
অ্যাকোয়ারিয়ামের পরিচর্যা ও মাছ ছাড়ার উপযোগী করা
রঙিন মাছ
অনেকে বাড়িতে কুকুর, বেড়াল, পাখি পোষার মতো কাচের অ্যাকোয়ারিয়ামে রঙিন মাছ পুষে থাকেন। অ্যাকোয়ারিমে মাছ চাষ একটি সৌখিনতা। কাচের চৌবাচ্চাকে বলে অ্যাকোয়ারিয়াম। অ্যাকোয়ারিয়ামে যে মাছ পালন করা হয় তা সবই প্রায় রঙিন মাছ। প্রকৃতি এদের সৃষ্টি করেছেন অপূর্ব কারিগরিতে। গায়ের রঙেও আছে মনোরম বৈচিত্র্য।
অ্যাকোয়ারিয়াম বড়ও হতে পারে আবার ছোটও হতে পারে। যে যার রুচি অনুযায়ী অ্যাকোয়ারিয়াম কিনে তাতে মাছ ছাড়েন। এখন নানা ধরনের অ্যাকোয়ারিয়াম কিনতে পাওয়া যায়। ভেতরে বাল্ব লাগিয়ে আলোর ব্যবস্থাও করা যায়। এতে অন্ধকারেও মাছের খেলাধূলা ও গতিবিধি লক্ষ্য করা যায়। অ্যাকোয়ারিয়ামের ওপরে একটা ঢাকনা দেওয়া থাকে। এই ঢাকনা এমনভাবে তৈরি করা হয় যাতে খোলা ও বন্ধ করা যায়। খাবার দেওয়ার সময় এই ঢাকনা খুলে খাবার দিতে হয়।
রঙিন মাছ তার বর্ণবৈচিত্র্য ও দৈহিক গঠনের জন্য সকলের কাছে খুব আকর্ষণীয় ও জনপ্রিয়। 1805 সালে ইংল্যাণ্ডের রিজেন্টস পার্কে প্রথম জনসমক্ষে রঙিন মাছের অ্যাকোয়ারিয়াম প্রদর্শিত হয়। 1928 সালে এই অ্যাকোয়ারিয়ামের সংখ্যা ইংল্যাণ্ডে 45টি ও বর্তমানে সারা বিশ্বে প্রায় 500টির মতো আছে। ভারতবর্ষে অ্যাকোয়ারিয়ামে রঙিন মাছ পালনের শখটি প্রায় 70-80 বছর ধরে প্রচলিত। অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র পরিসরে ও ন্যূনতম পরিচর্যা করে অ্যাকোয়ারিয়াম অতি সহজেই রঙিন মাছের পালন করা সম্ভব। গৃহশোভা বর্ধনে ও মানসিক অবসাদ দূরীকরণে অ্যাকোয়ারিয়ামে রঙিন মাছের প্রতিপালন করা হয়। মনস্তত্ত্ববিদদের মতে রঙিন মাছের অ্যাকোয়ারিয়াম মানসিক রোগীর চিকিৎসায় সাহায্য করে। যুগ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বাড়িতে এমনকি বড় বড় পার্ক, বাণিজ্যিক কেন্দ্র, অফিসেও বিভিন্ন আকারের অ্যাকোয়ারিয়ামে রঙিন মাছ প্রতিপালনের চাহিদা উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে।
আমাদের দেশে বিশেষত পূর্ব ও উত্তর–পূর্ব ভারতের নদ–নদী ও অন্যান্য প্রাকৃতিক জলাশয়গুলিতে বিভিন্ন প্রকারের রঙিন মাছ পাওয়া যায়। বৈদেশিক বাজারে এসব রঙিন মাছের চাহিদা খুব বেশি। বাজারে ব্যাপক চাহিদার জন্য রঙিন মাছের প্রজনন বর্তমানে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। বিজ্ঞানভিত্তিক ও প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের দ্বারা রঙিন মাছের প্রজাতিনির্ভর প্রজনন পদ্ধতি কিছু মাছের ক্ষেত্রে উপলব্ধ হলেও এখনও অনেক প্রজাতির মাছের ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক ও প্রণোদিত প্রজনন সম্পর্কিত তথ্য আহরণের জন্য বিস্তর গবেষণার প্রয়োজন। বিশেষত সামুদ্রিক রঙিন মাছের ক্ষেত্রে এর প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।
বর্তমানে আমাদের দেশে রঙিন মাছের রপ্তানি সাধারণত প্রাকৃতিক উৎস থেকে সংগৃহীত স্বাদু জলের মাছের মধ্যে সীমাবদ্ধ। অপর পক্ষে সামুদ্রিক রঙিন মাছের বৈচিত্র্য ও পর্যাপ্ত উৎস থাকা সত্ত্বেও পরিকল্পনা ও পরিকাঠামোর অভাবে এই প্রাকৃতিক সম্পদের যথাযথ ব্যবহার করা সম্ভব হচ্ছে না। এক্ষেত্রেও প্রচুর উন্নতির সুযোগ রয়েছে। বর্তমানে আমাদের দেশের পশ্চিমবঙ্গ তথা কলকাতা থেকে সবচেয়ে বেশি রঙিন মাছ বিদেশে রপ্তানি হয়। রঙিন মাছের প্রজনন, প্রতিপালন ও তার অনুসারী বাণিজ্য আমাদের জাতীয় আয় বৃদ্ধিতে, বেকারত্ব দূরীকরণে ও সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মানের উন্নয়নে সহায়ক হয়েছে ও আরও সম্ভাবনা রয়েছে। এ কারণে রঙিন মাছের প্রজনন ও প্রতিপালন বাণিজ্যিক জলনির্ভর চাষের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে।
অ্যাকোয়ারিয়াম
মাছ রাখবার কাচের ছোট বা বড় চৌবাচ্চাকে অ্যাকোয়ারিয়াম বলে। বিভিন্ন মাপের এই চৌবাচ্চার আয়তন অনুযায়ী মাছের আয়তন ও সংখ্যা ঠিক রাখতে হবে। অ্যাকোয়ারিয়ামের আকৃতি, আকার, সরঞ্জাম, স্থাপনের জায়গা ইত্যাদি নির্ধারণ করার জন্য উদ্দেশ্য, নিরাপত্তা ও তার পরিবেশ নিয়ন্ত্রণের সুবিধা সব কিছু বিবেচনা করে ঠিক করতে হয়।
অ্যাকোয়ারিয়ামের প্রকারভেদ :
বিভিন্ন প্রকার স্বচ্ছ, টেঁকসই, জলের সঙ্গে রাসায়নিক বিক্রিয়া হয় না ও সহজলভ্য এমন পদার্থ দিয়ে অ্যাকোয়ারিয়াম তৈরি করতে হয়। যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে প্রযুক্তিগত উন্নয়নের জন্য অ্যাকোয়ারিয়াম তৈরির পদ্ধতির ক্রমশ উন্নতি হচ্ছে। এখানে বিভিন্ন ধরনের অ্যাকোয়ারিয়ামের আলোচনা করা হলো—
