tegra-bol
প্রথম শহিদ হরিগোপাল বল (টেগরা)
জন্ম : ১৯১৪ খ্রীঃ
মৃত্যু : ২২শে এপ্রিল ১৯৩০ খ্রীঃ
চট্টগ্রাম—এখানে সাগরের হাতছানি, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অসাধারণ ভূমিখন্ড। চট্টগ্রামের কথা বললেই সঙ্গত কারণে যে নামটি আমাদের মনের মণিকোঠায় ভেসে ওঠে, সেই নামটি হল মাস্টারদা সূর্য সেন।
আজন্ম বিপ্লবী ছিলেন সূর্য সেন। একক সংগ্রামে এক বিরাট বিপ্লবী বাহিনী গড়ে তুলেছিলেন। তাঁর নেতৃত্বে চট্টগ্রামের নির্ভীক দামাল ছেলেরা সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে চট্টগ্রাম শহরটিকে ইংরেজের কবল থেকে মুক্ত করেছিল। বেশ কিছুদিনের জন্য সাহেবরা প্রাণ ভয়ে শহর ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিল। বিপ্লবীরা চট্টগ্রামের অস্ত্রাগার অধিকার করেন। টেলিফোন এবং টেলিগ্রাফ ব্যবস্থা ধ্বংস করেন। পুলিশ ব্যারাক দখল করে নেন। রেললাইন উপরে ফেলেন। এভাবেই তাঁরা ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের সৃষ্টি করেছিলেন।
সূর্য সেনের সঙ্গে যে সমস্ত তরুণ তরুণীরা আত্মবলিদানের মহান যজ্ঞে মেতে উঠেছিলেন, তাঁর মধ্যে অন্যতম হলেন টেগরা বল। আসল নাম হরিগোপাল বল। কিন্তু এই নামেই তিনি বেশি পরিচিত ছিলেন।
হরিগোপাল বল ১৯১৪ সালে ধোরলা–চট্টগ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম শ্রদ্ধেয় প্রাণকৃষ্ণ বল।
এই দুর্দান্ত সাহসী বালক বারো বছর বয়স থেকেই বিপ্লবের মহামন্ত্রে দীক্ষিত। একেবারে যেন বাচ্চা বাঘ। তাই আদর করে তাঁর নাম দেওয়া হয়েছিল টাইগার। সেই থেকে মুখে মুখে টেগরা। কী আশ্চর্য, এই নামেই তিনি বিখ্যাত হয়ে আছেন।
তাঁর দাদা লোকনাথ বল এবং খুড়তুতো ভাই প্রভাস বল ছিলেন চট্টগ্রামের বিপ্লবী নেতা সূর্য সেনের গুপ্তদলের সদস্য। মাত্র চোদ্দো বছর বয়সে টেগরা বলকে ওই গুপ্তদলে দলভুক্ত করে নেওয়া হয়। এর আগে থেকেই তিনি দলের হয়ে কাজ করতেন। কোথাও প্রচার পত্রিকা পৌঁছে দেওয়া, অথবা স্বেচ্ছাসেবকদের জন্য খাবারের বন্দোবস্ত করা। বারো বছরের টেগরা একাগ্রচিত্তে নেতাদের এইসব আদেশ পালন করতেন। অসামান্য সাহসের প্রতীক ছিলেন তিনি। তাই দেখা গেল, কিছু দিনের মধ্যে দলের কাছে তিনি অত্যন্ত আদরণীয় হয়ে উঠেছিলেন।
টেগরা বলের আর একটি বৈশিষ্ট্য ছিল কখনও নিজের কষ্ট কারো কাছে প্রকাশ করতেন না। হয়তো পথে প্রান্তরে ঘুরে বেড়াতে হচ্ছে। পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে আত্মগোপন করতে হচ্ছে। খাবার ও থাকার সংস্থান নেই, মাথার ওপর খোলা আকাশ। প্রচন্ড বৃষ্টিতে ভিজতে হচ্ছে। তখনও টেগরা বল হাসিমুখে সবার সাথে কথা বলছেন। ছোটোখাটো কৌতুক করার চেষ্টা করেছেন। ভাবগম্ভীর পরিবেশের মধ্যে আনতে চেয়েছেন একটুকরো বসন্ত বাতাস।
