
ভাবসম্প্রসারণ
ভাবসম্প্রসারণ | Vab Somprosaron in Bengali Grammar Notes to each chapter is provided in the list so that you can easily browse throughout different chapter ভাবসম্প্রসারণ |Bhabsomprosaron in Bengali Grammar and select needs one.
Vab Somprosaron-bhabsomprosaron-Vab Somprosaron-bhabsomprosaron-Vab Somprosaron-bhabsomprosaronVab Somprosaron-bhabsomprosaron-Vab Somprosaron
ভাবসম্প্রসারণ
মূল ভাবকে নিজ ভাষায় বিস্তারিত করে লেখার নাম ভাসম্প্রসারণ।
ভাবসম্প্রসারণ করতে হলে নিম্নলিখিত বিষয়গুলি মনে রাখা প্রয়োজন, তাতে ভাবসম্প্রসারণ সহজসাধ্য হবে:-
১। প্রথমে উদ্ধৃতি অংশটুকু বার বার পড়তে হবে। বার বার পড়লে অবশ্যই পঠিত অংশের মূলে ভাব আংশিক বোধগম্য হবে ।
২। মূলভাব আংশিক বোধগম্য হলে তাকে নিজের সহজ সরল ভাষায় ছোট ছোট বাক্যে প্রকাশ করতে হবে।
৩। ভাবসম্প্রসারণ করার সময় বর্ণনীয় বিষয়কে সহজভাবে বুঝিয়ে দেবার জন্য একইভাবের কোন উদ্ধৃতি দেওয়া যেতে পারে। ইংরাজী বা বাংলা যে কোন উদ্ধৃতি দেওয়াই হোক না কেন, তা যেন আলোচ্য বিষয়ের সঙ্গে সঙ্গতি সম্পন্ন হয়। উদ্ধৃতি ইংরাজীতে হলে তার অনবাদ সাথে সাথে করে মূল বিষয়ের সাথে তার যোগ কোথা তা ভালভাবে বুঝিয়ে দিতে হবে।
৪। ভাবসম্প্রসারণ মানেই ‘যেন তেন প্রকারেণ বেশী করে লেখা নয়।‘ আর শধুমাত্র উদ্ধৃতি দিয়ে ব্যাখ্যা করতে না পারলে বা মূল বিষয়ের সাথে সঙ্গতি সম্পন্ন না হলে উদ্ধৃতি না দেওয়াই ভাল। মূলভাব বোঝাতে যতটকু লেখা দরকার ততটুকুই লিখতে হবে। অনর্থক আজেবাজে বকে সময় নষ্ট করা ঠিক নয় ।
৫। গদ্যাংশের ও পদ্যাংশের ভাবসম্প্রসারণ যা–ই থাক না কেন, ধীর স্থিরভাবে পড়ে মূল বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করতে হবে।
৬। তড়িঘড়ি করে যা মনে আসবে তাই লিখে পাতা ভরানোর চেষ্টা না করাই ভাল ।
৭। ভাবসম্প্রসারণে পরীক্ষার্থীর জ্ঞান, ভাষার উপর দখল এবং প্রকাশনী ক্ষমতা কতটুকু হয়েছে তা জানতে চাওয়া হয়।
অন্যায় যে করে, আর অন্যায় যে সহে
তব ঘৃণা যেন তারে তৃণসম দহে।”
নীতি বিরুদ্ধে যে কোন কাজই অন্যায় কাজ ৷ অন্যায় কাজ করা উচিত নয়। অন্যায়কারী সমাজ ও দেশের কাছে অপরাধী বলে সাব্যস্ত হয় । অন্যায় কাজ তাই জ্ঞান বুদ্ধি–বিবেকসম্পন্ন মানুষের কাছে ঘণ্যে। অন্যায় কাজ করা যেমন অনুচিত ঠিক তেমনি অন্যায় কাজ দাঁড়িয়ে দেখা বা সহ্য করাও অন্যায় ৷ কর্তব্য কর্মে অটুট থাকা যেমন মানুষের ধর্ম‘, ঠিক তেমনি অন্যায় কাজের প্রতিবাদ করাও অবশ্য কর্তব্য। অন্যায় কাজের প্রতিবাদ না করলে অন্যায়কারী ও অন্যায় কাজের নীরব দর্শক, একই অপরাধের ভাগী হয়ে থাকে। ঘুষ নেওয়া যেমন অন্যায় ; ঘুষ দেওয়া বা ঘুষ দিতে প্ররোচিত করাও ঠিক একইরূপে অন্যায়। অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে দাঁড়ানোর জন্য প্রয়োজন সাহস ও শক্তি । মানুষ ভয়ে বা দুর্বলতার জন্য অনেক সময় ইচ্ছা থাকলেও অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পারে না। প্রত্যেক বিবেকবান মানুষেরই এই ভয় ও দুর্বলতা পরিত্যাগ করে অন্যায়ের প্রতিবাদ করার জন্য এগিয়ে আসা উচিত। এটা তো ঠিক, অন্যায়কারী নৈতিক দিক দিয়ে বেশ দুর্বল । কাজেই সাহসে ভর করে অন্যায়ের প্রতিবাদে এগিয়ে গেলে অন্যায়কারীর পালানো ছাড়া আর কোন পথ থাকে না। তাই সব সময় কোন অন্যায় কাজ করা থেকে বিরত থাকা এবং সেই সঙ্গে অন্যায় কাজে বাধা দেওয়া আমাদের একান্ত কর্তব্য।