ধাতব কাঠামোযুক্ত কাচের অ্যাকোয়ারিয়াম : আমাদের দেশে প্রায় 1980 সাল পর্যন্ত ধাতব কাঠামোযুক্ত অ্যাকোয়ারিয়ামের প্রচলন খুব বেশি ছিল। এ ধরনের অ্যাকোয়ারিয়াম সাধারণত লোহা বা স্টিল দ্বারা তৈরি আয়তাকার বা চৌকো কাঠামোয় বিটোমিন জাতীয় পদার্থ দিয়ে নির্ধারিত মাপের কাচের পাত আটকে অ্যাকোয়ারিয়াম নির্মাণ করা হতো। এই বিটোমিনের পুডিং কিছুদিন পর শক্ত ও ভঙ্গুর হয়ে যাওয়ার ফলে ফাটল দেখা দেয় ও ফাটল দিয়ে জল চুঁইয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে। সম্পূর্ণ কাচের তৈরি অ্যাকোয়ারিয়াম বাজারে আসার পর থেকে এই কাঠামোযুক্ত অ্যাকোয়ারিয়ামের জনপ্রিয়তা কমতে থাকে এবং বর্তমানে চাহিদা না থাকায় প্রায় পাওয়াই যায় না। আবার নোনা জলে খুব অল্প সময়ে ধাতব কাঠামো নষ্ট হয়ে যায় তাই সামুদ্রিক বা নোনা জলের মাছের ক্ষেত্রে ধাতব কাঠামোযুক্ত অ্যাকোয়ারিয়ামের ব্যবহারের জনপ্রিয়তা খুব তাড়াতাড়ি কমে যায়।
সম্পূর্ণ কাচ নির্মিত অ্যাকোয়ারিয়াম : সিলিকন জাতীয় আঠা আবিষ্কার হওয়ার পর সম্পূর্ণ কাচ নির্মিত অ্যাকোয়ারিয়াম তৈরির সম্ভাবনা দেখা দেয়। এই আঠা দিয়ে কাচের সঙ্গে কাচ খুব সহজেই জোড়া লাগানো সম্ভব। জল বা জলে দ্রবীভূত খনিজ লবণের সঙ্গে কোন রাসায়নিক বিক্রিয়ায় এই আঠার ক্রিয়া নষ্ট হয় না। আবার কাঠামো ছাড়া হওয়ায় এই অ্যাকোয়ারিয়ামের সৌন্দর্যও বেশি। তাই এই অ্যাকোয়ারিয়ামের গ্রহণযোগ্যতা বেশি। এছাড়া কাচ নির্মিত বিভিন্ন ধরনের গোল পাত্র ছোট অ্যাকোয়ারিয়ামের পরিবর্তে ব্যবহার করা যায়।
প্লাস্টিক নির্মিত অ্যাকোয়ারিয়াম : স্বচ্ছ প্লাস্টিকের পাত বা সীট দিয়ে তৈরি অ্যাকোয়ারিয়াম কাচের অ্যাকোয়ারিয়ামের মতো দেখতে সুন্দর হয়। এমনকি কোনো আকর্ষণীয় বস্তুর প্রতিরূপও তৈরি করা যায়। তাই এর গ্রহণযোগ্যতা অনেক বেশি। কিন্তু এর কতকগুলো সীমাবদ্ধতা থাকায় জনপ্রিয়তা অর্জন করা সম্ভব হয়নি। যেমন–
(ক) এর দৈর্ঘ্য 46 সে.মি.-র বেশি করা যায় না।
(খ) নিশ্চিত নিশ্চয়তা কম—যে কোনো সময় চিড় ধরতে পারে।
(গ) এর গায়ে শেওলার আস্তরণ খুব তাড়াতাড়ি পড়ে।
(ঘ) যে কোনো প্রকারের আলো ব্যবহার করা যায় না ।
তবে, প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের জন্য বা অন্য কারণে স্থানান্তরণের জন্য এই অ্যাকোয়ারিয়াম সুবিধাজনক। এছাড়া, ছোট মাছের প্রজনন আধার ও রোগাক্রান্ত মাছকে আলাদা রাখার জন্যও ব্যবহার করা যায়।
ছাঁচের অ্যাক্রাইলিক ট্যাঙ্ক : ছাঁচের অ্যাক্রাইলিক ট্যাঙ্কও রঙিন মাছ প্রতিপালন ও প্রজননের কাজে ব্যবহার করা যায়। এতে রাখা মাছ দেখতে সুন্দর লাগে না তাই প্রতিপালনের জন্য এই ট্যাঙ্ক ব্যবহার করা হয় না। তবে প্রজননের কাজে ব্যবহার করা যায়। ব্যবহার করলে খুব যত্ন করে ব্যবহার করতে হয়, কারণ এতে খুব সহজেই দাগ বা স্ক্র্যাচ পড়ে।
অ্যাকোয়ারিয়ামের আকৃতি : অ্যাকোয়ারিয়ামের আকৃতি গোলাকার, বর্গাকার, আয়তাকার, ডিম্বাকার, ষড়ভূজাকার এবং অষ্টভূজাকার হয়। তবে শুধুমাত্র কাচ দিয়ে তৈরি আয়তাকার অ্যাকোয়ারিয়ামের গ্রহণযোগ্যতা সবচেয়ে বেশি।
অ্যাকোয়ারিয়ামের আকার ও মাছ ধারণ ক্ষমতা : অ্যাকোয়ারিয়াম বিভিন্ন আকারের ও আয়তনের হয়। অ্যাকোয়ারিয়ামের আকার নির্বাচনের সময় জলের উপরিতলের ক্ষেত্রফল বিবেচনা করতে হয় যাতে ক্ষেত্রফল বেশি হয়। সাধারণত অ্যাকোয়ারিয়ামের দৈর্ঘ্য যত হয় প্রস্থ ও গভীরতা তার অর্ধেক হয়। তবে প্রস্থ ও উচ্চতা কখনো 2 ফুটের বেশি হওয়া ঠিক নয়। অ্যাকোয়ারিয়ামের আয়তন অনুযায়ী মাছের সংখ্যা নির্ভর করে। যেমন—
দৈর্ঘ্য (সে.মি.) |
প্রস্থ (সে.মি.) |
গভীরতা (সে.মি.) |
অ্যাকোয়ারিয়ামের ক্ষেত্রফল (বর্গ সে.মি.) |
জল ধারণ ক্ষমতা (লিটার) |
জলের ওজন (কিলোগ্রাম) |
সর্বাধিক মাছের সংখ্যা |
30 |
15 |
15 |
450 |
8 |
8 |
15 |
45 |
25 |
25 |
1125 |
35 |
35 |
38 |
60 |
30 |
30 |
1800 |
67 |
67 |
60 |
90 |
30 |
30 |
2700 |
101 |
101 |
90 |
120 |
30 |
30 |
3600 |
135 |
135 |
120 |
জলের উপরিতলের ক্ষেত্রফল ও মাছ ধারণ ক্ষমতা : সাধারণত শীতল জলের মাছের অক্সিজেন চাহিদা উষ্ণ জলের মাছের থেকে বেশি হয়। আবার জলের তাপমাত্রা কম হলে জলের অক্সিজেন ধারণ ক্ষমতা উষ্ণ জলের থেকে বেশি হয়। অর্থাৎ অ্যাকোয়ারিয়ামের মাছ ধারণ ক্ষমতা জলের তাপমাত্রা, মাছের প্রজাতি ও অ্যাকোয়া– রিয়ামের উপরিতলের ক্ষেত্রফলের উপর নির্ভর করে। তবে বিভিন্ন প্রকারের ফিল্টার, বায়ু সঞ্চালক যন্ত্র ও জলের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রক যন্ত্র ব্যবহার করে অ্যাকোয়ারিয়ামের মাছ ধারণ ক্ষমতা বাড়ানো সম্ভব।
অ্যাকোয়ারিয়ামের |
অ্যাকোয়ারিয়ামের উপরিতলের ক্ষেত্রফল |
মাছের সংখ্যা |
50 |
288 |
24 |
62.5 |
288 |
24 |
62.5 |
360 |
30 |
75 |
288 |
24 |
101 |
450 |
37 |
119 |
450 |
37 |
142 |
540 |
45 |
172 |
648 |
54 |
187 |
702 |
58 |
200 |
756 |
63 |
226 |
756 |
63 |
249 |
702 |
58 |
267 |
864 |
72 |
298 |
1080 |
90 |
302 |
864 |
72 |
379 |
1080 |
90 |
মাছের প্রজাতি অনুযায়ী অ্যাকোয়ারিয়ামের ধারণক্ষমতা : বিভিন্ন ভৌগোলিক অঞ্চলে বসবাসকারী মাছের জন্য অ্যাকোয়ারিয়ামের উপরিতলের নির্দিষ্ট ক্ষেত্রফলের জায়গা প্রয়োজন। যেমন—
