Agnijuger-Bomb
কলকাতার রাজাবাজার অঞ্চলে বোমার মামলা—১৯১৩
অবিভক্ত বাংলাদেশের বুকে সশস্ত্র আন্দোলন ১৯১১ এবং ১৯১২ সালে যথেষ্ট সাড়া ফেলে দিয়েছিল। ১৯১১ সালে ১৮টি ডাকাতি বা হত্যার চেষ্টা করা হয়। ১৯১২ সালেও এমন ঘটনা ঘটে ১৩টি, কিন্তু নানা কারণে এরপর সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের জোয়ার কিছুটা স্থিমিত হয়ে যায়। এবার বিপ্লবীরা নানাদিকে নতুন করে শক্তি সঞ্চয়ের চেষ্টা করলেন। ১৯১৩ সালের শেষের দিক থেকে আবার অগ্নিযুগের সংঘর্ষ দেখা দিল। পুলিশ ইতিমধ্যে আরও কঠিন কঠোর হাতে বিপ্লবীদের দমন করার কাজে লেগে পড়েছে। লন্ডন থেকে বারবার ভারতের বিভিন্ন আধিকারিকদের কাছে গোপন নির্দেশ পাঠানো হচ্ছে। বলা হচ্ছে, তাঁরা যেন গুপ্ত সংগঠনগুলির ওপর কড়া নজর রাখেন। শুধু তাই নয়, সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের ওপরও নজর রাখা শুরু হয়। এভাবেই কলকাতার রাজাবাজার অঞ্চলে একটি বাড়ির দিকে পুলিশের শ্যেনদৃষ্টি পড়ে ।
১৯১৩ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে শ্রীহট্টের মৌলভীবাজারে ম্যাজিস্ট্রেট গর্ডন সাহেবকে হত্যা করবার উদ্দেশ্যে একটি বোমা নিক্ষেপ করবার জন্য এক যুবক তাঁর গৃহপ্রাঙ্গণে প্রবেশ করেন। কিন্তু বোমাটি নিক্ষেপ করবার পূর্বেই যুবকটির হাতেই তা ফেটে যায় এবং তার ফলে যুবকটির মৃত্যু ঘটে।
১৯১৩ সালের নভেম্বর মাস, সবেমাত্র ভোর হয়েছে ২৯৬/১, সার্কুলার রোডের বাড়িটিকে ঘিরে ফেলল পুলিশ। এই বাড়ি থেকে বোমা, পিস্তল এবং বিপ্লব সংক্রান্ত নানা নিষিদ্ধ পত্রপত্রিকা পাওয়া গেল। পাওয়া গেল বোমা তৈরি করার মশলা।
অমৃতলাল হাজরা ছদ্মনামধারী শশাঙ্কশেখর হাজরা, দীনেশ সেনগুপ্ত, চন্দ্রশেখর দে এবং সারদা গুহ নামে চারজন বিপ্লবীকে নিদ্রিত অবস্থায় দেখতে পেয়ে তাঁদেরকে গ্রেপ্তার করে। যখন পুলিশ সেখানে অভিযান চালাচ্ছিল, তখন সতীশ পাকড়াশী নামে একজন বিপ্লবী সেখানে এসে পড়েছিলেন। তিনি নিজের পরিচয় গোপন রাখলেন ৷ পুলিশের কাছে সত্যি কথা বললেন না। কোনো রকমে পুলিশের শ্যেনদৃষ্টি থেকে নিজেকে বাঁচাতে সমর্থ হলেন। পরে পুলিশ নিজেদের ভুল বুঝতে পারে। সতীশ বাবুর নামে ওয়ারেন্ট বের করা হয়। সতীশ বাবুকে কিন্তু শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশ পুলিশ গ্রেপ্তার করতে পারেনি। পুলিশ এই বাড়িতে বহু সিগারেটের টিনবাক্স আর সেই সঙ্গে বোমা তৈরির পক্ষে প্রয়োজনীয় প্রচুর পরিমাণ রাসায়নিক দ্রব্য এবং বহু বৈপ্লবিক সাহিত্য হস্তগত করে। পরে এর সাথে জড়িত ভিন্ন ভিন্ন স্থান থেকে কালীপদ ঘোষ ওরফে উপেন্দ্রলাল রায়চৌধুরী এবং খগেন্দ্রনাথ চৌধুরী ওরফে সুরেশচন্দ্র চৌধুরী নামে অন্য দুজন যুবককেও গ্রেপ্তার করে।শশাঙ্ক হাজরার বিরুদ্ধে অনেক গুলি অভিযোগ আনা হল। বলা হল তিনি বোমা তৈরির কাজে যুক্ত আছেন। তাঁর বিরুদ্ধে রাজাবাজার বোমা মামলা দায়ের করা হল। এই মামলায় শশাঙ্ক বাবু আত্মপক্ষ সমর্থন করেননি। এমনকি কোনো আইনবিশারদের পরামর্শও নেননি। বিচারে তাঁকে ১৫ বছরের দ্বীপান্তর দণ্ড দেওয়া হয়েছিল। এই মামলার বিচারে প্রকাশ পায় যে, স্বল্প মূল্যে বোমা তৈরি করে তা ভারতবর্ষের সর্বত্র সরবরাহ করাই ছিল এই বিপ্লবীদের উদ্দেশ্য।
বাংলার সশস্ত্র বিপ্লব আন্দোলনে শশাঙ্ক হাজরা এক অবিস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। তিনি বিভিন্ন ধরণের বোমা সহজেই তৈরি করতে পারতেন। বোমা তৈরির রাসায়নিক মালমশলা সম্পর্কে তাঁর প্রগাঢ় জ্ঞান ছিল। তাঁর বোমা এক বিশেষ পদ্ধতিতে প্রস্তুত হত। সিগারেট বা জমানো দুধের কৌটা এই বোমার খোল রূপে ব্যবহৃত হত। এই বোমার মধ্যে যে বারুদ ব্যবহৃত হত তাও বিশেষ শক্তিশালী বিস্ফোরক পদার্থ দ্বারা তৈরী হত এবং বারুদের মধ্যে লোহার টুকরা দেওয়া হইত।সিডিসন কমিটি’র রিপোর্টে লেখা হয়েছে, “বোমা বিশেষজ্ঞরা বিচার-বিশ্লেষণ করে স্থির করেছেন যে, ঐ সকল স্থানে নিক্ষিপ্ত বোমা একই জাতির এবং একই মস্তিষ্কপ্রসূত”।খ্যাতনামা বোমা বিশেষজ্ঞ মেজর টার্নার বলেছেন যে, তিনি তাঁর জীবনে এই প্রকারের বোমা পূর্বে কোনোদিন দেখেন নি।”মামলার বিচারের রায়ে শশাঙ্কশেখর হাজরাকে এক বিশাল বিপ্লবী দলের অন্যতম নায়ক বলে বর্ণনা করা হয়েছে।