“অতি দীন ও অশুক্ত লোকেরাই দৈবের দোহাই দিয়া থাকে।”
মানুষ নিজের চেষ্টায় যে সাফল্য অর্জন করে তা তার পৌরুষের দান। পৌরুষেই মানুষের আসল শক্তি। পৌরুষহীন মানুষ স্বভাব দুর্বল– তাই সে সর্বদা দৈবের উপর নির্ভরশীল । ভাগ্যে নাই, দেবতা বিরূপ এই সব মন্তব্য দ্বারা তারা আত্মসন্তুষ্ট লাভের চেষ্টা করতে থাকে। কিতু দৈবের উপর নির্ভর করে আত্মশক্তির অপমৃত্যু ঘটানো অতীব নিন্দনীয়। সংস্কৃতে একটি উক্তি আছে–
‘উদ্যোগিনং পুরেষ সিংহমূপৈতি লক্ষ্মীঃ
দৈবেন দেয়মিতি কাপুরুষাঃ বদন্তি”।
যারা উদ্যোগী পুরুষ তারা সিংহের ন্যায় বলশালী, তাদের ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়। লক্ষ্মীদেবী তাদের কাছে উপস্থিত হন। আর যাদের মনে বল ও দেহে শক্তি নেই বলে উদ্যমহীন, তারা দৈবের দোহাই দিয়ে তৃপ্ত সন্তুষ্ট থাকার চেষ্টা করে থাকে । সত্য সত্যই দৈব বলে কিছু নেই । অদৃষ্টে বা ভাগ্যের দোহাই দেওয়া আত্মপ্রতারণা ছাড়া আর কিছু নয়। মানুষ নিজ কর্মে‘র দ্বারা নিজের ভাগ্য গড়ে তোলে । ইংরাজীতে একটা কথা আছে। যাকে প্রবাদ বাক্য বলা হয়– ‘Man is the architect of his own fortune. “
মানুষ যে যেমন কাজ করে, সে তেমন ফল পায় ৷ দীন ও দুর্বল ব্যক্তিরা যে কোন কাজে নিরুদ্যম থেকে নিজ দুর্ভাগ্যের জন্য ঈশ্বরের উপর অসন্তুষ্ট হয় ।
অদৃষ্টেরে শুধালেম চিরদিন পিছে
অমোঘ নিষ্ঠুর বলে কে মোরে ঠেলিছে
সে কহিল ফিরে দেখো। দেখিলাম আমি
সম্মুখে ঠেলিছে মোরে পশ্চাতের আমি‘।
যা কিছু পূর্বে দেখা যায় না তাই অদৃষ্ট। আমাদের জীবনে যা দেখা যায় না তার উপর ছেড়ে দেওয়া কখনই যুক্তিসঙ্গত নয়। যা সত্য যা বাস্তব তাই অমোঘ এবং নিষ্ঠুরও বটে। বাস্তবের কঠিন সংঘাতে মানুষের জীবন মাঝে মাঝে ক্ষত বিক্ষত হয়ে পড়ে। মানুষ তখন দিশেহারা হয়ে যায় । মন হয় দুর্বল । দুর্বল মন তখন আপনার ব্যর্থতাকে ঢাকা দেবার জন্য ভাগ্য–অদৃষ্টের দোহাই দেয়। কিন্তু অদৃষ্টের দোহাই দিয়ে জীবনকে অনিশ্চিতের হাতে সঁপে দেওয়া কখনই ঠিক নয় । অদৃষ্টকে কাছে আনা, চালনা করাই তো প্রকৃত মানুষের কাজ। তা নইলে জীবনকে অদৃষ্টের হাতে ছেড়ে দিলে জীবন হতাশা ও বিষণ্ণতায় ভরে ওঠে। এমতাবস্থায় পিছন ফিরে তাকানো কখনই বদ্ধিমানের কাজ নয়। জীবনের সব কাজেই এগিয়ে যেতে হবে। তাই সামনের দিকে তাকাতে হবে। পিছনের দিকে নয়। পিছন দিকে তাকালে সামনের গতি হবে ব্যাহত, পিছনের আকর্ষণ তাকে পিছনের দিকেই টানবে। তাই এগিয়ে যাওয়ার মধ্যেই আছে পিছনের ঠেলা। পিছনের ঠেলার বেগেই আমরা এগিয়ে যাই। এই ঠেলা মানুষের নিজস্ব সত্বা থেকেই, নিজস্ব প্রেরণা থেকেই আসে। অদৃষ্টের হাতে নিজেকে সপে না দিয়ে নিজের তাগিদে সামনের দিকে এগোনই উচিত ৷
ভাবসম্প্রসারণ | Bhabsomprosaron in Bengali Grammar
Here we have given detailed examples of ভাবসম্প্রসারণ | Vab Somprosaron in Bengali Grammar, You have to self practice a lot to master the skill.
