
সারাংশ লিখন
সারাংশ লিখন | Sarangsho in Bengali Grammar Notes to each chapter is provided in the list so that you can easily browse throughout different chapter সারাংশ লিখন |Sarangsho in Bengali Grammar and select needs one.
সারাংশ লিখন (Summary):কোন গদ্যাংশ বা পদ্যাংশের মূল বক্তব্যকে সংক্ষিপ্ত আকারে প্রকাশ করার নামই সারাংশ।তবে সাধারণতঃ গদ্যাংশের একটি বড় অনুচ্ছেদকে সংক্ষিপ্ত করার সময় বলা হয় সারাংশ লিখ, আর পদ্যাংশের মূল ভাবকে প্রকাশ করার ক্ষেত্রে বলা হয় ভাবার্থ’ লিখ। মূলতঃ সারাংশ ও ভাবার্থ’ একই জিনিষ ।সাধারণতঃ একটি বড় অনুচ্ছেদকে সারাংশ লিখতে বলা হয়। উদ্ধৃতাংশে যুক্তি, দৃষ্টান্ত বা নানা প্রকারের অলংকারের সাহায্যে ভাব বা চিন্তা বিস্তৃতভাবে ছড়িয়ে থাকে। অপ্রধান ভাবগুলিকে বর্জন করে মূলে ভাবটিকে একটি সংহত রূপদান করার নামই সারাংশ লিখন। সারাংশে মূল ভাবটিকে সরল ও স্পষ্ট ভাষায় ব্যক্ত করাই বাঞ্ছনীয় । অনেক সারাংশ ও সারসক্ষেপ বা সংক্ষিপ্ত সারকে সমার্থক বলে মনে করেন। কিন্তু সারাংশ ও সারসংক্ষেপ বা সংক্ষিপ্তসার এক জিনিষ নয়। এদের মধ্যে পার্থক্য আছে ।
সারাংশ ও সংক্ষিপ্তসারের পার্থক্য (Summary / Precis)
সারাংশের ইংরেজী প্রতিশব্দ Summary আর সারসংক্ষেপ বা সংক্ষিপ্তসারের ইংরেজী প্রতিশব্দ Precis—ইংরেজী ব্যাকরণ মতে এ দুয়ের বিশেষ পার্থক্য না থাকলেও বাংলায় এদের মধ্যে কয়েকটি পার্থক্য লক্ষ্য করা হয়—(১) সংক্ষিপ্তসারে শিরোনাম (Title) থাকে, সারাংশে তা থাকে না ।
(২) সারাংশে সংক্ষিপ্ত রূপে থাকে, সংক্ষিপ্তসারে সংক্ষিপ্ততর রূপ থাকে অর্থাৎ সংক্ষিপ্তসারের আয়তন সারাংশের আয়তন অপেক্ষা আরও বেশ কিছুটা ছোট হয় ৷
(৩) সংক্ষিপ্তসারের প্রয়োজন ব্যবহারিক ক্ষেত্রে, আর সারাংশের বাবহার সাহিতিক রূপ দেবার জন্য ।
কিভাবে সারাংশ লিখবে?