উষ্ণ অঞ্চলে মিষ্টি জলের প্রতিটি মাছের জন্য অ্যাকোয়ারিয়ামের উপরিতলের 30 বর্গ সেন্টিমিটার জায়গা প্রয়োজন হয়। শীতল মিষ্টি জলের প্রতিটি মাছের ক্ষেত্রে এই জায়গা 75 বর্গ সেন্টিমিটার ও উষ্ণ সামুদ্রিক মাছের জন্য 120 বর্গ সেন্টিমিটার। সাধারণত মাছের দৈর্ঘ্য অনুযায়ী ছোট প্রজাতির মাছের (যেমন টেট্রা, প্লাটি ইত্যাদি) ক্ষেত্রে প্রতি 1 ইঞ্চি মাপের জন্য 3.78 লিটার বা 1 গ্যালন জল প্রয়োজন এবং বড় প্রজাতির মাছ (যেমন— অস্কার, চ্যানেল ক্যাটফিশ, পিরানহা ইত্যাদি) সামুদ্রিক মাছ (যেমন–ব্লু গ্যামসেল, ক্লেইনস বাটারফ্লাই, পারকুলা ক্লাউনস ইত্যাদি) এবং ঠাণ্ডা জলের মাছ (যেমন—গোল্ডফিশ, ড্রাগনফিশ, গারস, বাশ ইত্যাদি)-এর ক্ষেত্রে প্রতি 1 ইঞ্চি মাছের জন্য ন্যূনতম 11 লিটার বা 3 গ্যালন জল প্রয়োজন। আবার মাছের ওজন অনুযায়ী, প্রতি 1 গ্রাম মাছের জন্য ন্যূনতম 4 লিটার জল প্রয়োজন। অর্থাৎ মাছ অ্যাকোয়ারিয়ামে ছাড়ার আগে মাছের প্রজাতির উৎস ও অ্যাকোয়ারিয়ামের উপরিতলের ক্ষেত্রফল হিসাব করে মাছের সংখ্যা নির্ধারণ করতে হয়। তবে অ্যাকোয়ারিয়ামের পরিবেশ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থাপনার উপরও ধারণ ক্ষমতা নির্ভর করে।
অ্যাকোয়ারিয়ামের ঢাকনা
অ্যাকোয়ারিয়ামের ঢাকনা নির্বাচন করা একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ এই ঢাকনার ভূমিকা অনেক। যেমন—
(ক) ঢাকনা অ্যাকোয়ারিয়ামের জলের বাষ্পীভবন প্রতিরোধ করে।
(খ) নোংরা ধুলো, বালি, পোকামাকড় অ্যাকোয়ারিয়ামের জলে পড়তে দেয় না।
(গ) যে কোনো কারণে মাছ বিরক্ত হলে অ্যাকোয়ারিয়ামের বাইরে আসতে দেয় না।
(ঘ) বৈদ্যুতিক যন্ত্রের ও অ্যাকোয়ারিয়াম সজ্জার ধারক হিসাবেও ব্যবহৃত হয়।
অ্যাকোয়ারিয়ামের ঢাকনা বিভিন্ন প্রকার পদার্থের তৈরি হয়। সাধারণত অ্যালুমিনিয়াম, টিন, ফাইবার গ্লাস, এমনকি কাঠেরও হয়। তবে, নকশা করা বা সাধারণ পাতলা কাচের ঢাকনার প্রচলন ইদানীং শুরু হয়েছে। অ্যাকোয়ারিয়ামের ঢাকনা যেমনই হোক না কেন তার কতকগুলি সাধারণ বৈশিষ্ট্য থাকা প্রয়োজন। যেমন—
(ক) ঢাকনা কাচের না হলে অ্যাকোয়ারিয়ামের ভেতরের দিকে অয়েল পেইন্ট করতে হয়। এতে আলোর ঔজ্জ্বল্য বাড়ে ও ঢাকনা টেঁকসই হয়।
(খ) ঢাকনাটি এমনভাবে করতে হয় যাতে সামনের ও পিছনের অংশ ঢালু থাকে ও মধ্যাংশ উঁচু থাকে।
(গ) ঢাকনাতে অতি অবশ্যই বায়ু চলাচলের ব্যবস্থা রাখতে হয়। এছাড়া মাছের খাদ্য দেওয়ার জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থাও রাখতে হয়।
অ্যাকোয়ারিয়াম স্থাপনের জায়গা
অ্যাকোয়ারিয়াম হল জলজ বাস্তুতন্ত্রের প্রতিরূপ। জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদ, আনুবীক্ষণিক জীব ও জড় উপাদানের সহাবস্থান এখানে বিদ্যমান। জল, আলো, জলে দ্রবীভূত বিভিন্ন খনিজ পদার্থ ও গ্যাস হলো এই বাস্তুতন্ত্রের জড় উপাদান। তাই অ্যাকোয়ারিয়াম কোথায় স্থাপন করবেন তা ঠিক করতে হয়। কারণ বাস্তুতন্ত্রের জড় উপাদানের সহজলভ্যতা যা সজীব উপাদানের অনুকূল পরিবেশ রক্ষণাবেক্ষণে সহায়ক হয় তা প্রাথমিক বিচার্য বিষয়।
দ্বিতীয়ত, এমন স্থানে স্থাপন করতে হয় যাতে দর্শক যেন খুব সহজেই অ্যাকোয়ারিয়ামের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারে। অর্থাৎ দর্শক যে অবস্থায় অ্যাকোয়ারিয়ামটি দেখতে চায় সেই অবস্থায় অ্যাকোয়ারিয়ামের অবস্থান দর্শকের চোখের উচ্চতায় রাখা বাঞ্ছনীয়
তৃতীয়ত, অ্যাকোয়ারিয়ামটি কোন মজবুত টেবিল বা এমন কিছুর ওপর রাখতে হবে যাতে কোনোরকম দুর্ঘটনা না ঘটে।
অ্যাকোয়ারিয়াম সাধারণত বাড়ি, অফিস, ডাক্তারখানা, বড় বড় শপিং মল, বেসরকারি নার্সিংহোম ও হাসপাতাল, এয়ারপোর্ট প্রভৃতি স্থানে দেখতে পাওয়া যায়। তবে স্থাপনের জায়গা ও উপযোগিতা অনুযায়ী অ্যাকোয়ারিয়ামের আকৃতি, আকার ও স্থাপনের স্থান নির্বাচন করা হয়। অ্যাকোয়ারিয়াম স্থাপনের স্থান নির্বাচনের সময় যে যে বিষয়গুলি বিবেচনা করতে হয় সেগুলি হল—
1. অ্যাকোয়ারিয়াম যে স্থানেই স্থাপন করা হোক না কেন সেখানে সরাসরি সূর্যালোক বা রোদ পড়া ঠিক নয়। তবে পর্যাপ্ত আলো ও বাতাস যেন থাকে। অ্যাকোয়ারিয়ামে সরাসরি বেশি সময় যাবৎ সূর্যালোক পড়লে জলের তাপমাত্রার তারতম্য ঘটে ও মাছের মড়ক দেখা দেয় এবং শেওলার অতিরিক্ত বৃদ্ধি হয়। শেওলার আধিক্যের ফলে অ্যাকোয়ারিয়ামের জল অস্বচ্ছ হয়। কাচের দেওয়ালে শেওলার প্রলেপ পড়ে ও সর্বোপরি জলের গুণগতমান মাছের বসবাসের অনুকূল থাকে
না ।
2. অ্যাকোয়ারিয়াম স্থাপনের সময় অতি অবশ্যই তা একটি থার্মোকলের চাদরের ওপর রাখতে হবে। অ্যাকোয়ারিয়াম ছোট হলে 0.5 ইঞ্চি পুরু ও বড় হলে 0.75 ইঞ্চি পুরু থার্মোকলের চাদর ব্যবহার করতে হবে।
3. অ্যাকোয়ারিয়ামে ব্যবহারের জন্য এয়ার পাম্প, ফিল্টার, বৈদ্যুতিক আলো ইত্যাদি চালু করতে অ্যাকোয়ারিয়ামের কাছাকাছি বৈদ্যুতিক সংযোগের ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন।