অনাহারে মরিয়া যাইবার জন্য এ
পাথিবীতে কেহ আইসে নাই ৷
পৃথিবীতে মানুষ জন্মগ্রহণে তার নিজের কোন হাত নেই! মরার পিছনেও তার ইচ্ছা অনিচ্ছা কোন প্রকার কাজ করে না । মানুষে অপরের ইচ্ছায় যখন পৃথিবীতে এসেছে তখন বাঁচার অধিকার তার নিশ্চয়ই আছে। এই বাঁচার অধিকার কেউ তার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিতে পারে না। বাঁচার জন্য চাই খাদ্য, আহার । খাদ্য না পাওয়ার নাম অনাহার । এ জগতে সামাজিক অবস্থা সর্বত্র একরকম নয়। কোন কোন স্থানে মানুষ প্রয়োজনমত আহারের সংস্থান করেও তার অতিরিক্ত অর্থ জমিয়ে ধনী হয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে দুবেলাও দমঠো অন্নের সংস্থান না করতে পেরে মানষে অনাহারে মৃত্যুবরণ করতে বাধ্য হচ্ছে। এরূপ ঘটনা অর্থাৎ না খেতে পেয়ে পথে–ঘাটে মৃত্যুর ঘটনা আমাদের চোখের সামনে অহরহই ঘটছে। প্রত্যেকে তার ক্ষুধা নিবৃত্তির জন্য যতটুকু খাদ্যের প্রয়োজন তা লাভ করুক।তাহলে নিশ্চিত মাত্যুর হাত থেকে সে বেচে ওঠার নতুন মন্ত্রে অনুপ্রাণিত হবে। তাই তাকে যে কোন পথ ধরে বেচে থাকার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা চালাতে হবে ।
অন্তরে অনিষ্ট চিন্তা মুখেতে মিষ্টতা
তার চেয়ে ঢের ভালো প্রকাশ্য শত্রুতা।
ভেতর আর বার দুরকম মনোভাবের, এরূপ মানুষ খুবেই ভয়ংকর। মুখে মিষ্টি কথা, অন্তরে হিংস্র মনোভাব, এরূপ লোক থেকে দূরে থাকা উচিত । শত্রুতা বিরোধিতা, প্রকাশ্যেই ভাল । কিন্তু, গোপন শত্রুতা একান্তই নিন্দনীয়। প্রকাশ্য শত্রুকে—তার ক্ষতিকর ক্ষমতাকে সব সময়েই অনুমান করা যায়। কিন্তু, যারা মুখে মিত্রতার ভান করে আর অন্তরে ষড়যন্ত্রের প্যাঁচ আঁটে, তাদের শত্রুতার ওজন অনুমান করা দুঃসাধ্য ব্যাপার। মুখে এক অন্তরে আর–এ–ধরণের মানুষ কি ব্যক্তিগত দিকে, কি সমাজের পক্ষে খুবই বিপদজনক। এরূপে মানষের সঙ্গে লড়াই করা যায় না। প্রকাশ্য শত্রুর সাথে লড়াই করা যায়। কারণ তার ক্ষমতা কিছুটা অনুমান করা যায়। শত্রুর আঘাত কোন দিক থেকে আসবে—কেমন করে তা প্রতিহত করতে হবে তা সব বোঝা যায়। কিন্তু গোপন শত্রুর ক্ষমতা অনুমান করা কখনই যায় না। তার আঘাত কখন কিভাবে, কোন দিক দিয়ে যে আসবে তা কখনই অনুমান করা যায় না। কাজেই এরূপ মানষের কাছে সদাজাগ্রত থাকতে হবে, কোন রকমেই এদের বিশ্বাস করা চলবে না।
“আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে
আসে নাই কেহ অবনী পরে।
সকলের তরে সকলে আমরা
প্রত্যেকে আমরা পরের তরে।”
মানুষ আত্মসুখ অর্জনে সর্বদা সচেষ্ট থাকতে পাথিবীতে আসেনি। কারণ তাতে তৃপ্তি নেই—সুখ নেই । অপরের সেবার মধ্যেই প্রকৃত তৃপ্তি ও সুখ নিহিত আছে । যে মানষে নিজের সুখ–স্বাচ্ছন্দ্য, নিজের আত্মীয়–প্রিয়জনদের সুযোগ সুবিধার কথা সর্বদা চিন্তা করে—তাকে স্বার্থপর মানুষ বলে। স্বার্থসিদ্ধির কোন চরম মাপকাঠি নেই—নেই মানুষের সুখ পাওয়ার শেষ সীমার। তাই মানুষের চিন্তা করা উচিত প্রকৃত সুখের কোথা। প্রকৃত সুখ আছে পরার্থপরতার মধ্যে। বিধাতার শ্রেষ্ঠ মানুষ কখনই স্বার্থপর হবে না। অপরের সুখে সুখী, অপরের দুঃখে দুঃখী হওয়ার মধ্যে জীবনে পরম পাওয়ার স্বাদ ও আনন্দ, তৃপ্তি ও সুখ আছে। নিছক স্বার্থ সিদ্ধি করার মাধ্যমে মানুষের ঐ প্রকার মহত্বকে বিসর্জন দেওয়া ঠিক নয় । নিজেকে সুথী করে নয়—পরকে সুখী করে প্রকৃত সুখ পাওয়া যায়। দুর্বলকে সাহায্য, আর্তকে উদ্ধার, রোগীর শয্যাপাশে সেবাপরায়ণ থাকার মধ্যে মানব জীবনের শ্রেষ্ঠ সুখ পাওয়া যায়।
আলো বলে, অন্ধকার তুই বড়ো কালো
অন্ধকার বলে—ভাই, তাই তুমি আলো।