কিশোর বলেই বোধ হয় ওঁর চঞ্চলতা একটু বেশি। আবার যখন তাঁর ওপর কোনো কঠিন কর্তব্যের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হত, মুহূর্তের মধ্যে পালটে যেতেন টেগরা বল। যে করেই হোক এই কাজটা আমাকে শেষ করতে হবে—এমন একটা আত্মপ্রত্যয় জেগে উঠত তাঁর মনের মধ্যে।
অবশেষে এল সেই ভয়ংকর দিনটি – ১৯৩০সালের ১৮ই এপ্রিল। সূর্য সেন ওরফে মাস্টারদা শেষ সংগ্রামের ডাক দিয়েছেন। তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে এসেছেন অনেক তরুণ–তরুণী। জীবন মৃত্যুকে পায়ের ভৃত্য করে তাঁরা ঝাঁপিয়ে পড়েছেন ব্রিটিশ শক্তির ওপর। শেষ অব্দি মাস্টারদার এই পরিকল্পনা সফল হল। একটির পর একটি অভিযানে জয়যুক্ত হলেন মাস্টারদা। তাঁর এই অস্বাভাবিক বিজয়ে ইংরেজরা অবাক হয়ে গেল। স্থানীয় মানুষের মধ্যে কী ধরনের জনপ্রিয়তা থাকলে তবেই এই কাজ হতে পারে! ইংরেজরা তা বুঝতে পারল। এবার আঘাত করতে হবে। এমন আঘাত, যাতে মাস্টারদার বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়।
এই অবস্থায় মাস্টারদা আর একটি কঠিন সিদ্ধান্ত নিলেন। ইওরোপীয়ান ক্লাব আক্রমণ করতে হবে। ইওরোপীয়ান ক্লাবে ইউরোপীয় রাজপুরুষেরা নানা ধরনের ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠেন। ভারতীয় বিপ্লবীদের কী করে হত্যা করা যায়, সেই সংক্রান্ত আলোচনা করেন। ইওরোপীয়ান ক্লাব হল ইওরোপীয়দের আত্ম– অহমিকার প্রতীক। তাঁরা শ্বেতাঙ্গ, সাদা চামড়ার অধিকারী। কৃষ্ণাঙ্গ ভারতীয়দের থেকে তাদের স্থান অনেক উঁচুতে, এ সব কথাই ওই ক্লাবে আলোচনা হতো।
তাই মাস্টারদার স্বপ্ন ছিল এই ক্লাবকে ধ্বংস করতে হবে।
টেগরা বলকেও দলের অন্যতম সদস্য করা হল। সাহেবদের সাথে মুখোমুখি লড়াই করার জন্য টেগরা বল এবং অন্যান্য সহকর্মীরা গেলেন ইওরোপীয়ান ক্লাবে। কিন্তু সেদিন ছিল গুড ফ্রাইডে। মানবত্রাতা যিশুকে সেইদিনই হত্যা করা হয়। সেই দিনটি ছিল একটি শোকাচ্ছন্ন দিন। তাই ইওরোপীয়ান ক্লাব বন্ধ ছিল। সেখানে কোনো সাহেবকে না পেয়ে টেগরা এবং তাঁর সহযোদ্ধারা ক্ষুণ্ণ মনে ফিরে এসেছিলেন।
ইতিমধ্যে ইংরেজরা প্রবল আক্রমণ করতে শুরু করেছে।বিপ্লবীদের মূল ঘাঁটি আক্রমণ করা হল। সূর্য সেন বুঝতে পারলেন, এখন সেখানে থাকা উচিত হবে না। তাঁরা শহরের উপকণ্ঠে জালালাবাদ পাহাড়ে গিয়ে আশ্রয় নিলেন। শহর থেকে একটু দূরেই পাহাড়ের অবস্থিতি। এখানে থাকলে নীচের সমতলভূমি পরিষ্কার নজরে আসবে। কোনো বিদেশি শত্রু আসছে কিনা, তাও বুঝতে পারা সহজ হবে। অনেক ভেবেচিন্তে মাস্টারদা এই জায়গাটিকে নির্বাচন করেছিলেন ।