4. শীতকালে যাতে সরাসরি ঠাণ্ডা হাওয়া বেশি সময় যাবৎ অ্যাকোয়ারিয়ামে না লাগতে পারে তার ব্যবস্থা রাখতে হয়।
5. অ্যাকোয়ারিয়াম স্থাপনের জায়গায় হঠাৎ কম্পন ও জোরালো শব্দ যেন না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। এবং অতি অবশ্যই সারাক্ষণ লোকজনের যাতায়াত হয় এমন জায়গায় রাখা যাবে না ।
6. অ্যাকোয়ারিয়ামের যেকোনো একটি দেওয়াল ঘরের কোনো দেওয়ালের সঙ্গে লাগিয়ে রাখতে হবে।
অ্যাকোয়ারিয়ামকে মাছ ছাড়ার উপযোগী করা
অ্যাকোয়ারিয়াম যোগাড় হয়ে গেলেই তাতে জল ভরে রঙিন মাছ ছেড়ে দিলেই হয় না। অ্যাকোয়ারিয়ামটিকে মাছ ছাড়ার উপযোগী করে তারপর মাছ ছাড়লে সফলভাবে রঙিন মাছ প্রতিপালন করা সম্ভব। ধাপগুলি হলো–
(1) অ্যাকোয়ারিয়াম পরিষ্কার করা : অ্যাকোয়ারিয়াম নতুন বা অনেকদিন ফেলে রাখা পুরানো যেমনই হোক না কেন প্রথমে অ্যাকোয়ারিয়ামটিকে ভালো করে পরিষ্কার করতে হয়। তারপর নতুন অ্যাকোয়ারিয়াম হলে তাতে পরিষ্কার জল ভরে রেখে দিলে কাচ লাগানো আঠা বা অন্য কোনো রাসায়নিক পদার্থ জলে যুক্ত হয়। একদিন পর জল পরিবর্তন করতে হয়। পর পর কয়েকদিন জল পরিবর্তন করলে অ্যাকোয়ারিয়ামটি পরবর্তী ধাপের জন্য তৈরি হয়।
(2) অ্যাকোয়ারিয়ামের তলদেশ তৈরি : সাধারণত অ্যাকোয়ারিয়ামের তলদেশ বালি ও পাথর দিয়ে তৈরি করতে হয়। নির্বাচিত প্রজাতির মাছের রঙের সঙ্গে পার্থক্য করা যায় এমন রঙের পাথর দিয়ে অ্যাকোয়ারিয়ামের তলদেশ তৈরি করতে হয়। এতে সহজেই মাছের রঙের সৌন্দর্য নজরে পড়ে। আমাদের দেশের মিষ্টি জলের রঙিন মাছের জন্য গাঢ় রঙের পাথর ব্যবহার করা হয়। অন্যদিকে সামুদ্রিক বা নোনা জলের মাছের অ্যাকোয়ারিয়ামের তলদেশের পাথরের রঙের গুরুত্ব কম।
অ্যাকোয়ারিয়ামে ব্যবহারের আগে পাথরের বা মোটা দানার বালি কয়েকবার পরিষ্কার জলে ধুয়ে রোদে শুকিয়ে নিতে হয়। প্রথমে গরম জলে ও পরে ঠাণ্ডা জলে ধুয়ে নিতে হয়। অ্যাকোয়ারিয়ামের নিম্নতলের স্তরটি বেশি পরিমাণে পাথর দিয়ে অন্তত 1.5-2.0 ইঞ্চি পুরু করা প্রয়োজন। তলদেশের স্তরটি অ্যাকোয়ারিয়ামের পিছনদিকে পুরু ও সম্মুখভাগে ক্রমশ পাতলা হলে ভালো হয়। সামনের দিকে স্তরটি 1 ইঞ্চি ও পিছনের দেওয়ালের দিকে 3 ইঞ্চি পুরু করতে হয় এবং বালি দিয়ে স্তরটি তৈরি করা যায় না। কখনও চুনাপাথর বা সরু বালি ব্যবহার করা উচিত নয়। সাধারণত অ্যাকোয়ারিয়ামের উপরিতলের ক্ষেত্রফল 90 বর্গ সেন্টিমিটার ও পিছনের দেওয়াল থেকে সামনের দেওয়ালের ঢাল 5:1 হলে 10 লিটারের বালতির 1 বালতি বালি বা পাথর লাগে।
(3) অ্যাকোয়ারিয়ামে জল দেওয়া : মাছের প্রকৃতি অনুযায়ী অ্যাকোয়ারিয়ামের জলের প্রকৃতি ঠিক করতে হয়। তবে অবশ্যই দূষণমুক্ত জল ব্যবহার করতে হয়। কখনো অ্যাকোয়ারিয়ামের ধারণক্ষমতা পূর্ণ করে জল ভর্তি করতে হয় না। অ্যাকোয়ারিয়ামের জলের উপরিস্তরের ও অ্যাকোয়ারিয়ামের ঢাকনার মধ্যে 2-4 ইঞ্চি ফাঁকা জায়গা রাখতে হয়, যদিও মাছের প্রজাতির ওপর এই জায়গার উচ্চতা নির্ভর করে। যেসব মাছ বেশি চঞ্চল প্রকৃতির হয় তাদের জন্য উচ্চতা বেশি রাখতে হয়। অ্যাকোয়ারিয়ামে খুব সতর্কভাবে জল ভর্তি করতে হয়। অ্যাকোয়ারিয়ামের তলদেশে নলের একটি প্রান্ত বা কোনো পাত্র স্থাপন করে জল ভর্তি করলে তলদেশের উপকরণের সজ্জা এলোমেলো হতে পারে না।
(4) অ্যাকোয়ারিয়ামে জলজ উদ্ভিদ রোপণ করা : অ্যাকোয়ারিয়ামের একটি অপরিহার্য উপাদান হল জলজ উদ্ভিদ। জলজ উদ্ভিদ বিভিন্ন প্রকারের হয়। অ্যাকোয়ারিয়ামের প্রকৃতি ও আকার অনুযায়ী বিভিন্ন প্রকার জলজ উদ্ভিদ নির্বাচন করতে হয়। জলজ উদ্ভিদ নির্বাচনের সময় যাতে সমস্ত রকমের উদ্ভিদ ভালোভাবে দেখতে পাওয়া যায় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হয়। অ্যাকোয়ারিয়ামের জন্য নির্বাচিত জলজ উদ্ভিদগুলি সংগ্রহ করে প্রথমে পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট দ্রবণে (100 মিলিগ্রাম পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট 10 লিটার জলে) বা লবণ জলে (125 গ্রাম লবণ 10 লিটার জলে) 10-15 মিনিট ডুবিয়ে শোধন করতে হয়। এরপর মিথিলিন ব্লু বা ম্যালাকাইট গ্রিন মিশ্রিত জলে ডুবিয়ে নিতে হয়। মূলের কোনো রকম ক্ষতি না করে জলজ উদ্ভিদ রোপণ করতে হয়। ঝুপো উদ্ভিদ রোপণ করার সময় জায়গামতো স্থাপনের জন্য পাথর মূলের সঙ্গে বেঁধে দিতে হয়। নিমজ্জিত জলজ উদ্ভিদের মূল অ্যাকোয়ারিয়ামের বিছানো বালির মধ্যে রোপণ করতে হয়। সাধারণত বড় প্রজাতির জলজ উদ্ভিদ অ্যাকোয়ারিয়ামের পিছনের অংশে, তারপর মাঝারি প্রজাতির ও একেবারে সামনে ছোট প্রজাতির উদ্ভিদ লাগাতে হয়।
(5) অ্যাকোয়ারিয়ামের প্রয়োজনীয় উপকরণ স্থাপন : অ্যাকোয়ারিয়ামে মাছ প্রতিপালনের সাফল্য অ্যাকোয়ারিয়ামের জলজ পরিবেশ নির্বাচিত মাছের প্রজাতির বসবাসের অনুকূল রাখার উপর নির্ভর করে। বিভিন্ন প্রকার কৌশল ও সামগ্রী ব্যবহার করে অ্যাকোয়ারিয়ামের জলজ পরিবেশ প্রয়োজনভিত্তিক নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। সাধারণত যেসব কৌশল ব্যবহার করা হয় সেগুলি হলো–