জগতে যে কোন অবস্থায় দুটি দিক রয়েছে। একটি অপরটির বিপরীত। সুখের বিপরীত দঃখ, ভালোর বিপরীত মন্দ, শীতের বিপরীত গরম, আলোর বিপরীত অন্ধকার । তবে এই যে বিপরীত অবস্থা– তা কখনও নিরবিচ্ছিন্ন হতে পারে না । একটার পর ঘূরে অন্য একটা ঠিক ফিরে আসে। প্রাকৃতিক অবস্থাতেও আমরা সর্যোদয়ের পর স্বাভাবিক নিয়মে সূর্যাস্ত দেখি, আবার ঘুরে সূর্যোদয় । এইভাবেই চলে আসছে। দঃখের পর সূখ আছে। এই যে বিরুদ্ধে অবস্থা বা বিপরীত অবস্থা–এরও প্রয়োজন আছে। সাদা কালো। জগতে সবই যদি সাদা থাকত, কালোর নামগন্ধ না থাকত তাহলে সাদার জৌলুষ মানুষের চোখে লাগত না। কালো আছে বলেই সাদার এত কদর । ঠিক সেরূপ অন্ধকারের জন্যে আলোর। আলোর যদি এই মনোভাবই হয়— ‘অন্ধকার‘ তার থেকে অনেক নীচে, ছোট, ঘৃণ্য – তাহলে তার ভুল হবে। অন্ধকার আছে বলেই লোকে আলোর উপকার বুঝে থাকে। অন্ধকার না থাকলে আলোর এত সৌন্দর্য‘ কখনই উপলব্ধি হোত না। কাজেই অন্ধকার কখনই উপেক্ষণীয় নয়। আর আলোরও তাতে নিজেকে বড় মনে ভেবে অন্ধকারকে তুচ্ছ করার কিছু নেই। বরং আলোর ভাবা উচিত অন্ধকার আছে বলেই তাঁর এত কদর ও সৌন্দর্য ।
“এ জগতে মানুষ আপনার ঘর আপনি রচনা করে।”
আপন পৌরুষ এবং কঠোর পরিশ্রম মানুষের সকল উন্নতির মূলে। মানুষের জন্ম ও মৃত্যু নিজের অধীন নয়। কিন্তু মানুষের জীবনযুদ্ধে জয় নিজের করায়ত্ত । মহাভারতে কর্ণের জীবন সেই শিক্ষাই দেয় । জন্ম যেখানেই হোক না –কৰ্মই বড় কথা। কর্ণ বলেছিলেন — “দৈবায়ত্তং কুলেই জন্ম মদায়ত্তং হি পৌরুষাম ।” সত্যিই মানুষের শক্তি, সাহস, বীর্যবত্তা-‘পৌরুষ‘ নাম নিয়ে মানষকে জীবন সংগ্রামে জয়ী করে। এই ‘পৌরুষ সকল মানুষের কাম্য। দৈবের হাতে নিজেকে ছেড়ে দেওয়ার মত বোকামি আর কিছু নেই। নিজে হাত পা গুটিয়ে বসে থেকে দৈবের সাহায্য প্রার্থনা করলে জয় আসবে না— সাফল্য আসবে না। সাফল্যের জন্য মানষকে সাধ্যমত পরিশ্রম ও চেষ্টা করতে হবে। জগতের ইতিহাস বলে—জন্ম নয়, বংশ নয়, কৌলিন্য মর্যাদা নয়—মানুষ বড় হয় নিজের শক্তিতে–নিজের বুদ্ধিবলে, নিজের দঃসাহসিক পরিশ্রমের দ্বারা। ভয়ে, কষ্টের ভয়ে হাত গুটিয়ে বসে থাকলে সাফল্য সুদূরে মিলিয়ে যাবে । অসীম অধ্যবসায়, কঠোর পরিশ্রমের দ্বারা মানুষ নিজের ভাগ্য নিজে গড়ে নেয়। এর বিকল্প বলে কিছু নেই। মানুষের ভাগ্য তার নিজেরই হাতে।
“কেরোসিন শিখা বলে মাটির প্রদীপে,
ভাই বলে ডাক যদি দেব গলা টিপে।
হেনকালে গগনেতে উঠিলেন চাঁদা,
কেরোসিন বলি‘ উঠে—এসো মোর দাদা।“
মানুষের ধন–ঐশ্বর্য আভিজাত্যবোধ মানুষকে আপন আত্মীয়স্বজন থেকে পৃথক করে দেয় । ধনীলোক গরীব আত্মীয়ের সঙ্গে সম্পর্কে‘র পরিচয় গোপন করে। কারণ এতে তাদের মান মর্যাদা – আভিজাত্য নষ্ট হয় । মাটির প্রদীপ ও কেরোসিন শিখা উভয়েই আলো দেয় – অন্ধকার দূর করে। গোত্রে উভয়েই এক। উভয়েরই কাজ অন্ধকার দুর করা। কিন্তু আলোর পরিমাণ কম–বেশীর জন্য কেরোসিন শিখা মাটির প্রদীপকে আপন বলে স্বীকার করে না। আকাশে ভুবন আলো করা ছাঁদ উঠলে কেরোসিন শিখা সেধে গিয়ে তার সাথে আলাপ জমায় তাকে আমন্ত্রন জানায়। মনুষ্য সমাজেও ঐ একই জিনিষ দেখা যায় । গরীব আত্মীয়ের সাথে পরিচয় না রেখে ধনী আত্মীয় তদপেক্ষা অধিক ধনী অনাত্মীয়ের পৃষ্টপোষকতা, যেচে আলাপ প্রভৃতি করে। কারণ তাতে নাকি তাদের সমাজে আভিজাত্য বাড়ে । গরীব আত্মীয় চিরকাল বড়লোক আত্মীয় কর্তৃক বিচ্ছিন্ন হয়। এটা মানুষের নীচ মনোভাবের লক্ষণ । উচ্চমনা মানুষেরা এরূপে ব্যবহার করেন না। তাঁরা ধনী–দরিদ্র সকল আত্মীয়ের সাথেই সমব্যবহার করে থাকেন।
চির সংখীজন ভ্রমে কি কখন
ব্যথিত বেদন ঝুঝিতে পারে?
