Madanlal-Dhingra
উইলিয়াম কার্জন ওয়াইলি হত্যাকাণ্ড—১৯০৯
ভারতের বিপ্লবের অগ্নিশিখা তখন বিদেশে ছড়িয়ে গেছে। অনেক কৃতী ভারতীয় ছাত্র ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, আমেরিকাতে পড়াশুনার জন্য যেতেন। তাঁরা সাধারণত রাজনৈতিক আবর্ত থেকে দূরে থাকতে ভালোবাসতেন। তাঁদের বেশির ভাগ ছিলেন বিত্তশালী পরিবারের সন্তান। স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখার মতো বাসনা তাঁদের ছিল না। তাঁরা চেয়েছিলেন ব্রিটিশের অধীনে পড়াশুনা করে দেশে ফিরে এসে দক্ষ প্রশাসক হিসেবে কাজ করতে। ব্রিটিশের বশংবদ হতে। এর বিনিময়ে তাঁরা পাবেন অভিজাত জীবনের প্রতিশ্রুতি। তবে সমস্ত প্রবাসী ছাত্র একইরকম ছিলেন না। এই প্রসঙ্গে আমরা প্রথম প্রবাসী ভারতীয় বিপ্লবী শ্যামজী কৃষ্ণ বর্মার কথা আলাদাভাবে উল্লেখ করব। তিনি লন্ডনে ভারতীয় ছাত্রদের জন্য ইন্ডিয়া হাউস নামে একটি বোর্ডিং হাউস স্থাপন করেছিলেন। এই বোর্ডিং হাউসের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় ১৯০৫ সালে ইন্ডিয়ান সোসিলজিস্ট নামে একটি পত্রিকার প্রকাশনা শুরু হল। এই পত্রিকার মাধ্যমে শ্যামজী কৃষ্ণ বিদেশে পাঠরত ভারতীয় ছাত্রদের মধ্যে স্বাধীনতার স্বপ্ন জাগিয়ে তুললেন। কিছুদিনের মধ্যেই এই খবর পৌঁছে গেল ব্রিটিশ পুলিশের কানে। বোঝা গেল শ্যামজী কৃষ্ণ বর্মাকে এবার অন্তরালে যেতে হবে। না হলে তাঁকে কারারুদ্ধ হতে হবে। শ্যামজী কৃষ্ণ এলেন প্যারিসে। পরে এলেন সুইজারল্যান্ডে। সেখান থেকেই ইন্ডিয়া হাউস পরিচালনা করতে থাকলেন।
১৯০৯ সালে বিনায়ক দামোদর সাভারকর এলেন ইন্ডিয়া হাউসে। তিনি ছিলেন এক বিশিষ্ট নেতা। কিছুদিনের মধ্যে তিনি হয়ে উঠলেন ইন্ডিয়া হাউসের নেতা। সেই সময় ইন্ডিয়া হাউসের সদস্যদের কি ভাবে রিভলবার চালাতে হয় গোপনে তার শিক্ষা দেওয়া হত।
ব্রিটিশ ভারতের সচিব লর্ড মর্লের এ. ডি. সি. স্যার উইলিয়াম কার্জন ওয়াইলি। তাঁর কাজ ছিল বিলেতে বসবাসকারী নেটিভ ছাত্রদের দেখাশোনা করা। কিন্তু এর পাশাপাশি তিনি আর একটি ঘৃণ্য ও জঘন্য কাজ করতেন। তিনি প্রত্যেক ছাত্রের গতিবিধির ওপর নজর রাখতেন। তখন ভারতের বিপ্লববাদ চরমে পৌঁছে গেছে। মহারাষ্ট্রের তিন ভাই—দামোদর, বালকৃষ্ণ এবং বাসুদেব ফাঁসির মঞ্চে জীবনের জয় গান গেয়েছেন। প্রাণ দিয়েছেন বিনায়ক রানাডে। বাংলার প্রথম শহীদ প্রফুল্ল চাকি আত্মবলিদান করলেন। হাসিমুখে ফাঁসির মঞ্চে উঠলেন ক্ষুদিরাম বোস। এগিয়ে এলেন সত্যেন বোস, কানাইলাল দত্ত। তাই স্যার কার্জন ওয়াইলি তখন অতন্দ্র প্রহর কাটাচ্ছেন। তাঁর প্রতি মুহূর্তের চিত্তা, প্রবাসী ভারতীয় ছাত্ররাও কি বিপ্লববাদে দীক্ষিত হয়ে উঠবেন নাকি? তাহলে আর প্রতিরোধ করা যাবে না। বিশ্ববাসীর কাছে ভারতীয়দের এই নির্যাতনের খবর পৌঁছে যাবে।
ইন্ডিয়া হাউসের সদস্য এবং ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের কৃতি ছাত্র মদনলাল থিংড়া প্রথম থেকেই সশস্ত্র সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। তাঁর শুরু ছিলেন বিনায়ক দামোদর সাভারকর। সাভারকরের কাছে তিনি বিপ্লবমন্ত্রে দীক্ষিত হলেন। তিনি বললেন— “আপনি কিছু ভাববেন না, আমি যে করেই হোক এই অপমানের প্রতিশোধ নেব।” অর্থাৎ কার্জন ওয়াইলিকে আমি পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেখ।