এবার শুরু হল প্রবল প্রস্তুতি। খাওয়া নেই, ঘুম নেই, পিপাসায় বুক ফেটে যাচ্ছে। পাহাড়ের নীচে একটু দূরে জল পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু সেখানে যাওয়া যাবে না। ক্ষেতে কাজ করা কৃষকরা বিপ্লবীদের দেখতে পেয়ে যাবে। ইতিমধ্যে বিপ্লবীদের মনে হয়েছে যে, তাঁদের আত্মগোপন করে থাকার খবরটা বোধহয় ইংরেজ গুপ্তচরদের কাছে পৌঁছে গেছে। দেখা গেল, দুজন কৃষক পাহাড়ের দিকে আঙুল দেখিয়ে হাত নেড়ে কী যেন বলাবলি করছে। বিপ্লবী সেনাদলের কাছে বিপ্লবী নেতৃত্বের হুকুম এল, কেউ যেন জলের সন্ধানে স্থান ত্যাগ না করেন।
এই হুকুম অত্যন্ত কড়া। বিপ্লবী সংগঠনগুলি সুনির্দিষ্ট নিয়মানুবর্তিতার মাধ্যমে এগিয়ে চলে। কঠিন কঠোর শৃঙ্খলা পরায়ণতার মন্ত্রে উজ্জীবিত হতে হয় তাদের।
২২শে এপ্রিল। আকাশের সূর্য বুঝি আগুনের হল্কা দিচ্ছে। একফোঁটা জলের জন্য প্রাণটা ছটফট করছে। কোথায় গেলে তৃষ্ণার উপশম হতে পারে? ক্ষুধায় তৃষ্ণায় সকলেই ক্লান্ত এবং শ্রান্ত। যাঁরা বয়সে একটু বড়ো, তাঁরা অম্লানবদনে এই সব দুঃখকষ্ট সহ্য করতে পারেন। তাঁরা দীর্ঘদিন বিপ্লবী দলের সঙ্গে যুক্ত। তাঁরা জানে, দেশকে ভালোবাসতে গেলে,সমস্ত অত্যচার সহ্য করতেই হবে। কিন্তু যাদের বয়স কম, তাঁরা অল্পতেই কাতর হয়ে পড়েন।
টেগরা একসময় চুপি চুপি এসে দাদা লোকনাথ বলকে বললেন – বড্ড খিদে পেয়েছে, সোনাদা ।
দলের অন্যতম সভাপতি ছিলেন লোকনাথ বল। তিনি বললেন – ছিঃ ভাই, বিপ্লবীদের অত কাতর হলে চলবে কেন ?
দাদার কথা শুনে শান্ত হলেন টেগরা। তবুও আর বোধহয় বেশিক্ষণ থাকতে পারছেন না ।
কিছুক্ষণ কেটে গেল। একজন অতি কষ্টে খাবার হিসেবে দুটি তরমুজ জোগাড় করে আনলেন। ভাগ্যিস এই পাহাড়ে একটা তরমুজ গাছ দেখতে পাওয়া গেছে। তা না হলে কী যে হত?
বিপ্লবীরা ভাবলেন, ক্ষুধা এবং পিপাসার কিছুটা হয় তো উপশম হবে। দলের নেতা অম্বিকা চক্রবর্তী এগিয়ে এলেন। তরমুজ দুটিকে কাটলেন সমান ভাগে ভাগ করে। তিরিশজন বিপ্লবী এখানে আত্মগোপন করে আছেন। সকলের মুখে একটুকরো করে তুলে দিতে হবে।
ক্ষুধার্ত টেগরা এগিয়ে এসে গোপনে একখণ্ড তুলে নিয়ে গিয়েছিলেন। এবার তরমুজের খণ্ড বিতরণ শুরু হল। অম্বিকাদা টের পেয়ে গেলেন। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন – কে–না বলে নিয়েছে বলো?
টেগরা অকপটে দোষ স্বীকার করলেন। তিনি তো আর চোর নন, প্রচণ্ড খিদের জ্বালায় যে অপরাধ করেছেন,তা স্বীকার করার মতো সৎসাহস ছিল তাঁর।
অম্বিকা দৃপ্তকণ্ঠে প্রশ্ন করলেন—কেন তুমি না বলে নিয়েছো?
আত্মপক্ষ সমর্থন করে টেগরা বলেছিলেন – অম্বিকাদাদা, আমার নিজের ভাগটা আমি নিয়েছি, এতে দোষের কি আছে ?