কি যাতনা বিষে বুঝিবে সে কিসে
কভু আশীবিষে দংশেনি যারে।”
ভুক্তভোগী যারা তারাই অপরের দঃখ বুঝতে পারে। যারা আজীবন সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্যের মধ্যে জীবন–যাপন করে, তারা কখনই দঃখীর জালা উপলব্ধি করতে পারবে না। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, যে ব্যক্তিকে সাপে কখনও দংশন করেনি সে ব্যক্তি সাপের বিষের কি জ্বালা তা কখনই উপলব্ধি করতে পারবে না। দুঃখী দরিদ্র্য মানুষের পেটে ক্ষুধার জ্বালা । সেই জ্বালা কখনই অন্য ব্যক্তি বুঝবে না যার অন্নের অভাব নেই। রোগজীর্ণের কষ্ট—নিরোগ ব্যক্তি কি ভাবে উপলব্ধি করবে। যারা রোগে ভুগেছে — যারা শোকতাপ পেয়েছে তারাই কেবল রোগের যন্ত্রণা, শোকগ্রস্তের শোকের বেদনা বুঝেবে। তাই বলা যায়, ভুক্তভোগী ছাড়া অন্যের দঃখ– শোক–তাপ–রোগ যন্ত্রণার জালা অন্যে বুঝবে না, বুঝতে পারে না ।
‘জীবে প্রেম করে যেই জন
সেই জন সেবিছে ঈশ্বর ।‘
জীবের মধ্যেই শিবের অধিষ্ঠান। প্রত্যেক জীবের মধ্যেই সেই পরমব্রহ্মের অংশ বিদ্যমান। মানুষ দেবতার কৃপা পাওয়ার জন্য নানা দেব–দেবীর মন্দির, তীর্থস্থান গড়ে তোলে। তাদের ধারণা দেবসেবার মধ্যে দিয়ে, দেবার্চনার জন্য মন্দির দেবালয় প্রতিষ্ঠা করে দেবতাকে পাওয়া যায়। তাই তারা মন্দিরের দ্বার অর্গলবদ্ধ করে দেবতার পূজো আরাধনা করে। কিন্তু এ ধারণা তাদের একান্তই ভ্রান্ত। কারণ দেবতা কখনই সংকীর্ণ গণ্ডীর মধ্যে আবদ্ধ থাকেন না। দেবতা থাকেন অসংখ্য দীন দুঃখী শ্রমজীবি মানুষ, যারা দিনরাত মাথার ঘাম পায়ে ফেলে পরিশ্রম করছে— তাদের মধ্যে। দেবতা নিজেই তো স্রষ্টা। তাই সৃষ্টির প্রতিটি অনু–পরমাণুতে দেবতার অধিষ্ঠান । সকল জীব—যত ক্ষুদ্র–তুচ্ছ–দীন দরিদ্র সে হোক না কেন তাদের ভালবাসা বা সেবার মধ্যে দিয়ে দেবতার সান্নিধ্য পাওয়া যায়। মানুষের মধ্যেই দেবতা বিদ্যমান। তাই বলা হয় জীবসেবাই ভগবৎ সেবা— জীবে প্রেমই ঈশ্বর প্রেম ।
“জগতে দারিদ্ররূপে ফিরি দয়া তরে
গৃহহীনে গৃহ দিলে আমি থাকি ঘরে।”
ঈশ্বর এই বিশাল পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন। আর তার সব সৃষ্টির মধ্যে মানুষে সর্ব শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। মানুষের প্রতি বাঝি তাঁর অনন্ত প্রেম–নেহ–মায়া–মমতা। তাই ঈশ্বর সেবার অন্য নাম মানবসেবা। মানুষ তা সে যত দঃখী–দরিদ্র হোক না কেন তারও মধ্যে ভগবান বিরাজমান। সেই দীন দরিদ্র মানুষদের ঘৃণা করে, তুচ্ছ– তাচ্ছিল্য করে মন্দিরের মধ্যে দেবতার পূজা করলে দেবতা তুষ্ট হন না। জীবকে ভালবাসলে তবেই বিধাতা সন্তুষ্ট হন। স্বামী বিবেকানন্দ তাই বলেছেন “জীবে প্রেম করে যেই জন, সেইজন সেবিছে ঈশ্বর। অনহীনকে অনদান, গৃহহীনকে গৃহদান, বস্ত্রহীনকে বস্ত্রদান করলে দেবতা তৃত হন । দেবতার স্নেহ–প্রেম–করণো লাভ করতে হলে মানষকে স্নেহ–প্রেম–করণো করতে হবে। জগতের সকল মহা– পুরুষই মানষকে এই শিক্ষা দিয়েছেন—’নররূপী নারায়ণের সেবা কর—তাতেই দেবতা তুষ্ট হবেন ।”
“তুমি অধম, তাই বলিয়া আমি উত্তম হইব না কেন?”
