একটি রেল ভ্রমণের অভিজ্ঞতা
Akti Rail Bhromoner Abhijnata
[ ভূমিকা– রোমাঞ্চের শুরু — ভ্রমণকালীন বিচিত্র অভিজ্ঞতা—উপসংহার ]
ভূমিকাঃ বনজ্যোৎস্নায় ভিজে যাওয়া পাহাড়িয়া পথে বাড়ীর সকলের সাথে গভ বছর পুজোর ছাটিতে ঘুরে এসেছি রাঁচী। তার আগে স্কুলের বন্ধুদের সাথে গিয়ে ছিলাম দেওঘর। কিন্তু গত ডিসেম্বরের ছটিতে মেজমাসিমার বাড়ী বহরমপরে গিয়ে মুর্শিদাবাদের হাজারদুয়ারী দেখে, খাগড়া থেকে কামরূপ এক্সপ্রেসে চড়ে কলকাতায় ফেরার—দীর্ঘ রেলপথে আমার পরিজনহীন বান্ধবহীন একক ভ্রমণের বিচিত্র অভিজ্ঞতাটিই বুঝি সবচেয়ে বেশী রোমাঞ্চকর।
রোমাঞ্চের শুরুঃ একরাশ বাধাহীন মক্তির আনন্দ বুকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছি পথে । এই আনন্দের সবটুকু আমার একার। আমার পনের বছরের জীবনে এরকম রোমাঞ্চকর দিন আগে আর আসেনি। মঃর্শিদাবাদের সাতদিনের ছাটি কাটিয়ে ইংরাজী নববর্ষে মাসিমার সাথেই কলকাতা ফিরে আসার কথা ছিল আমার । কিন্তু ২৯শে ডিসেম্বর হাজাদুয়ারী দেখা শেষ হতেই ভেবে নিলাম— আর নয় । লালগোলা প্যাসেঞ্জারের সহজ পথটাকে ছেড়ে দিয়ে, ঘোর পথে খাগড়া থেকে চড়ে বসলাম কামরূপ এক্সপ্রেসে। এতক্ষণ অন্ধকারে লেপমুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে ছিল সূর্যটা। সেই ঘুম ছেড়ে হঠাৎই যেন জেগে উঠল আমার সঙ্গে। জানলায় চোখ রেখে টকটকে লাল রঙ আকাশের দিকে তাকিয়ে খুজে পেলাম তাকে। সেও তো আমারই মত এক নিঃসঙ্গ পথের যাত্রী। দিগন্ত রেখার শেষে অস্পষ্ট গাছের সারির আড়ালে থেকে ফেটে পড়েছিল তার রঙ। সাগরের নোনা জলে মুখে ধুয়ে উঠে আসা কিংবা ব্রাহ্মমুহূর্তের পথ ভ্রমণের শেষে পাহাড়ের ওপরে বসে থাকা ধ্যানমগ্ন সূর্যটাকে আমি আজ এক তরুময় বিস্তীর্ণ সমতল ক্ষেত্রের শেষে আবিষ্কার করলাম । পথের এই সৌন্দর্যটিকে অনেকক্ষণ ধরে বুকে ভরে পান করেও তৃষ্ণা মিটছিল না আমার, কিন্তু মাসিমার হাতের লাচি আর আলুর দম যা এতক্ষণ আমার কাঁধের সাইড ব্যাগের মধ্যে সমানে সুগন্ধ বিতরণ করছিল, তার জন্য আমাকে পনের মিনিটের মত সময় দিতেই হ‘ল ।
ভ্রমণকালীন বিচিত্র অভিজ্ঞতাঃ কত দীর্ঘ পথ পেরিয়ে ছুটে চলেছে ট্রেন। আর আমি তার সাথে ছুটে চলেছি আমার মধ্যে জেগে ওঠা এক সজীব দুরন্ত সত্তাকে সাথে নিয়ে। ট্রেন তবুও একজোড়া আঁকাবাঁকা সমান্তরাল রেলের শাসন মেনে নিয়েছে কিন্তু আমাকে শাসন করার মত সুযোগ কারও নেই । প্রদীপের দেহটাকে হাতে পাওয়া গর্বিত আলাদীনের মত আমার যাত্রাপথের সমস্ত সময়টাকে যেন মুঠোর মধ্যে বন্দী করে ফেলেছি আমি। অভিভাবকদের শাসন থেকে সদ্যমুক্তি পাওয়া আমার এই উদভ্রান্ত মনটা তাই পথপ্রান্তে কুড়িয়ে পাওয়া মুহূর্তগুলোকে সারা জীবন ধরে বাঁচিয়ে রাখতে চাইছে এই চলন্ত ট্রেনের কামরায়। কখনও ট্রেনের বাঙ্কে উঠেছি, কখনও স্নানঘরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে জরিপ করেছি, কখনও বা জানলার ধারে অপরিচিত প্রাকৃতিক দৃশ্যের মধ্যে অসীম বিহ্বলতায় নিজেকে খুঁজে ফিরেছি আমি । এমন সময় বাঁশি বাজিয়ে স্টেশনে এসে থেমে গেল ট্রেন। স্টেশন নবদ্বীপ ধাম । মিনিট পাঁচেক থেমে থাকার পর ট্রেনটা