(ক) তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ : গ্রীষ্মমণ্ডলীয় মাছেদের জন্য জলের অনুকূল তাপমাত্রা হলো 25-30 ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। সাধারণত অ্যাকোয়ারিয়ামের জলের তাপমাত্রা 22-28 ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। জলের তাপমাত্রা পরিমাপ করতে থার্মোমিটার ব্যবহার করতে হয়। সাধারণত অ্যাকোয়ারিয়ামের পিছনের দেওয়ালে থার্মোমিটার স্থাপন করা হয়।
শীতকালে হিটার ব্যবহার করে জলের তাপমাত্রা বাড়ানো হয়। জলের তাপমাত্রা সর্বদা নির্দিষ্ট রাখার জন্য থার্মোস্ট্যাট সহ হিটার ব্যবহার করা যায়। এতে সর্বদা জলের নির্দিষ্ট তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হয়।
(খ) দ্রবীভূত অক্সিজেন নিয়ন্ত্রণ : মাছের স্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য জলে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ অনুকূল মাত্রার মধ্যে রাখতে হয়। এছাড়া জলে দ্রবীভূত দূষিত গ্যাসের পরিমাণ নির্দিষ্ট সীমার নিচে রাখতে হয়। সাধারণত অ্যাকোয়ারিয়ামে বায়ু সঞ্চালক যন্ত্র বা এয়ার পাম্প ব্যবহার করে জলের অক্সিজেন ও দূষিত গ্যাস দুই–ই নিয়ন্ত্রণ করা হয়।
ছোট অ্যাকোয়ারিয়ামের জন্য এরেটর (এয়ার পাম্প) ব্যবহার করা যায়। এই যন্ত্র থেকে একটি নল অ্যাকোয়ারিয়ামের মধ্যে দিতে হয় যার প্রান্তে এয়ার স্টোন বা লিচু লাগানো থাকে। যন্ত্রটির অন্য প্রান্তে বৈদ্যুতিক সংযোগ দেওয়া থাকে। যন্ত্রটি চালু করলে হাওয়া অ্যাকোয়ারিয়ামের জলে এয়ার স্টোন দিয়ে বুদবুদ আকারে বের হতে থাকে ফলে জলের অক্সিজেন বাড়ে ও দূষিত গ্যাস বাইরে নির্গত হয়।
(গ) জল পরিশ্রুতকরণ : মাছের বিপাকীয় বর্জ্য পদার্থ, মাছের অব্যবহৃত খাদ্য ও জলজ উদ্ভিদের পচনশীল অংশ অ্যাকোয়ারিয়ামে জমা হয়ে জলের গুণগত মানের পরিবর্তন করে ও প্রতিকূল পরিবেশের সৃষ্টি হয়। তাই এসব পদার্থ অ্যাকোয়ারিয়ামে জমতে না দেওয়ার জন্য নিয়মিত পরিশোধন বা পরিস্ফুত করতে হয়। সাধারণত ফিল্টার ব্যবহার করে পরিস্রুত করা হয়। অ্যাকোয়ারিয়ামের প্রকৃতি ও পরিস্থিতি অনুযায়ী যান্ত্রিক, রাসায়নিক ও জৈবিক ফিল্টার ব্যবহার করা হয়।
(i) যান্ত্রিক ফিল্টার : এই ফিল্টার স্পঞ্জ, কাঠকয়লার গুঁড়ো, নাইলনের তুলো এমনকি জমাট বাঁধা পচা পাতাও ব্যবহার করে তৈরি করা হয়। এই পদ্ধতিতে জল পরিস্রুত করতে অ্যাকোয়ারিয়ামের জল ফিল্টারের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত করানো হয় ও জলের নোংরা ফিল্টারের স্তরে আটকে যায়।
(ii)জৈবিক ফিল্টার : এই ফিল্টারের উপকারী ব্যাকটেরিয়া ব্যবহার করা হয় যা জলের ক্ষতিকারক পদার্থকে অপেক্ষাকৃত কম ক্ষতিকারক পদার্থে রূপান্তরিত করে।
(iii)রাসায়নিক ফিল্টার : এই প্রক্রিয়ায় জলের নোংরা ফিল্টারের রাসায়নিক পদার্থ দ্বারা দূরীভূত হয়।
বিভিন্ন প্রকার ফিল্টারে বিভিন্ন প্রকার উপাদান ব্যবহার করা হয়। তাই অ্যাকোয়ারিয়ামের প্রকৃতি অনুযায়ী ফিল্টার নির্বাচন করতে হয়।
নানা ধরনের ফিল্টার :
★ কর্ণার ফিল্টার : একটি চোঙাকার প্লাস্টিকের ধাত্রের দুই প্রান্ত সছিদ্র ঢাকনাযুক্ত হয়। ধাত্রের মধ্যে ফোমের স্তর ও বায়ু উত্তোলক পাম্পের নল থাকে। পাম্প চালু করলে অ্যাকোয়ারিয়ামের জল এই ফিল্টারের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয় ও জলের নোংরা ফোমের স্তরে আটকে যায়।
★ ট্রিবল ফিল্টার : একটি বাহ্যিক ফোম ফিল্টারের সঙ্গে ছিদ্র বিশিষ্ট কতকগুলি ট্রে থাকে। ট্রে–গুলি অ্যাকোয়ারিয়ামের ওপরে স্থাপন করা হয়। অ্যাকোয়া– রিয়ামের জল ফোম ফিল্টার হয়ে সবচেয়ে উপরের ট্রেতে পৌঁছায় ও ট্রের ছিদ্র দিয়ে জমে সব থেকে নিচের ট্রেতে আসে এবং অবশেষে পরিস্রুত জল অ্যাকোয়ারিয়ামে যায়।
★আণ্ডার গ্রাভেল ফিল্টার : একটি ছিদ্র সমন্বিত প্লাস্টিকের প্লেট অ্যাকোয়ারিয়ামের নুড়ি স্তরের নিচে আনুভূমিকভাবে বসানো থাকে। একটি বায়ু নল জলকে নুড়ি স্তরের মধ্যে দিয়ে পুনরায় অ্যাকোয়ারিয়ামে ফিরিয়ে আনে। একটি এয়ার লিফ্ট পাম্প বা বায়ু উত্তোলক পাম্প প্লেটটির সঙ্গে উল্লম্বভাবে বসানো থাকে। এই নলের মধ্য দিয়ে বায়ু প্রবাহিত হলে অ্যাকোয়ারিয়ামের জল নুড়ি স্তরের নিচে দিয়ে প্রবাহিত হয় ও পুনরায় পাম্পের দিক হয়ে জল অ্যাকোয়া– রিয়ামের মূল অংশের জলে মেশে এবং ফিল্টারের নুড়ি স্তরটি ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধি ঘটায় ও ভাসমান পদার্থ পরিস্রুত করে। অ্যামোনিয়া পর্যায়ক্রমে জারিত হয়ে নাইট্রাইট ও পরে নাইট্রেটে রূপান্তরিত হয় ও সবশেষে জল পরিস্রুত হয়। কেবলমাত্র আণ্ডার গ্রাভেল ফিল্টার ব্যবহার করলে কিছুদিন পর ফিল্টারের গায়ে বিশেষ করে প্লেটের ছিদ্রগুলো বন্ধ হয়ে যায় ও কর্মক্ষমতা কমে যায়। তাই অন্য একটি প্রি–ফিল্টার ব্যবহার করলে এই সমস্যা কম হয়। সাধারণত পাওয়ার ফিল্টার প্রি–ফিল্টার হিসাবে ব্যবহার করা হয়।