ঈশ্বরের সৃষ্টি এই বিশ্বসংসারে নানা ধরণের মানুষ আছে। চরিত্রের গূণাগুণে বিচারে তাদের আমরা দুটি ভাগে ভাগ করতে পারি। একটি হোল উত্তম শ্রেণীর আর অন্যটি হোল অধম শ্রেণীর । যাঁরা আপন–পর বিবেচনা না করে অপরের সেবায় নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেন, যাঁরা উপকারের বিনিময়ে কি পেলাম, কতটকু পেলাম, এই সব তুচ্ছ বিষয় নিয়ে বিন্দুমাত্র চিন্তা করেন না; যাঁরা স্বার্থ চিন্তা সর্বস্বতাকে গর্হিত কাজ বলে মনে করেন ; তাঁরা উত্তম পর্যায়ভুক্ত । আর যারা শুধু নিজেরটি ছাড়া আর কিছুই জানে না, স্বার্থপরতা যাদের দেহের অণুতে পরমাণুতে, যারা অক্ষম, অসহায়, দুর্বল মানষদের প্রতি ভুলেও বিন্দুমাত্র দয়া দেখায় না তারা অধম শ্রেণীর । আমাদের দেশের এবং পৃথিবীর সকল দেশের মহাপুরেষেরাই এই শিক্ষা দিয়েছেন যে, অপরে উপকারের বিনিময়ে প্রত্যুপকার করল কিনা, তা না বিচার করেই পরের উপকার করা উচিত। কেউ যদি ভাল ব্যবহার না করে—তাহলেও তার সাথে ভাল ব্যবহার করাই শ্রেয় । অন্যজন খারাপ আচরণ করলেও আমার ভাল আচরণে বাধা কোথায়। তাই মহাপুরুষেরা বলে গেছেন উপকারের বিনিময়ে প্রত্যুপকার না পাইলেও নির্বিচারে অপরের সেবা করে যাওয়া মানুষের সাধারণ ধর্ম ।
“দণ্ডদাতা কাঁদে যবে দণ্ডিতের সাথে সর্বশ্রেষ্ঠ সে বিচার।”
অপরাধের জন্য যিনি শাস্তি দেন, তিনি দণ্ডদাতা বা বিচারক । আর যে দণ্ড বা শাস্তি পায় নিজ অপরাধের জন্য তাকে বলে দণ্ডিত বা আসামী। দণ্ডদাতা শাস্তি দেন– দণ্ডিত সে শান্তি ভোগ করে থাকে। দণ্ডদাতা বা বিচারক
কতকগুলি আইনের শৃঙ্খলে বদ্ধ থাকেন। সেই আইন ধরে তাঁকে বিচারে এগুতে হয় এবং প্রয়োজন হলে অপরাধীকে দোষী সাব্যস্ত করে শাস্তি দিতে হয়। কিন্তু দণ্ড বিধান করে দণ্ডের বা শাস্তির ভয়াবহতা উপলদ্ধি করে দণ্ডদাতা যদি নিজে দুঃখ পান, তাহলেই তাঁর বিচার সার্থক হবে। যদি তিনি তা না হন অর্থাৎ যদি শাস্তি দান করে বিচারক সন্তুষ্ট হন, তাহলে সে বিচার পক্ষপাত দোষে দুষ্ট হবে। তা হবে দুর্বেলের উপর সবলের অত্যাচার। বিচারকের হাতে শাসন দণ্ড ও আইনের রক্ষাকবচ আছে। তার সাহায্যে তিনি অপরাধীকে শাস্তি দেন। এই শাস্তি দেওয়ার মধ্যে যদি তার বেদনা–বোধ জাগে, যদি তিনি দুঃখিত মর্মাহত হন তবেই তাঁর বিচার নিরপেক্ষ হবে। অপরাধীকে শাস্তি দিয়ে বিচারকও যদি কষ্ট পান তবে তদর্শনে অপরাধীও অপরাধ কর্ম থেকে ভবিষ্যতে বিরত থাকতে পারে।
প্রাচীরের ছিদ্রে এক নাম গোত্রহীন
ফুটিয়াছে ছোট ফুল অতিশয় দীন।
ধিক ধিক করে তারে কাননে সবাই,
সূর্য উঠি বলে তারে, ‘ভালো আছ, ভাই।‘
আমরা জগৎ সংসারে সংকীর্ণমনা ও উদারমনা দুই প্রকৃতির মানূষ দেখতে পাই।