ভাবার্থ’ লিখনের সময় যা বলা হয়েছে—অর্থাৎ এবিষয়ে যেমন ধরাবাঁধা কোন নিয়ম নেই, তেমনই সারাংশ লিখনের বেলাতেও কোন নির্দিষ্ট নীতি নেই।সুদীর্ঘ অনুশীলন অথাৎ বার বার লেখার ফলেই সারাংশ লিখনের দক্ষতা গড়ে উঠে। তব শিক্ষার্থীদের সংবিধার জন্য সারাংশ লেখার কিছু ইংগিত দেওয়া গেল ।
ক. প্রদত্ত বিষয়টি ভাল করে পড়তে হবে। প্রয়োজনবোধে একাধিকবার মনোযোগ সহকারে পড়তে হবে। তাহলেই মূল ভাবটি অননুধাবন করা যাবে ৷
খ.পড়বার সময় গরুত্বপূর্ণ স্থানে রেখাঙ্কিত করে সেই অংশে মনোযোগ নিবদ্ধ করলে অনেক সময় মূল ভাব হৃদয়ঙ্গম হয়ে যায় ৷
গ.মূলভাব হৃদয়ঙ্গম হলে তা নিজের ভাষায় সহজ সরল ভঙ্গিতে লিখতে হবে । লেখবার সময় সারাংশের আয়তন কতটা হবে তা মনে মনে ঠিক করে নিতে হবে, অথবা মূল অথবা মূল অংশের শব্দ গূণে নিয়ে তার এক তৃতীয়াংশ হিসেব করে মোটামুটিভাবে সেই পরিমাণের মধ্যে বিষয়টির ভাবকে নির্দিষ্ট করে রাখতে হবে। তবে গরুত্বপূর্ণ অনুচ্ছেদে এই নিয়ম চলবে না। কিন্তু প্রশ্নপত্রে নির্দেশ থাকলে নির্দিষ্ট সংখ্যার শব্দের মধ্যেই সারাংশ লিখতে হবে ।
ঘ.মূল রচনা উত্তম বা মধ্যম পুরুষে থাকলে তা অবশ্যই প্রথম পরুষে লিখতে হবে । উক্তি-প্রত্যুক্তি বাদ দিয়ে সার অংশটুকু তুলে ধরতে হবে ৷
ঙ. যথাসম্ভব জটিল ও দূরহ বাক্য পরিত্যাগ করতে হবে । অলংকার- মণ্ডিত—উপমা বহল শব্দ বা বাক্যাংশ বাদ দিতে হবে। ভাষাকে যথাসম্ভব স্বকৃত ও সরল করা প্রয়োজন ।
Examples of Sarangsho
কয়েকটি আদর্শ সারাংশ
[১]
নমো নমো নম সংন্দরীমম জননী বঙ্গভূমি!
গঙ্গার তীর স্নিগ্ধ–সমীর জীবন জুড়ালে তুমি ।
অবারিত মাঠ, গগন ললাট চুমে তব পদধূলি—
ছায়া সানিবিড় শান্তির নীড় ছোট ছোট গ্রামগুলি ।
পল্লব ঘন আম্র কানন রাখালের খেলা গেহ—
স্তব্ধ অতল দিঘি কালোজল নিশীথ শীতল স্নেহ।
বুক–ভরা মধু বঙ্গের বধূ জল লয়ে যায় ঘরে
মা বলিতে প্রাণ করে অনাচান, চোখে আসে জল ভরে।
সারাংশ: কবি তাঁর জন্মভূমি বঙ্গভামিকে মাতা-সম্বোধনে প্রণাম জানিয়ে বলেছেন যে, গঙ্গার স্নিগ্ধ বাতাস, দিগন্ত জোড়া মাঠ, ছায়া স্নিগ্ধ ছোট ছোট গ্রাম, তার মাঝে পল্লব ঘন আম্রকানন ও রাখালের খেলার ঘর, শান্ত স্নিগ্ধ স্ফটিকের মত দীঘির কালোজল সমস্তই এক মধর শান্তির আশ্বাস নিয়ে দেখা দেয়। মাতৃস্নেহাকুল সন্তানের মত কবির মনও ঘরে ফেরার জন্য উন্মুখ, তাই তাঁর চোখ অশ্রুপর্ণ হয়ে ওঠে ।
[২]
মাটির পৃথিবী পানে আঁখি মেলি যবে
