিরায়। জানলার দিকে মাখটা ঘুরিয়ে নিলাম । দ‘চোখে আমার শ্রাবণের ধারা। দূর থেকে স্কুল বাড়ীটাকে অশ্রুসজল ঝাপসা চোখে দেখতে পেলাম। যেন মুছে যাওয়া দিনগুলো মনের মাঝে বলতে চাইছে, “ভরা থাক স্মৃতি সুধায় হৃদয়ের পাত্রখানি” আমার মনের ভিতর–মনকে ভিতর থেকে দিল বিষম নাড়া। অনুভুতির অণুতে বেজে উঠলো— “এ পথে আমি যে গেছি বারবার। ভুলিনি তো একদিনও।