সংকীর্ণমনা যারা তারা সর্বদা জাতপাত–ধর্ম–ভাষা–বংশধরের বিচার করে মানুষের সাথে চলাফেরা করে। এরা কারণে অকারণে মানুষকে ছোট বলে ভাবে। এই জাতের লোকদেরই সংকীর্ণমনা বলা যায়। আর যারা সর্বজীবে সকল সময় একই রূপে দেখেন, যাঁদের মধ্যে ধন–নির্ধন, উচু জাতি নিচু জাত, ছোট বড়, আপন–পর এই সব ভেদাভেদ নেই তাঁরাই উদারমনা বলে পরিগণিত। প্রাচীরের গায়ে নাম না জানা, কৌলীন্যহীন ছোট ফুল ফটে আছে। তাকে দেখে বাগানের ফুলেরা কি তুচ্ছ–তাচ্ছিল্য করা। ফুল হিসেবে সমগোত্রীয় হলেও একজন অর্থাৎ প্রাচীরের ফুলের কৌলিন্য বা বংশ আভিজাত্য নেই। কিন্তু বাগানের নামকরা ফুল কত নামডাক কত আভিজাত্য তার। তাই সে প্রাচীরের ফুলকে তুচ্ছ ভাবে। কিন্তু আলোর বন্যা নিয়ে যখন সূর্যদেব উঠেন—তখন বাগানের ফুল কর্তৃক ধিকৃত প্রাচীরের ছোট ফুলের খোঁজ আগে নেন। কারণ তাঁর উদার হৃদয় । ছোট বড় নির্বিশেষে তিনি সকলকে সমান ভাবে আলো বিতরণ করেন। জগতের মহাপুরুষেরা আমাদের এই শিক্ষাই দিয়েছেন কাউকে ছোট ভাবা উচিত নয়—যত ক্ষুদ্রেই সে হোক না কেন, সবার মধ্যেই সেই পরম দেবতা ঈশ্বরের অধিষ্ঠান আছে। উদার ও মহান ব্যক্তিরাই স্নেহ–প্রীতির স্পর্শ ছোট–বড় নির্বিশেষে সবাইকে সমান ভাবে দিয়ে থাকেন।
“পরিশ্রম সৌভাগ্যের প্রসূতিরূপে।”
সন্তান মাতার কঠিন পরিশ্রম, স্নেহ ও ভালবাসার ফলে বড় হয়ে উঠে। সন্তানকে বড় করে তোলার জন্য মাতার পরিশ্রমের, কষ্টের তুলনা করা যায় না ।
পরিশ্রমের সঙ্গে সৌভাগ্যের সম্পর্ককে, মা ও ছেলের সম্পর্কের তুলনা করা হয়ে থাকে। দীর্ঘদিন কঠোর পরিশ্রম বা সাধনার ফলে সাফল্যের সৌভাগ্য ধরা দেয়। দীর্ঘদিনের কঠোর অধ্যবসায় ও পরিশ্রমের ফলে একজন ছাত্র পরীক্ষায় মনোমত সাফল্য পেতে পারে। পরীক্ষার ভাল ফল পেতে হলে তাই আগে থেকে কঠিন পরিশ্রম করতে হবে। আরামে–আলস্যে, বিরামে–বিলাসে জীবন অতিবাহিত করলে কোন ছাত্রই পরীক্ষায় সাফল্য পেতে পারে না। ভাগ্যের চাকা ঘোরাতে কঠিন পরিশ্রম চাই। পরিশ্রমের ফলেই আসে। বিনা পরিশ্রমে সার্থকতা মেলে না। যেখানেই সাফল্য–সেখানেই পরিশ্রম কঠিন পরিশ্রম ।
“ফুল যবে ঝরে যায়
ভেবেছ কি মরে হায়
শেষ হয় চিরতরে তার রূপ সৌরভ?
সে যে ফিরে ফিরে আসে
বছরের সেই মাসে
দেখো নাকি সেই রঙ, সেই শোভা
সেই সব।”
আসা ও যাওয়া অনিত্য সংসারের নিত্য খেলা। ফুল ফুটবে এবং তা ঝরে যাবে। ফোটার পরেই তার ঝরার পালা । তবে এটা ঠিক ফুল ঝরে গেলেই চিরতরে ঝরে যায় না। আবার নির্দিষ্ট মাসে ফুল ফোটে। মানুষের জন্ম–মত্যুও ফুলের ফোটা ও ঝরে যাওয়ার মত চিরতন। মৃত্যু তো মানুষের দেহরূপে বেশবাস বদলানো ছাড়া আর কিছু নয়। মানুষ মৃত্যুর পর তার জাতকের দেহে নতুন করে আবির্ভূত হয় । ফুলর বর্ণ, সৌরভ এর বার আসা যাওয়ার মধ্যেই শেষ হয়ে যায় না। বারবার তার আসা যাওয়া। ফূল ও মানূষ উভয়েই আসা–যাওয়ার চিরন্তন খেলা—এই খেলা খেলছে। কাজেই ফূল ঝরে গেলেই, মানুষ মরে গেলেই তাদের সব কিছু, শেষ হয়ে যায় না। তাদের সন্তান–সন্ততি, তাদের বংশধর তাদের মধ্যে দিয়ে তারা আবার বার বার নতুন করে ফিরে ফিরে আসে।
“বিরাম কাজের অঙ্গ, একসাথে গাঁথা ।
নয়নের অংশ যেন নয়নের পাতা ।”