দেখি সেথা কলকল রবে
বিপুল জনতা চলে
নানা পথে নানা দলে দলে
যুগে যুগান্তর হতে মানুষের নিত্য প্রয়োজনে জীবন মরণে
ওরা চির কাল
টানে দাঁড়, ধরে থাকে হাল;
ওরা মাঠে
বীজ বোনে ।পাকা ধান কাটে–
ওরা কাজ করে
নগরে প্রান্তরে
সারাংশ: সভ্যতার জন্মলগ্ন থেকেই শ্রমজীবী মানুষ তার অবিরাম কর্মধারা চালিয়ে জগৎকে গতিশীল করে রেখেছে। এরা শহরে-নগরে, প্রান্তরে, গ্রামে- গ্রামান্তরে অব্যাহত গতিতে তাদের কর্মধারা বজায় রেখেছে। মানব জীবনের সর্বস্তরে সর্বকমে এদের অস্তিত্ব চিরকালের ।
[৩]
ছোট বালকার কণা বিন্দু বিন্দু জল
গড়ি তোলে মহাদেশ, সাগর অতল।
মুহূর্তে নিমেষ কাল, তুচ্ছ পরিমাণ,
রচে যুগ যুগোন্তর, অনন্ত মহান ।
প্রত্যেক সামান্য ত্রুটি ক্ষুদ্র অপরাধ
ক্রমে টানে পাপ পথে, ঘটায় প্রমাদ ।
প্রতি করুণার দান, স্নেহ পূর্ণ বাণী
এ ধরায় স্বর্গ সুখ নিত্য দেয় আনি ।
সারাংশ: জগতের যা কিছু বিশাল ও মহৎ তা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশেরই সমষ্টি মাত্র। সামান্য অপরাধ যেমন সাংঘাতিক পাপের সৃষ্টি করে সবর্ণনাশের পথে নিয়ে যেতে পারে। তেমনি সামান্য মাত্র ভালবাসা, স্নেহ, করুণা পৃথিবীতে মানুষের জন্য স্বর্গ সুখ এনে দিতে পারেতাই ক্ষুদ্র ও তুচ্ছ বলে কাউকেই অবহেলা করা ঠিক নয় ।
[৪]
দরিদ্র বলিয়া তোরে বেশী ভালোবাসি
হে ধরিত্রী, স্নেহ তোর বেশী ভালো লাগে—
বেদনা কাতর মুখে সকরুণ হাসি
দেখিয়া মোর মর্মমাঝে বড় ব্যথা জাগে ।
আজি শেষ নাহি হল দিবস নিশীথে—
স্বর্গ‘ নাই রচেছিস স্বগে‘র আভাস।
তাই তোর মুখখানি বিষাদ কোমল
সকল সৌন্দর্যে— তোর ভরা অশ্রুজল ।
সারাংশ: ধরিত্রী আমাদের জননী । জননীর দারিদ্র্য তার স্নেহকে পুত্রের নিকট মহামূল্য করে তোলে।পুত্র মাতৃস্নেহের সম্পদে পৃথিবীকে স্বর্গতুল্য জ্ঞান করে ।প্রকৃতির দারিদ্রোর মধ্যেও রত্নভাণ্ডার ও আনন্দের স্বর্গ আছে। সেই দারিদ্র্যের বিষাদ কোমল সুন্দর রূপ আমাদের মনকে বেশী করে আকর্ষণ করে ৷
[৫]
বিদেশের ভাষা অবলম্বন করিয়া আমরা যে বড় হইতে পারিব না, বিদেশের ভাষার সাহায্যে সাহিত্য সৃষ্টি করিয়া বড় হইবার চেষ্টা যে অস্বাভাবিক ও উপহাস্য, তাহা বঙ্কিমচন্দ্রই আমাদের বুঝাইয়া গিয়াছেন। বঙ্কিমচন্দ্রের বহু পর্বে মহাত্মা রামমোহন রায় দেশের লোকের সঙ্গে কথা কহিবার জন্য দেশের ভাষারই আশ্রয় লইয়াছিলেন। তিনি বাংলায় সাময়িক পত্র প্রচার করেন ; বাংলায় বেদান্ত শাস্ত্র প্রকাশ করেন । দেশের লোকের মতিগতি ফিরাইবার জন্য দেশের লোকের অবোধ্য ভাষায় দেশের লোককে সম্বোধনের অদ্ভূত প্ণালী, তাঁহার স্থির বুদ্ধি সংগত বলিয়া গ্রহণ করেন নাই ৷