★পাওয়ার ফিল্টার : পাওয়ার ফিল্টার দু‘রকমের। যথা—আভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক পাওয়ার ফিল্টার হয় ।
আভ্যন্তরীণ পাওয়ার ফিল্টার
এই ফিল্টার ছোট ও মাঝারি মাপের অ্যাকোয়ারিয়ামের জন্য ব্যবহৃত হয়। অ্যাকোয়ারিয়ামের জল ধারণ ক্ষমতা সর্বাধিক 180 লিটারের কম হলে ব্যবহার করা যায়। এই ফিল্টারে একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন পাম্প দিয়ে অ্যাকোয়ারিয়ামের জলকে কতগুলি নাইলন বা স্পঞ্জের স্তরবিশিষ্ট একটি ধাত্রের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত করা হয় ও জল খুব সহজেই পরিশ্রুত হয়। তবে এই ফিল্টারে সক্রিয় চারকোল ব্যবহার করে এর কার্যক্ষমতা অনেকগুণ বাড়ানো যায়।
বাহ্যিক পাওয়ার ফিল্টার
এই ফিল্টার সাধারণত বড় অ্যাকোয়ারিয়ামের জন্য ব্যবহার হয়। এই ফিল্টারে ফিল্টার–স্তর অভ্যন্তরীণ ফিল্টারের তুলনায় অনেক বেশি থাকে। কেবলমাত্র অ্যাকোয়ারিয়ামে জল প্রবেশ ও নির্গমন নল থাকে ও ফিল্টারের বাকি অংশ বাইরে থাকে। এই ফিল্টারের স্তরগুলি পরিষ্কার করা খুব সহজ।
(6) অ্যাকোয়ারিয়ামের সৌন্দর্য বৃদ্ধি : অ্যাকোয়ারিয়ামের সৌন্দর্য কেবলমাত্র রঙিন মাছের সৌন্দর্যের মধ্যে সীমাবন্ধ না রেখে বিভিন্ন দৃষ্টিনন্দন উপকরণ ব্যবহার করে আরও বেশি আকর্ষণীয় করা যায়।
(ক) আলো—অ্যাকোয়ারিয়ামের সৌন্দর্য বাড়াতে ও জলের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে আলো ব্যবহার করা হয়। যাতে জলের তাপমাত্রা অস্বাভাবিক বেড়ে না যায় সেজন্য অ্যাকোয়ারিয়ামের আকার অনুযায়ী বিভিন্ন শক্তির বৈদ্যুতিক বাল্বের ব্যবহার হয়। আলো যত বেশি সময় জ্বলে জলের তাপমাত্রা তত বাড়ে। তাই অ্যাকোয়ারিয়ামের আকার অনুযায়ী বৈদ্যুতিক আলোর শক্তি ও তার জ্বালিয়ে রাখার সময়কাল খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
অ্যাকোয়ারিয়ামে বৈদ্যুতিক আলোর ব্যবস্থা
অ্যাকোয়ারিয়ামের দৈর্ঘ্য (ইঞ্চি) |
প্রস্থ (ইঞ্চি) |
উচ্চতা (ইঞ্চি) |
বাল্ব(ওয়াট) |
বাল্ব জ্বালানোর সময় (ঘণ্টা) |
18 |
12 |
12 |
60 |
12 |
24 |
12 |
12 |
80 |
10 |
30 |
15 |
15 |
120 |
10 |
36 |
15 |
15 |
120 |
12 |
36 |
18 |
18 |
160 |
10 |
82 |
18 |
18 |
160 |
13 |
82 |
18 |
18 |
180 |
11 |
(খ) বালি, পাথর, প্রবাল, ঝিনুক—অ্যাকোয়ারিয়ামের তলদেশ সাজানোর জন্য ব্যবহৃত উপকরণের রঙ মাছের রঙের থেকে আলাদা হওয়া প্রয়োজন । উষ্ণমণ্ডলীয় মিষ্টি জলের রঙিন মাছের রঙের ঔজ্জ্বল্য কম হওয়ায় অ্যাকোয়ারিয়ামের তলদেশ গাঢ় রঙের হলে ভালো হয়। অন্যদিকে সামুদ্রিক মাছের রঙের ঔজ্জ্বল্য বেশি হওয়ায় অ্যাকোয়ারিয়ামের তলদেশ হালকা রঙের হলে ভালো হয়। তবে অ্যাকোয়ারিয়ামের তলদেশের উপকরণ যাতে কোনো রকম জলদূষণ বা জলের গুণগত মানের পরিবর্তন না করে সেদিকে নজর দিতে হয়। বালিও অ্যাকোয়ারিয়ামের তলদেশে ব্যবহৃত হয়। তবে অ্যাকোয়ারিয়ামের মোটা দানার বালি বারবার ধুয়ে ও ভালো করে শুকিয়ে ব্যবহার করতে হয়। নানা রঙের (গাঢ় হলুদ, বাদামী) নুড়ি পাথর অ্যাকোয়ারিয়ামে ব্যবহার করা হয়। তবে মিষ্টি জলের অ্যাকোয়ারিয়ামে কখনও চুনাপাথর ব্যবহার করা যায় না। চুনাপাথরের ওপর কয়েক ফোঁটা লঘু হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড বা ভিনিগার ফেললে শব্দসহ রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটে। নুড়ি পাথর সংগ্রহ করে একটি জলপূর্ণ বালতিতে কয়েকদিন রেখে ভালো করে ধুয়ে পরিষ্কার করতে হয়। তারপর অ্যাকোয়ারিয়ামে ব্যবহার করা যায় ।
অ্যাকোয়ারিয়ামের প্রবাল ব্যবহারের জন্য এনে ব্লিচিং পাউডারের দ্রবণে দু‘দিন ভিজিয়ে রেখে তারপর ভালো করে পরিষ্কার জলে ধুয়ে নিতে হবে।
অ্যাকোয়ারিয়ামের জলের প্রকৃতি অনুযায়ী পাথর নির্বাচন :
জলের প্রকৃতি |
ব্যবহারযোগ্য |
অব্যবহারযোগ্য |
মৃদু ও মধ্যম ক্ষার জল |
ব্যাসাল্ট, গ্রানাইট, শ্লেট, কোয়ার্টজ, শক্ত বালি, |
দ্রবীভূত পাথর, ঝিনুক |
ক্ষার জল |
দ্রবীভূত পাথর, চুনাপাথর ইত্যাদি |
জলে ধাতু মুক্ত হয় এমন কোনো পাথর |
সামুদ্রিক জল |
ঝিনুক, মৃত ও জীবন্ত প্রবাল, শ্লেট ইত্যাদি |
নরম দ্রবীভূত বালি, পাথর,জলে ধাতু মুক্ত হয় এমন কোনো পাথর ইত্যাদি |
(গ) বগ উড—বগ উড হলো কোনো গাছের কাটা কাষ্ঠল অংশ যেটাকে বোদ মাটি ও জৈব অ্যাসিড প্রয়োগ করে অ্যাকোয়ারিয়ামের ব্যবহার উপযোগী করা হয়। অ্যাকোয়ারিয়ামে বগ উড কেবলমাত্র সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে তাই নয় বিভিন্ন মাছের আশ্রয়স্থল হিসাবে কাজ করে। অ্যাকোয়ারিয়ামে বগ উড ব্যবহারের আগে জলে ভিজিয়ে কাঠের ট্যানিন বের করে নিতে হয় নতুবা পলিইউরিথেন পেন্ট দিয়ে বার্নিশ করে ট্যানিন ক্ষরণ রোধ করতে হয়।