মানুষ কাজ করে। কাজই তার জীবন । কিন্তু নিরলসভাবে মানুষ বিরামহী কাজ করতে পারে না।তা যদি করে তাহলে অচিরেই তার শরীর–স্বাস্থ্য ভেঙে পড়বে। তাকে রোগ আক্রমণ করবে। কাজ করার সঙ্গে সঙ্গে তাকে বিরাম বা বিশ্রাম নিতে হবে। বিশ্রাম মাননুষের ক্লান্তি দূর করে এবং উদ্যমে পুনরায় আরম্ভ করার শক্তি যোগায়। কাজেই, কাজের সঙ্গে বিরাম বিশেষ প্রয়োজন। বিরাম না থাকলে কাজ একঘেয়ে হয়, বৈচিত্র্যহীন হয় – কাজ করতে মন লাগে না।তাই কাজে বৈচিত্র্য আনতে, কাজে ভালোলাগা দিতে,কাজের সঙ্গে সঙ্গে নির্দিষ্ট সময়ের বিশ্রামও দরকার। খেলা–ধুলার মাঠ থেকে অফিস–আদালত স্কুল প্রভৃতি কম যজ্ঞের সব এই টিফিন বা বিরতি বিরাম আছে। কাজের সঙ্গে বিরামকে বাদ দেবার কোন চিন্তাই করা যায় না । একে অপরের পরিপরেক।
“মেঘ বলে সিন্ধু; তব জনম ৰিফল
পিপাসায় দিতে নারো একবিন্দু জল
সিন্ধু, কহে, “পিতৃনিন্দা কর কোন মুখে
তুমিও অপেয় হবে পড়িলে এ বুকে।”
সিন্ধু বা সমুদ্র এবং মেঘ উভয়ের মধ্যে পিতা–পুত্র, মাতা–পুত্র সম্বন্ধ। মেঘ অহংকারবশতঃ উভয়ের এই সম্পর্ক” বিস্মৃত হয়ে সিদ্ধকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে। সমদ্রের জল লবণাক্ত। মানুষ তা পান করতে পারে না। সেই জলরাশিই সূর্য – তাপ বাষ্পীভূত হয়ে হয়ে মেঘ হয় এবং সেই মেঘ থেকে বৃষ্টি বা যে জল হয় তা আর লবণাক্ত হয় না। তাই মানুষ তা সহজেই পান করতে পারে। এখানেই হয়েছে তার অহংকার। সমদ্রের জল অপেয়। কিন্তু তার জল অর্থাৎ মেঘের জল অপেয় নয়– পেয় । এখানেই তার শ্রেষ্ঠত্ব। তার অতবড় অহংকারপূর্ণ উক্তি । সে একবারও ভেবে দেখে না তার উৎপত্তি কি থেকে ? সমদ্র থেকেই যে তার সৃষ্টি তা সে ভুলে যায়। আরও সে ভুলে যায় যদি সে সমদ্রে পড়ে তাহলে সেও অপেয় হয়ে যাবে। মানব সংসারেও এরূপ অহংসর্বস্ব মনোভাবের অনেক মানুষ দেখা যায় – যারা অহংকারে মত্ত হয়ে লঘুগুরু বিচারবোধ হারিয়ে ফেলে মানী লোককেও তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে। মেঘের কথাগুলি যা সে সমুদ্রকে উদ্দেশ্য করে বলছে – তা ঐ প্রকার মানুষের ইংগিত দেয় ।
“যারে তুমি নীচে ফেল
সে তোমারে বাঁধিবে যে নীচে
পশ্চাতে রেখেছ যারে
সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে।”
বাংলার কবি চণ্ডীদাস বলেছেন, “সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই”। মানুষ সম্পর্কে— এতবড় উপলব্ধির কথা এমন পরিষ্কার করে কেহ বলেন নাই। কিন্তু কালের রথচক্রতলে এই বোধ আজ আমাদের দেশেই দলিত মথিত হতে চলেছে । আজ মানুষেকে মানুষ বলে জ্ঞান আমাদের লোকেরাই করছে না।জ্ঞান করে তাকে দূরে সরিয়ে রাখছে। জাতিতে, ধর্মে ধর্মে, বর্ণে বর্ণে তাই হানা–হানির অন্ত নেই। তারা ভুলে গেছে মানুষের এই অপমান মানবাত্মার তথা বিশ্বাত্মারই অপমান। উচু নিচু এই জাতিভেদ মানষেকে কত নীচে যে নামিয়ে দিচ্ছে তা বলে শেষ করা যায় না। মানবাত্মার বিরুদ্ধে এই আঘাত যারা হানছে তারা ভুলে গেছে—মানষকে অপমান করে তারা আজ নিজেদেরই অপমানিত করছে । একজন দুরে ঠেলে দিয়ে তারা নিজেরাই অধঃপতনের গহবরের দিকে ডুবে যাচ্ছে। এই অপরকে ছোট করার মনোবৃত্তি যদি অচিরে লুপ্ত না হয় তাহলে সমগ্র মানবজাতির সম্মুখে এক সর্বনাশা ধ্বংস ও অপমৃত্যু ঘনিয়ে আসবে। সমগ্র মানবজাতি রসাতলে নিমগ্ন হবে ৷