সারাংশ: স্বদেশ প্রেমিক বঙ্কিমচন্দ্র পরানুকরণ প্রিয় বাঙালী জাতিকে স্বদেশের সাহিত্য চর্চা করার জন্য বিদেশী ভাষা ও সাহিত্যের আলোচনার প্রলোভন থেকে মক্ত করে আনেন।তার আগে রামমোহন বাঙালী জনসাধারণের সাথে যোগাযোগের জন্য বাংলা ভাষার চর্চা শুরু করেন।বঙ্কিমচন্দ্র বাঙালী জাতিকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের দিকে এগুবার প্রেরণা দেন ।
[৬]
ভয় মানুষের অবধারিত শত্রু । সে তাহার আত্মশক্তির সুদৃঢ় ভিত্তিকে দুর্বল করিয়া সাধন করে তাহার চরম সর্বনাশ । ভয়হীনতাই শক্তি। অত্মশক্তিতে বিশ্বাসী হইয়া ভয়কে জয় করিতে হইবে। ‘শক্তি মরে ভীতির কবলে । সেই শক্তিকে ভীতির কবল মুক্ত করিয়া ভয়কে পদদলিত করিয়া ঋজু মেরুদণ্ড লইয়া এই পৃথিবীতে যথার্থ মানুষের মতো বাঁচিতে হইবে। নিশ্চেষ্ট ও পরনির্ভর হইয়া বাঁচিয়া থাকার চেয়ে মৃত্যুও শ্রেয়। সেই মৃত্যুতেও আছে গৌরব। অথচ দুর্বল ভগবৎ নির্ভ’র হইয়া বাঁচিয়া থাকা চরম অবমাননাকর। যাহারা ভীরু, ভয়ের গুহায় যাহারা সারাজীবন আত্মগোপন করিয়া থাকে, যাহারা মৃত্যুর পূর্বে বহুবার মরে, তাহারা মানবতার কলংক। মানুষ তাহাদের প্রতি শ্রদ্ধাহীন, ইতিহাস তাহাদের সম্পর্কে কঠিনভাবে নীরব।ঘৃণ্য ও বিকৃত জীবনই তাহাদের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার ।
সারাংশ: ভয় মানুষের শত্রু সমূহের অন্যতম শত্রু, সকল উন্নতির প্রতিবন্ধক স্বরূপে। ভীতু মানুষ কখনো উন্নতি করতে পারে না । তারা মরার আগে বহবার মরে থাকে। ভয় জয় করাই হোল জীবনের উন্নতির প্রধান চাবিকাঠি ভয়ের কবলে পড়ে যারা নিশ্চেষ্ট,অক্ষম হয়ে জীবন কাটায় মানুষ কোনদিন তাদের শ্রদ্ধা করে না, সম্মান করে না ।
[৭]
পাথিবীতে যাহার দিকে তাকাও, দেখবে সে নিজের অবস্হায় অসন্তুষ্ট। দরিদ্র কিসে ধনী হইবে, সেই চিন্তায় উদ্বিগ্ন।ধনী চোর ডাকাতের ভয়ে ত্রস্ত, রাজা শত্রুর ভয়ে ভীত। এক কথায় পৃথিবীতে এমন কেহ নাই, যে পূর্ণ সুখে সুখী। অথচ কৌতুকের বিষয় এই পৃথিবী ছাড়িয়া যাইতেও কেহ প্রস্তুত নয়। মৃত্যুর নাম নিলেই মানুষের মুখ শুকাইয়া যায়, মানুষ যতই দরিদ্র হউক। সপ্তাহের পর সপ্তাহ তাহাকে যদি অনাহারে কাল কাটাইতে হয়, পৃথিবীতে কোন আরামই তাহার ভাগ্যে না থাকে, তথাপি সে মৃত্যু চাহে না। সে যদি কঠিন পীড়ায় পীড়িত হয়, যদি শয্যা হইতে উঠিবার শক্তিও তাহার না থাকে, তথাপি সে মৃত্যুর প্রার্থী হইবে না ৷ কেনা জানে যে, শত বৎসরের পরমায়ু থাকিলেও তাহাকে একদিন না একদিন মরিতে হইবে ।