(ঘ) কৃত্রিম সরঞ্জাম—অ্যাকোয়ারিয়ামে নানা ধরনের কৃত্রিম সরঞ্জাম ব্যবহার করা যায়। প্লাস্টিকের তৈরি নানা ধরনের প্রাণী, ডুবুরি ও জলজ উদ্ভিদ ইত্যাদি ব্যবহার হয়। প্লাস্টিকের জলজ উদ্ভিদ ব্যবহারের সুবিধা হল, অনেকদিন ব্যবহার করা যায়, কয়েকদিন অ্যাকোয়ারিয়ামে থাকলে প্রাকৃতিক উদ্ভিদের মতো দেখতে লাগে এবং এদের জন্য আলোর ব্যবস্থা করতে হয় না ।
(7) অ্যাকোয়ারিয়ামে রঙিন মাছ প্রতিপালন : অ্যাকোয়ারিয়াম বিভিন্ন পরিবেশে বিভিন্ন উদ্দেশ্যে বিভিন্ন আকার ও আকৃতির হয় এবং সেইমত মাছের প্রজাতি নির্বাচন করা হয়। আমাদের দেশে নানাবিধ বৈদেশিক ও দেশীয় প্রজাতির রঙিন মাছ পাওয়া যায় ৷ অ্যাকোয়ারিয়ামে এসব মাছ প্রজাতি ভেদে বিভিন্ন প্রকার চরিত্র প্রকাশ করে। যেমন, কিছু প্রজাতির মাছ নিজেদের মধ্যে দলবদ্ধ থাকতে চায়, কিছু প্রজাতির মাছ অন্য প্রজাতির মাছের সঙ্গে সহজেই সহাবস্থানে অভ্যস্ত হয়, কিছু প্রজাতির মাছ অন্য ছোট প্রজাতির মাছের উপস্থিতি সহ্য করতে পারে না, কিছু প্রজাতির মাছ অন্য প্রজাতির মাছকে খেয়ে নেয়। আবার কিছু প্রজাতির মাছ একদলে একাধিক পুরুষ মাছের উপস্থিতি সহ্য করতে পারে না। এইসব জিনিস চিন্তা ভাবনা করে মাছের প্রজাতি নির্বাচন করতে হবে।
অ্যাকোয়ারিয়ামে মাছ ছাড়ার পদ্ধতি
অ্যাকোয়ারিয়াম উপযোগী নির্বাচিত নির্দিষ্ট সংখ্যক মাছ সংগ্রহ করতে হয়। সংগৃহীত মাছ এনে সঙ্গে সঙ্গে অ্যাকোয়ারিয়ামে ছাড়তে হয় না। অ্যাকোয়ারিয়ামের জলের তাপমাত্রার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে হয়। মাছ ছাড়ার 24 ঘণ্টার মধ্যে কোনো প্রকার খাদ্য প্রয়োগ করতে হয় না।
অ্যাকোয়ারিয়াম পরিচর্যা
অ্যাকোয়ারিয়ামে সফলভাবে মাছ প্রতিপালন করতে হলে প্রতিদিন মাছের খাদ্য পরিবেশন করা ছাড়াও নিয়মিত পরিচর্যা করতে হয়। যেমন—
1. অ্যাকোয়ারিয়ামের ভেতরের দেওয়াল সপ্তাহে অন্তত 1 বার পরিষ্কার করতে হয়।
2. জলের তাপমাত্রা যথাসম্ভব পরীক্ষা ও নিয়ন্ত্রণ করতে হয়।
3. অ্যাকোয়ারিয়ামের আকার ও আকৃতি অনুযায়ী মাছের আকৃতি ও সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করতে হয়।
4. মাছের সংখ্যা ও খাদ্য চাহিদা অনুযায়ী নিয়মিত খাদ্য প্রয়োগ করতে হয়।
5. নিয়মিত সাইফন পদ্ধতিতে অ্যাকোয়ারিয়ামের তলদেশে জমা নোংরা পরিষ্কার করতে হয়। জলজ উদ্ভিদের পচা পাতাও নিয়মিত পরিষ্কার করতে হয়।
6. জলের গুণগত মান বজায় রাখতে 2-3 সপ্তাহ অন্তর অ্যাকোয়ারিয়ামের 10-25 শতাংশ জল পরিবর্তন করতে হয়।
7. মরা বা রোগাক্রান্ত মাছ অ্যাকোয়ারিয়াম থেকে সরিয়ে ফেলতে হয়।
৪. অ্যাকোয়ারিয়ামে শেওলার আধিক্য নিয়ন্ত্রণ করতে হয়।
9. অ্যাকোয়ারিয়ামের পারিপার্শ্বিক পরিবেশ দূষণমুক্ত রাখতে হয়।
10. বায়ু সঞ্চালক যন্ত্র, হিটার ও ফিল্টারের কার্যদক্ষতা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করতে হয়।
অ্যাকোয়ারিয়ামে জলের ভৌত ও রাসায়নিক গুণাবলী
যেহেতু মাছ জলচর প্রাণী তাই মাছের সুষ্ঠু প্রতিপালনের জন্য জলের পরিবেশ মাছের স্বাভাবিক বৃদ্ধির অনুকূল রাখতে হয়।
(ক) জলের গভীরতা
যেসব মাছ জলের নিচের স্তরে থাকতে পছন্দ করে তাদের জন্য অ্যাকোয়ারিয়ামের জলের গভীরতা বেশি হলে ভালো হয়। বড় প্রজাতির মাছের ক্ষেত্রেও জলের গভীরতা বেশি হওয়া দরকার। তবে অ্যাকোয়ারিয়ামের গভীরতা প্রস্থের সমান বা সামান্য কম–বেশি করা যায়।
(খ) তাপমাত্রা
বিভিন্ন প্রজাতির মাছ বিভিন্ন তাপমাত্রার জলে বাস করে। তাই অ্যাকোয়ারিয়ামের জলের তাপমাত্রা মাছের প্রজাতি অনুযায়ী নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। তবে, উষ্ণমণ্ডলীয় মাছ সাধারণত 20-30 ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় স্বাভাবিকভাবে বাঁচে
জলের তাপমাত্রা মাছের শরীরের শারীরবৃত্তীয় কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করে। নির্দিষ্ট প্রজাতির মাছের জন্য অ্যাকোয়ারিয়ামের জলের নির্দিষ্ট তাপমাত্রা বজায় রাখতে হয়। তাই অ্যাকোয়ারিয়ামে দুই বা তার বেশি প্রজাতির মাছ প্রতিপালন করতে হলে তাদের জন্য আদর্শ জলের তাপমাত্রা মোটামুটি এক রকমের হলে ভালো হয়।
অ্যাকোয়ারিয়ামের জলের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে থার্মোস্ট্যাট সহ হিটার ব্যবহার করা হয়। থার্মোমিটার দিয়ে জলের তাপমাত্রা পরিমাপ করা যায়।
(গ) পি.এইচ (pH)
জলের পি.এইচ বলতে জল কতটা অম্লধর্মী বা কতটা ক্ষারধর্মী তা বোঝায়। জলের পি.এইচ. জলের গুণগত মানের তারতম্য ঘটায়। সাধারণত ভারী জলে কার্বোনেট থাকার দরুন জল ক্ষারধর্মী হয়, আর মৃদু জলে কার্বোনিক অ্যাসিড থাকার ফলে জল অম্লধর্মী হয়। মাছ জলের পি.এইচ–এ খুব সংবেদনশীল। বিভিন্ন প্রজাতির মাছের পি.এইচ. সংবেদন মাত্রা বিভিন্ন ৷
সাধারণ মিষ্টি জলের মাছ মৃদু অম্ল বা মৃদু ক্ষারীয় জল (পি.এইচ. 6.5-7.5) পছন্দ করে। জলের পি.এইচ মান মাছের সহ্য সীমা অতিক্রম করলে মাছের ঔজ্জ্বল্য কমে যায়। খাদ্যগ্রহণে অনীহা ও অধিক শ্লেষ্মা ক্ষরণ হয়।