আবার চলতে শত্রু করল। কিন্তু এবারে ট্রেনের গতি কেমন যেন শ্লথ। এভাবে মিনিট তিনেক চলার পর হঠাৎই ট্রেনটা থেমে গেল । এমন সময় ট্রেনের একদিক থেকে ভেসে গেল একজন হকারের কণ্ঠস্বর — “দাদা সন্দেশ নেবেন। নবদ্বীপের লোভনীয় মুখরোচক সন্দেশ। এ সন্দেশ কুড়ি টাকায় চারটির বেশী পাওয়া যায় না । কিন্তু আজ আমি বিপদে পড়ে গেছি। বাড়ীতে মায়ের অসুখ, বেশীক্ষণ বিক্রী করার মত সময় হাতে নেই। তাই কুড়ি টাকায় আটটি করে সব সন্দেশ দিয়ে চলে যাব।” এমন সময় কামরার অন্য প্রান্তে আর একজন সন্দেশ বিক্রেতার আবির্ভাব হ‘ল, সে বলল “আমার বাবার শরীর খারাপ, আমি কুড়ি টাকায় ন‘টা করে সন্দেশ দিয়ে চলে যাব, আপনারা আমার সন্দেশ দেখে চেখে নিয়ে যান ৷ প্রথমে দ্বিতীয় হকারের আকস্মিক আক্রমণে হতচকিত হয়ে পড়ল প্রথম জন, পরক্ষণেই সে দ্বিগুণ উৎসাহে দ্বিতীয় জনের কাছে এগিয়ে এসে বলল, “ঠিক আছে আমিও আজ তোকে দেখে নেব।—এই কামরার সকলকে আমার সব সন্দেশ খাইয়ে দিয়ে তবেই আমি নেমে যাব ৷ আমি কুড়ি টাকায় দশটা সদেশ দেব ।” এরপর দ্বিতীয় ও প্রথম পালাক্রমে সন্দেশের সংখ্যা বাড়িয়ে যেতে লাগল । বেশ কিছুক্ষণ পরে দ্বিতীয়জন যখন নতি স্বীকার করে বিদায় নিল তখন প্রথমজন কুড়ি টাকায় কুড়িটা সন্দেশ দেওয়ার অঙ্গীকার করে বসে আছে। অনেকের সাথে আমিও এতক্ষণ মজা দেখছিলাম, সন্দেশ এত কম দামে পাওয়ার সুযোগ হাতছাড়া করা বুদ্ধিমানের কাজ হবেনা ভেবে একেবারেই একশো টাকার কিনে ফেললাম। সন্দেশগুলো দুটো ছোট বাতাসা মুখোমুখি জোড়া দিয়ে যেমন দেখতে হয় তেমনি ধরণের । এই জোড়া সন্দেশ ১০টির দাম কুড়ি টাকা । মাত্র ১০ মিনিটের মধ্যেই বিক্রেতার সব সন্দেশ শেষ হয়ে গেল ৷ এই দীর্ঘ ঘটনার শেষে কৌতুহল বশতঃ সন্দেশে কামড় দিয়েই চমকে উঠলাম –এতো চালবাটার সাথে নারকেল ও চিনির মিশ্রণ। বিক্রেতারা কি অসাধারণ বুদ্ধিমত্তার সাথে আমাদের কাছে এইসব অখাদ্য বিক্রী করে গেল । আমার সময়বসী একটি ছেলে নবদ্বীপ ধামেই ট্রেনে উঠে এতক্ষণ আমার কাছে বসে থেকে সবকিছু লক্ষ্য করছিল। তার কাছে এইসব বিক্রেতাদের হাঁড়ির খবর জেনে নিয়ে আফশোসের আর অন্ত রইল না আমার ৷প্রায় একঘণ্টা অপেক্ষা করার পর আবার ট্রেন চলতে শরু করল । এবার বাকি পথটায় আর আমি নিঃসঙ্গ নই। পথের সাথী প্রায় সমবয়সী ছেলেটির সাথে হরেক রকম গল্পের মাঝে জেনে গেলাম ছেলেটি গতবছর হায়ার সেকেন্ডারী পাশ করেছে। নবদ্বীপে ওদের একটি কাপড়ের দোকান আছে। সেই দোকানের মাল কেনার জন্যই সে হাওড়ার মঙ্গলা হাটে চলেছে। তার সাথে গল্প করতে করতেই একসময় দেখতে পেলাম আমাদের ট্রেন হাওড়া স্টেপনের পাঁচ নম্বর প্ল্যাটফর্মে এসে ঢুকেছে ৷
উপসংহারঃ চলার পথের অন্তহীন আনন্দময় মুহূর্তগুলোকে অতীতের ওড়না দিয়ে ঢেকে রেখে প্ল্যাটফর্মে নামলাম আমি । পথের সাথী নবদ্বীপের ব্যবসায়ী ছেলেটির সাথে কথা বলতে বলতে গেট পার হব—তার আগেই তাকে বিনাটিকিটের যাত্রী হিসেবে চেকারে ধরল ।আমার বাধাহীন গণ্ডীহীন মুক্তসত্তাটির সাথে দীর্ঘ পথ যাত্রায় এক প্রাণ হয়ে ওঠা ছেলেটির কাছ থেকে ভীষণ এক মানসিক যন্ত্রণা নিয়েই আমাকে বিদায় নিতে হ‘ল ।