সারাংশ:—পৃথিবীতে কোন মানুষেই নিজ নিজ অবস্থায় সুখী নয় । সকলেই চায় আরও বেশী ধনী, আরও বেশী সুখী হতে। ধনী-দরিদ্র রাজা প্রজা কারুর ক্ষেত্রেই এর ব্যতিক্রম নেই । আরও একটি আশ্চর্য ব্যাপার, মানুষ মৃত্যুর ভয়ে ভীত। মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী জেনেও, শত দারিদ্র্য ভোগ করেও কেহ মৃত্যুর সম্মুখীন হতে চায় না ৷
[৮]
সভ্যতা কাহাকে বলে ? ভিতরের দেবত্বকে অনুভব করাই সভ্যতা। যখনই সময় পাইবে, তখনই মনে মনে এই ভাবগুলিকে আবৃত্তি কর এবং আকাঙ্ক্ষা কর । এইরূপে করিলেই সব হইবে। যাহা কিছু ঈশ্বর নয়, তাহা অস্বীকার কর । যাহা কিছু ঈশ্বর ভাবাম্বিত, তাহা দৃঢ়ভাবে-ঘোষণা কর দিনরাত মনে মনে একথা বলো। এভাবে ধীরে ধীরে অজ্ঞানের আবরণ পাতলা হইয়া যাইবে।আমি মনুষ্য নই, দেবতা নই, আমি স্ত্রী বা পুরুষ নই; আমার কোন সীমা নাই। আমি চিৎস্বরূপ, আমি সেই ব্রহ্ম । আমার ক্রোধ বা ঘৃণা নাই । আমার দুঃখ বা সুখ নাই।জন্ম বা মরণ আমার কখনও হয় নাই, আমি জ্ঞানস্বরূপে – আনন্দস্বরূপ। হে আমার আত্মা আমি সেই, সোহহং ।নিজেকে দেহভাব শূন্যে অনভব কর। কোনকালে তোমার দেহ ছিল না, ইহা আগাগোড়া কুসংস্কার। দরিদ্র,আর্ত পদদলিত, অত্যাচারিত, রোগ পীড়িত সকলের মধ্যে দিব্য চেতনা জাগাইয়া তোল ।
সারাংশ :-মানুষের মধ্যে দেবত্ব অনুভব করা-সভ্যতা। ঈশ্বরভাবকে স্বীকার করে দেহভাবকে অস্বীকার করে আত্মায় ব্রহ্মস্বরূপকে উপলব্ধি করতে পারলে অন্তরের দেবভাব বিকশিত হয়ে উঠে। তখনই নিজেকে পরমাত্মার অংশ- স্বরূপ বলে মনে হবে । দেহ একটা বাইরে সংস্কারমাত্র।এই সংস্কার বিস্মৃত হয়ে আত্মার সচ্ছিদানন্দ স্বরূপকে উপলব্ধি করা এবং তা আর্ত ও দরিদ্র জনসাধারণের মধ্যে জাগ্রত করাই সভ্যতার মূল উদ্দেশ্য ।
[৯]
আমি কেবল চিরকাল গর্ত বূঝাইয়া আসিয়াছি—কখনও পরের জন্য ভাবি নাই । এইজন্য সকলকেই হারাইয়া বসিয় —সংসারে আমার সুখ নাই । পৃথিবীতে আমার থাকিবার আর প্রয়োজন দেখি না। পরের বোঝা কেন ঘাড়ে করিব, এই ভারিয়া সংসারী হই নাই। আমি সুখী নহি । কেন হইব? আমি পরের জন্য দায়ী হই নাই, সুখে আমার অধিকার কি?