অম্লধর্মী জলে প্রয়োজনমতো সোডিয়াম বাই–কার্বোনেট মিশিয়ে ক্ষারধর্মী, অধিক ক্ষারধর্মী জলে প্রয়োজমতো ফসফোরিক অ্যাসিড মিশিয়ে মৃদু ক্ষারধর্মী করা যায়। আবার, জলের পি.এইচ.-এর মান কমানোর জন্য পীট ফিল্টার ও বাড়ানোর জন্য স্যাণ্ডউইচ ফিল্টার ব্যবহার করা যায়।
অধিকাংশ ডিম প্রসবকারী রঙিন মাছ মৃদু অম্লধর্মী (6.5-6.8) জল ও বাচ্চা প্রসবকারী মাছ মৃদু ক্ষারধর্মী (7.0–7.5) জল পছন্দ করে।
(ঘ) জলের ক্ষরতা
সাধারণ জলে দ্রবীভূত খনিজ লবণের মাত্রা হলো জলের ক্ষারতা। অর্থাৎ জলে খনিজ লবণের পরিমাণ যত বেশি হয় ক্ষরতাও তত বেশি হয়। বিভিন্ন প্রকার মাছ জলের বিভিন্ন মাত্রার ক্ষরতা সহ্য করতে পারে। সাধারণত যে সমস্ত মাছ ডিম পাড়ে তারা মৃদু ক্ষারজল (100-150 মিগ্রা./লি.) পছন্দ করে। বেশি ক্ষরজলে মাছ ডিম ছাড়লে ডিমের প্রস্ফুটন ব্যাহত হয়।
জলের ক্ষরতা পরিমাণ মত পরিশুদ্ধ জল মিশিয়ে কমানো ও পরিমাণ মতো চুনাপাথর বা চক জাতীয় পদার্থ মিশিয়ে বাড়ানো যায়।
(ঙ) ক্লোরিন
ক্লোরিনযুক্ত জল অ্যাকোয়ারিয়ামে ব্যবহার উপযোগী নয়। যদি ক্লোরিনযুক্ত জল অ্যাকোয়ারিয়ামে ব্যবহার করতে হয় তাহলে জল কোনো পাত্রে কয়েকদিন রেখে দিতে হয় বা জলে অন্ততঃ 24 ঘণ্টা বায়ু সঞ্চালন করতে হয় নতুবা জলে কয়েক ফোঁটা সোডিয়াম থায়োসালফেট প্রয়োগ করতে হয়। যাতে জল মিশ্রিত ক্লোরিন দূরীভূত হয়।
(চ) অ্যামোনিয়া
অ্যাকোয়ারিয়ামে সৃষ্ট সর্বাপেক্ষা দূষিত পদার্থ হলো অ্যামোনিয়াম নাইট্রোজেনজাত অ্যামোনিয়া গ্যাস। মাছের বর্জ্য পদার্থ, সঞ্চিত অভুক্ত খাদ্য, জলজ উদ্ভিদের নষ্ট পাতা পচে অ্যামোনিয়াম নাইট্রোজেন উৎপন্ন হয়। জলের অ্যামোনিয়াম নাইট্রোজেন মাত্রা স্বাদু জলের মাছের পক্ষে প্রতি লিটার জলে 0.5 মিলিগ্রামের বেশি হলে ক্ষতিকারক এবং সামুদ্রিক মাছের পক্ষে প্রতি লিটার জলে 0.5 মিলিগ্রামের কম হলে ক্ষতিকারক। অ্যামোনিয়া দূষণের জন্য মাছ খাবি খায়, অবসন্ন বোধ করে; ক্ষিদে কমে যায় এবং ফুলকার রঙ নীলাভ–লাল হয় ও দেহে এবং পাখনায় লাল ডোরা কাটা দাগ দেখতে পাওয়া যায়। অ্যামোনিয়া দূষণ নিয়ন্ত্রণ করতে মাছের খাদ্য প্রয়োগমাত্রা কমাতে হয়। জলের পি.এইচ. কমাতে হয় এবং অ্যাকোয়ারিয়ামের 25-50 শতাংশ জল পরিবর্তন করতে হয়। উন্নতমানের ফিল্টার ব্যবহার করেও অ্যাকোয়ারিয়ামের জলের অ্যামোনিয়ার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
(ছ) নাইট্রাইট
অ্যামোনিয়া বিয়োজিত হয়ে নাইট্রাইট নাইট্রোজেন উৎপন্ন হয়। জলে পর্যাপ্ত দ্রবীভূত অক্সিজেন থাকলে নাইট্রাইট ক্ষণস্থায়ী হয় এবং কম থাকলে দীর্ঘস্থায়ী হয়। জলের নাইট্রাইট নাইট্রোজেন স্বাদু জলের মাছের পক্ষে প্রতি লিটার জলে 0.5 মিলিগ্রামের বেশি হলে ক্ষতিকারক। নাইট্রাইট দূষণের জন্য মাছ খাবি খায়। অবসন্ন বোধ করে, ক্ষিধে কমে যায় এবং ফুলকার রঙ নীলাভ–লাল হয় ও দেহে এবং পাখনায় লাল ডোরাকাটা দাগ দেখতে পাওয়া যায়। নাইট্রাইট দূষণ নিয়ন্ত্রণ করতে মাছের খাদ্য প্রয়োগমাত্রা কমাতে হয়, জলের পি.এইচ. কমাতে হয় এবং অ্যাকোয়ারিয়ামের 25-50 শতাংশ জল পরিবর্তন করতে হয়। উন্নতমানের ফিল্টার ব্যবহার করেও অ্যাকোয়ারিয়ামের জলের নাইট্রাইটের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
(জ) নাইট্রেট
নাইট্রাইট নাইট্রোজেন বিয়োজিত হয়ে নাইট্রেট নাইট্রোজেন পরিণত হয়। তবে নাইট্রেট নাইট্রোজেন মাছের পক্ষে অ্যামোনিয়া বা নাইট্রাইটের মতো খুব ক্ষতিকর নয়। সাধারণত প্রতি লিটার জলে নাইট্রেট নাইট্রোজেনের মাত্রা 25 মিলিগ্রামের বেশি হলে মাছের পক্ষে ক্ষতিকারক। মাত্রাতিরিক্ত নাইট্রেট জলে থাকলে মাছের রোগাক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা বাড়ে। প্রজননে বিঘ্ন ঘটে ও বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। অ্যাকোয়ারিয়াম পরিষ্কার করে, খাদ্য প্রয়োগমাত্রা কমিয়ে, জল পরিবর্তন করে ও জলজ উদ্ভিদের সংখ্যা বাড়িয়ে নাইট্রেট দূষণ নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
(ঝ)পরিচর্যা
প্রতি 15 দিন অন্তর অ্যাকোয়ারিয়ামের মোট জলের 5 ভাগের 1 ভাগের জল ফেলে পরিষ্কার জল দিয়ে ঐ পরিমাণ জল পূরণ করতে হয়। জলে শেওলার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। জলজ উদ্ভিদের পচা পাতা ও তলদেশে সঞ্চিত নোংরা সাইফন করে পরিষ্কার করতে হয়।
জলজ উদ্ভিদের বৃদ্ধি ও স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে হয়। আলোক ব্যবস্থা ও পাম্প পরীক্ষা করতে হয়। ফিল্টার পরিষ্কার করতে হয়। মাছের স্বাস্থ্য পরীক্ষার যন্ত্রপাতি ঠিকঠাক কাজ করছে কিনা তা পর্যবেক্ষণ করা। জলের ভৌত রাসায়নিক অবস্থা পরীক্ষা করা। জলের গভীরতা কমে গেলে তা পূরণ করা। যন্ত্রপাতির কর্মক্ষমতা পরীক্ষা ও নিয়ন্ত্রণ করা। সপ্তাহে 1 দিন খাদ্য সরবরাহ বন্ধ রাখলে ভালো হয়।