অম্বিকাদা গর্জন করে বলে উঠলেন—না, যতক্ষণ পর্যন্ত আমি ভাগ করে না দেই, ততক্ষণ কেউ কোনো ভাগ তুলতে পারবে না।
অভিমান করে বালক টেগরা বলে উঠেছিলেন—কতক্ষণে ভাগ করবেন, আমার বুঝি খিদে পায় না।
নিয়মনিষ্ঠ নেতা বুঝতে পারলেন যে, টেগরা সত্যি ক্ষুধার্ত, কিন্তু শৃঙ্খলা তাঁকে বজায় রাখতেই হবে। তিনি বললেন –সকলেরই খিদে পায় টেগরা, সেজন্য তুমি শৃঙ্খলা ভাঙতে পারো না।
হঠাৎ রেগে গেলেন স্বাধীনচেতা টেগরা। মনে হল, এই দলের সঙ্গে আর থাকবেন না, কাঁদো কাঁদো কণ্ঠস্বরে তিনি বললেন—এত কড়াকড়ি আমি মানতে পারব না। আমি চলে যাব।
অম্বিকাদা বুঝতে পারলেন, এবার টেগরাকে সামলাতে হবে। অম্বিকাদা জানতেন, দাদা লোকনাথকে টেগরা অসম্ভব ভালোবাসেন এবং শ্রদ্ধাও করেন লোকনাথ এগিয়ে এলেন। অম্বিকাদা জিজ্ঞাসা করলেন— লোকনাথ, তুমি তো জানো, আমাদের দলের শৃঙ্খলা ভাঙলে আমরা কী শাস্তি দিয়ে থাকি? লোকনাথ বললেন – কেন? মৃত্যু।
এবার অম্বিকাদা বললেন টেগরা শৃঙ্খল ভঙ্গ করেছে।
লোকনাথ কোনো কথা বললেন না। কোমরের বেল্টের সঙ্গে বেঁধে রাখা রিভলবারটা হাতে তুলে নিলেন। ভাইকে প্রশ্ন করলেন – তোমার কিছু বলার আছে?
টেগরা ভাবতে পারেননি তাঁকে এইভাবে শাস্তি পেতে হবে। তিনি অপরাধীর মতো নীরবে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে রইলেন।
লোকনাথ অকম্পিত হস্তে তাঁর দিকে রিভলবার তাক করে থাকলেন—ওয়ান–টু।
অম্বিকাদা বললেন –থামো থামো। এ কী করছ? টেগরা, দেখলে তো দলের নিয়মের ওপর তোমার দাদার নিষ্ঠা কতখানি। তুমি ছোট ভাই, তা সত্ত্বেও তোমাকে নিজের হাতে মারতে চাইছিল। তোমার কাছ থেকেও আমরা এই ধরনের নিষ্ঠা আশা করছি।
টেগরা বুঝতে পারলেন, বিপ্লবী হতে গেলে কত দুঃখ কষ্ট সহ্য করতে হবে। ক্ষুধাতৃষ্ণায় কাতর হলে চলবে না। তিনি অম্বিকাদার পায়ে হাত দিয়ে বল লেন—-অম্বিকাদা আমার ভুল হয়েছে, আমাকে ক্ষমা করে দিন। এখন থেকে আমি আপনার কথা মেনে চলব।
টেগরা সম্মুখ সমরে প্রাণ দিয়ে বিপ্লবীদলের প্রতি তাঁর ভালোবাসা প্রমাণ করেছিলেন। কিছুক্ষণ বাদেই তাঁর জীবনদীপ নির্বাপিত হয়েছিল। এবারে আমরা গল্পের সব থেকে রোমহর্ষক পর্বে প্রবেশ করতে চলেছি।
বিকেল পাঁচটার সময় গুপ্তচর মারফত খবর এল, ট্রেন ভরতি ইংরেজ সৈন্যবাহিনী কাছেই এসে গেছে। তারা মাঠের ওপর দিয়ে পাহাড়ের দিকে এগিয়ে আসছে।
বিপ্লবীরা সতর্ক হয়ে উঠলেন। লোকনাথের নির্দেশে সকলে পজিশন নিলেন। শুরু হল পারস্পরিক গুলিবর্ষণ। ইংরেজ সেনারা নীচে থেকে গুলি বর্ষণ করছে—কিন্তু বিপ্লবীরা পাহাড়ের ওপর দাঁড়িয়ে আছেন, তাই গুলি করতে তাঁদের খুব সুবিধা হচ্ছে। শত্রুর গুলিতে একজনও বিপ্লবী আহত হননি। কিন্তু তাঁদের ছোঁড়া গুলিতে ইংরেজ সৈন্যদের হতাহতের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে।
শেষ পর্যন্ত ইংরেজ বাহিনী বিপ্লবীদের সাথে পেরে ওঠেনি। শিক্ষিত সৈন্যবাহিনীসহ অভিজ্ঞ শ্বেতাঙ্গ সামরিক কর্তারা কয়েকজন বাঙালি বিপ্লবীর হাতে পরাস্ত হলেন।
বিপ্লবীরা প্রাথমিক পর্বে জয়যুক্ত হলেন। বন্দেমাতরম ধ্বনি তুললেন। ঘর্মাক্ত দেহে একে অন্যকে জড়িয়ে ধরলেন। তখন ধীরে ধীরে সূর্য অস্তাচলে বসেছে। লাল আভা ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে।