সাখে আমার অধিকার নাই, কিন্তু তাই বলিয়া মনে করিও না যে, তোমরা বিবাহ করিয়াছ বলিয়া সুখী হইয়াছ।যদি পারিবারিক স্নেহের গুণে তোমাদের আত্মপ্রিয়তা লপ্তে না হইয়া থাকে; যদি বিবাহবন্ধনে তোমাদের চিত্ত মার্জিত না হইয়া থাকে; যদি আত্ম পরিবারকে ভালবাসিয়া তাবৎ মনুষ্য জাতিকে ভালবাসিতে না শিখিয়া থাক, তবে মিথ্যা বিবাহ করিয়াছ, কেবল ভূতের বোঝা বহিতেছ। যে বিবাহে প্রীতি শিক্ষা হয়না, সে-বিবাহে প্রয়োজন নাই ।
সারাংশ:—আত্ম সুখ স্বাচ্ছন্দ্য রক্ষার দ্বারা সুখ হয় না; বিশ্বকে ভালবাসিয়া বিশ্বের কল্যাণ সাধনের দ্বারাই প্রকৃত সুখ উপলব্ধি করা যায় । আত্মসর্বস্ব ব্যক্তি স্বার্থপর—সে বিশ্ববিমূখ হয়ে চিরকাল একাকী নিঃসঙ্গ নির্বাসিত জীবন ভোগ করে থাকে। তার জীবন ঘৃণ্য, সূখ তার ভাগ্যে ঘটে না। মানষে আত্মীয় পরিজনকে ভালবেসে বিশ্বকে ভালবাসতে শেখে।কিন্তু প্রিয়জনকে ভালবাসার মাধ্যমে যদি সে মানবজাতিকে ভালবাসতে না শেখে তবে তার সংসার জীবন বৃথা ।
[১০]
তুমি বসন্তের কোকিল, বেশ লোক । যখন ফুল ফোটে, দক্ষিণা বাতাস বহে, এ সংসার সূখর স্পর্শে শিহরিয়া উঠে, তখন তুমি আসিয়া রসিকতা আরম্ভ কর । আর যখন দারুণ শীতে জীবলোকে থরহরি কম্প লাগে, তখন কোথায় থাক বাপূ —যখন শ্রাবণের ধারায় আমার চালাঘরে নদী বহে, যখনবৃষ্টির চোটে কাক চিল ভিজিয়া গোময় হয়, তখন তোমার মাজা মাজা কালো কালো দুলালি ধরণের শরীরখানি কোথায় থাকে? তুমি বসন্তের কোকিল, শীতবর্ষার কেহ নও ।
রাগ করিও না তোমার মত আমাদের মাঝখানে অনেকে আছেন। যখন নশীবাবুর তালুকের খাজনা আসে, তখন মানুষ কোকিলে তাঁহার গৃহকুঞ্জ পারিয়া যায়—কত টিকি, ফোঁটা, টেরি, চশমার হাট লাগিয়া যায়, কত কবিতা, শ্লোক, গীত, হেটো ইংরেজী, মেঠো ইংরেজী, চোরা ইংরেজী, ছেঁড়া ইংরেজীতে নশীবাবুর বৈঠকখানা পারাবত কাকলি সংকুল গৃহসৌধবৎ বিকৃত হইয়া উঠে।যখন তাহার বাড়ীতে নাচ- গান, যাত্রাপাঠ উপস্হিত হয়, তখন দলে দলে মানুষ কোকিল আসিয়া তাঁহার ঘর বাড়ি আধার করিয়া তুলে। কেহ খায়, কেহ গায়, কেহ হাসে, কেহ কাশে, কেহ তামাক পোড়ায়, কেহ মাত্রা চড়ায়, কেহ টেবিলের নীচে গড়ায়। যখন নশীবাবু বাগানে যান—তখন মানুস কোকিল, তাঁহার সঙ্গে পিপড়ার সারি দেয়। আর যে রাত্রে অবিশ্রান্ত বৃষ্টি হইতেছিল, আর নশীবাবুর পুত্রটির অকাল মৃত্যু হইল, তখন তিনি একটি লোকও পাইলেন না ।