১৯০৯ সালের পয়লা জুলাই ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশনে বার্ষিক উৎসবের দিন লন্ডনের জাহাঙ্গির হলে একটি পার্টির আয়োজন করা হয়েছে। এই পার্টিতে উপস্থিত ছিলেন স্যার কার্জন ওয়াইলি সমেত অনেক বিশিষ্ট রাজপুরুষ। এই পার্টিতেই মদনলাল, উইলিয়াম কার্জন ওয়াইলিকে হত্যা করলেন। হত্যা করার সময় রাজভক্ত পারসি ডাক্তার কাবসব্জী লাল কাকা বাধা দেবার চেষ্টা করলে তাঁকেও হত্যা করা হল।
মদনলাল ধিংড়াকে গ্রেপ্তার করা হল। তাঁর পকেটে এক টুকরো কাগজ পাওয়া গেল। এই কাগজে বড়ো বড়ো অক্ষরে লেখা ছিল— ভারতীয় যুবকদের প্রতি নির্বিচারে জেল এবং প্রাণ দণ্ডাদেশের প্রতিবাদ হিসেবে আমি স্বেচ্ছায় ইংরেজের রক্ত ক্ষরনের চেষ্টা করলাম।‘
ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করা হল মদন লাল ধিংড়াকে। দিনটি ছিল ১০ই জুলাই ১৯০৯ খ্রী: সকলের সামনে তিনি যে সপ্রশংস ভাষণ রেখেছিলেন তার প্রতিটি শব্দ আজও আমাদের সমস্ত অন্তরকে শিহরিত করে তোলে। ধিংড়া বলেছিলেন—“জার্মানদের যেমন ব্রিটেন দখল করার অধিকার নেই, ব্রিটেনেরও তেমনি ভারতবর্ষ দখলের কোনো এক্তিয়ার নেই। যে ইংরেজ আমার জন্মভূমি ভারতবর্ষকে অপবিত্র করতে চায়, তাকে হত্যা করা আমাদের কাছে ন্যায়ের নির্দেশ। ইংরেজদের কপটতা, অশোভন মিথ্যাচার এবং বিদ্রুপবর্ষী আচরণ দেখে আমি স্তম্ভিত।
…. আমি বিশ্বাস করি যে, বিদেশী বেয়নেটের চাপে একটা জাতিকে দাবিয়ে রাখা মানে, সে জাতিকে নিয়ত যুদ্ধরত থাকতে বাধ্য করা। কিন্তু প্রকাশ্য যুদ্ধের সুযোগ নেই। কারণ, আইন করে আমাদের অস্ত্র অপহরণ করা হয়েছে। তাই আমি আচমকা আমার শত্রুকে আক্রমণ করেছি। বন্দুকের লাইসেন্স আমাকে দেওয়া হবে না, তাই এক্ষেত্রে গর্জে উঠেছে আমার গোপন পিস্তল।
ভারতবর্ষকে বর্তমানে কেবল একটিমাত্র শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে—সে হল মৃত্যু বরণের শিক্ষা এবং সে শিক্ষা দেবার পদ্ধতি মাত্র একটি—নিজে মৃত্যু বরণ করে মৃত্যুভয়হীন হওয়ার দীক্ষা দান। তাই আমি নিজে মৃত্যুবরণ করছি। আমার আত্মনিবেদন জয়যুক্ত হোক।”
সবশেষে তিনি ঈশ্বরের কাছে তাঁর প্রার্থনা নিবেদন করে তিনি বলেছিলেন— “আমার একমাত্র কামনা, আমি যেন বারবার আমার গর্ভধারিণীর বুকে জন্মগ্রহণ করে বারবার দেশোদ্ধারের সাধনায় মৃত্যুকে আলিঙ্গন করি—যতদিন না আমার ভারতভূমি সম্পূর্ণ স্বাধীন হয়ে বিশ্বসভায় গৌরবের আসনে প্রতিষ্ঠিত হয়।” ১৯০৯ সালের ১৭ আগস্ট লন্ডনের জেলে মদনলাল ধিংড়ার ফাঁসি হল।
তিনি হলেন প্রথম শহীদ, যাঁকে বিদেশের কারাগারে ফাঁসির মঞ্চে জীবন দিতে হল। আজও মদনলাল ধিংড়ার সেই বজ্র গম্ভীর কণ্ঠস্বর বুঝি আমরা শুনতে পাই। আর স্বাধীনতার জয়পতাকার দিকে তাকিয়ে থেকে ভাবি, মদনলালের মতো নির্ভীক মানুষদের আত্মবলিদানের মাধ্যমেই আমরা আমাদের ঈপ্সিত স্বাধীনতা অর্জন করতে পেরেছি।