না, এইভাবে লড়াই করলে সফলতা আসবে না। অভিজ্ঞ ব্রিটিশ সমর নায়কেরা বুঝতে পারলেন, এ এক অসম লড়াই। বিপ্লবীরা ওপরে দাঁড়িয়ে আছেন, সহজেই লক্ষ্যভেদ করতে পারছেন, আর নীচে দাঁড়িয়ে থাকা ইংরেজদের অসুবিধা হচ্ছে। এবার নতুন করে আক্রমণ করতে হবে। জালালাবাদের উঁচু পাহাড়ে ভারী মেশিনগান তুলতে হবে। সেখান থেকে গুলিবর্ষন করতে হবে।
বিপ্লবীদের কাছে তখনও পর্যন্ত ওই খবর পৌঁছায়নি। তাঁরা আনন্দে আত্মহারা। একজন বিপ্লবী কবি নজরুলের কবিতা আবৃত্তি করতে থাকেন। —ভাগ গিয়া ভাই, ভাগ গিয়া, জানোয়ার সব ভাগ গিয়া’
টেগরা এসে মাস্টারদার কাছে অনুমতি চাইলেন—মাস্টারদা, সামনের ওই আমলকি গাছের ডালে আমরা কী জাতীয় পতাকা তুলতে পারি? আমরা ওই গাছের নীচে দাঁড়িয়ে বিজয় উৎসব করতে চাইছি।
মাস্টারদা বুঝতে পারলেন যে, এই কিশোর বিপ্লবী আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠেছেন। এখন তাঁকে অনুমতি দিতেই হবে।
মাস্টারদা অনুমতি দিলেন। সব বিপ্লবী একে একে আমলকি গাছের কাছে এসে দাঁড়ালেন। টেগরা একটি জাতীয় পতাকা নিয়ে গাছে ওঠার চেষ্টা করছিলেন। তখনই অঘটন ঘটে গেল। এক ঝাঁক গুলি ছুটে এল সামনের পাহাড় থেকে। সেনাপতি লোকনাথ বলের নির্দেশ মতো বিপ্লবীরা তাড়াতাড়ি মাটিতে শুয়ে পড়লেন। গড়িয়ে গড়িয়ে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লেন। পাহাড়ের পাথর খণ্ডের আড়ালে লুকিয়ে থেকে জবাব দেবার জন্য তৈরি হলেন। বোঝা গেল, ইংরেজরা ভারী মেশিনগান পাহাড়ের ওপর তুলে এনেছে। এখন আর অসম লড়াই হবে না। এখন ইংরেজরা বিপ্লবীদের ডেরায় পৌঁছে গেছে। বিপ্লবী নেতা নির্মল সেনের ওপর একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। তিনি ছেলেদের বন্দুকে গুলি ভরে তাঁদের হাতের কাছে এগিয়ে দিচ্ছিলেন।
শুরু হয়ে গেল প্রত্যক্ষ সংগ্রাম। হঠাৎ মেশিনগানের এক ঝাঁক গুলি টেগরাকে ক্ষত বিক্ষত করে বেরিয়ে গেল। মেশিনগানের গুলি টেগরার গলায় যেন মালা পরিয়ে শহিদ মন্দিরে অভ্যর্থনা জানাল। রক্তাপ্লুত দেহে টেগরা মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। হাতে তখনও রাইফেল ধরা আছে। দাদা লোকনাথ এবং অন্যান্য নেতারা টেগরার কাছে ছুটে এলেন।
টেগরা তখন যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন। তবুও তাঁর ঠোঁটের কোণে কী অদ্ভুত আত্মপ্রত্যয়ী হাসি। তিনি বললেন – আমি চললাম সোনাদা, তোমরা লড়াই চালিয়ে যাও। আমি জানি, এই লড়াইতে শেষ পর্যন্ত আমরা জয়যুক্ত হবই।
২২শে এপ্রিল ১৯৩০, সূর্যাস্তের রাঙা আলোয় শহিদ হলেন টেগরা বল। একটু আগে, যাঁকে যথেষ্ট ভৎর্সনা করেছিলেন অম্বিকাদা,তাঁর দুচোখে তখন সজল অশ্রুধারা।
এক সঙ্গে সহবিপ্লবীরা সকলে স্লোগান দিতে লাগল-Long Live Revolution, Long Live Tegra-বন্দেমাতরম।
আমরা জালালাবাদ যুদ্ধের প্রথম শহীদ হিসেবে দুরন্ত দুর্দান্ত বালক টেগরাকে কে কী আজ কেও মনে রেখেছি?
টেগরা সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে মাস্টারদা সূর্য সেন বলেছেন—“আমাদের সামনে শহীদ হবার তোরণদ্বার উন্মুক্ত করল কিশোর বিপ্লবী টেগরা বল !