সারাংশ: জগতে এক ধরণের মানুষ আছে যারা স্বার্থ সিদ্ধ করা ছাড়া আর কিছু জানে না। তারা ব্যক্তিগত লাভের, উপকারের ও সংযোগের চেষ্টার হীন স্তাবকতায় মত্ত থাকতেও লজ্জা পায় না। তারা সুখের সাথী দঃখের কেউ নয় । তাই আশ্রয়দাতার সুসময়ে যখন তার কাছ থেকে স্বার্থ গুছিয়ে নেওয়া যাবে তখন সেখানে গিয়ে ভীড় করে।কিন্তু আশ্রয়দাতার বিপদের দিনে,তার ভাগ্য বিপর্যয়ের দিনে এইসব নির্লজ্জ অকৃতজ্ঞের দল নির্মমভাবে আশ্রয়দাতাকে পরিত্যাগ করে ।
[১১]
তবু ভরিলনা চিত্ত। ঘুরিয়া ঘুরিয়া
কত তীর্থ হেরিলাম, বন্দিনু পুলকে
বৈদনাথে; মুঙ্গেরের সীতা কুণ্ডে গিয়।
কাঁদিলাম চিরদঃখী জানকীর দঃখে,
হেরিনু বিন্ধ্যবাসিনী বিন্ধ্যে আরোহিয়া,
করিলাম পুণ্যস্নান ত্রিবেণী সঙ্গমে ৷
‘জয় বিশ্বেশ্বরী’ বলি ভৈরবে বেড়িয়া
করিলাম কত নত্য; প্রফল্ল আশ্রমে,
রাধাশ্যামে নিরখিয়া হইয়া উতলা
গীত গোবিন্দের শ্লোক গাহিয়া গাহিয়া
ভ্রমিলাম কুঞ্জে কুঞ্জে, পাণ্ডারা আসিয়া
গলে পরাইয়া দিল বরগুঞ্জ মালা ।
তব ভরিল না চিত্ত। সর্ব তীর্থ সার
তাই মা তোমার পাশে এসেছি আবার।
সারাংশ:সারা দেশব্যাপী ছড়িয়ে আছে কত তীর্থ ক্ষেত্র, কত দেব-দেবীর পুণ্যস্থান। কিন্তু সব তীর্থে’র সেরা তীর্থ জন্মভূমি ও জননী। মানুষ জীবনে কত তীর্থ— কত পূণ্যক্ষেত্র ঘুরে বেড়ায় তার হৃদয়ের প্রশান্তি ও অন্তরের সুখ পাবার জন্য। কিন্তু তার হৃদয়ের ক্ষুধা আত্মার তৃপ্তি কোথা থেকেও সে পায় না।সে হৃদয়ের ক্ষুধার তৃপ্তি পায় সে মায়ের স্নেহাঞ্চলে ও জন্মভূমির রূপ ও সৌন্দর্যের অবারিত ক্ষেত্রে ।
[১২]
পুণ্যে পাপে দুঃখে সুখে পতনে উত্থানে
মানুষ হইতে দাও তোমার সন্তানে।
হে স্নেহাত’ বঙ্গভুমি, তব গৃহ ক্রোড়ে
চির শিশু করে আর রাখিয়োনা ধরে।
দেশ দেশান্তর মাঝে যার যেথা স্থান
খুজিয়া লইতে দাও করিয়া সন্ধান।
পদে পদে ছোট ছোট নিষেধের ডোরে
বেঁধে আর রাখিয়ো না ভাল ছেলে করে ।
প্রাণ দিয়ে দঃখ সয়ে, আপনার হাতে
সংগ্রাম করিতে দাও ভালমন্দ সাথে ৷
শীর্ণ শান্ত সাধু তব পুত্রদের ধরে
দাও সবে গৃহছাড়া লক্ষক্ষ্মীছাড়া করে,
সাত কোটি সন্তানেরে হে মুগ্ধা জননী
রেখেছ বাঙালী করে, মানুষ করনি।
সারাংশ:ঘরমুখো বাঙালী জাতি আজ নানা নিষেধের চাপে বিশ্ববিমুখ সেই নিষেধের বিধিতে প্রাণের বন্ধনে নেই মক্তি, নেই চিত্তের স্বতঃস্ফূর্ত— বিকাশ ৷ সেই বাঁধা জীবনের বাইরে রয়েছে বৃহত্তম জীবনের মহত্তম স্বাদ।স্বদেশের গন্ডী- বদ্ধ জীবন থেকে দঃখকষ্টপূর্ণ বিশাল জীবনের উত্থানপতনের মধ্যেই জীবনের পরিপূর্ণ বিকাশ আছে ৷