Alipore-Bomb-Case
আলিপুর বোমা মামলা— ১৯০৮
বাংলাদেশের বুকে একাধিক গুপ্ত সমিতি সশস্ত্র সংগ্রামের ডাক দিয়েছে। উল্লাসকর দত্তকে পাঠানো হল নারায়ণগঞ্জে। তাঁর ওপর একটি গুরুদায়িত্ব ন্যস্ত হয়েছিল। ছোটোলাটের ট্রেনে বিস্ফোরণ ঘটাতে হবে। উল্লাসকর দত্ত ঠিক সময়ে বোমা ছুঁড়লেন। ট্রেনের একটি বগি লাইনচ্যূত হল। কিন্তু ছোটোলাটের বগিতে বিস্ফোরনের ছোঁয়া লাগল না। এরপর ঢাকার ম্যাজিস্ট্রেট মিঃ এলেনকে হত্যা করার প্রচেষ্টা চালানো হল। কুষ্ঠিয়ার এক পাদরিকে হত্যা করা হল।
অরবিন্দ কলকাতায় এলেন ১৯০৮ সালে। অরবিন্দ বুঝতে পারলেন এইভাবে বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ ঘটিয়ে কোনো লাভ নেই। জনসাধারণকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। সাধারণ মানুষের মনে বিপ্লবী চেতনার সঞ্চারণ ঘটাতে হবে। তাঁর নেতৃত্বে বাংলার বিপ্লবীরা তখন সংঘবদ্ধ হলেন। শিবপুরে ডাকাতি হল। চন্দননগরে মেয়রের বাড়িতে বোমা ফেলা হল। পুলিশ তৎপর হয়ে উঠল। কোথায় গুপ্ত সমিতি আছে তার সন্ধানে চিরুনী তল্লাসী চালাতে লাগল ৷
অবশেষে ১৯০৮ সালের মার্চ মাসে ৩২ নং মুরারীপুকুর রোডের বাগানবাড়িতে পুলিশ ঢুকে পড়ল। সেখানে একটি বিরাট গুপ্ত সমিতির অস্তিত্ব আবিষ্কৃত হল ৷ আরও গুপ্ত সমিতির খোঁজে পুলিশ হন্যে হয়ে নানা জায়গায় তল্লাসি চালাতে লাগল।
মজঃফরপুরের ঘটনার খবর কলকাতার পুলিশ বড়ো কর্তাদের কানে পৌঁছে গেল। ১৯০৮ সালের ১লা মে একসঙ্গে সমস্ত বিপ্লবী আস্তানার ওপর তল্লাসি চালানো হল। অনেক বিপ্লবী ইতিমধ্যে খবর পেয়ে নিজের নিজের গ্রামে চলে গেছেন। উল্লাসকর দত্ত হ্যারিসন রোডের বাড়িতে আত্মগোপন করে বসে আছেন। হেমচন্দ্র দাস মুরারীপুকুর রোডের বাগানবাড়ি থেকে চলে এলেন গোপীমোহন দত্ত লেনে। যাবার আগে বাগানবাড়ির বাগানে সমস্ত অস্ত্র এবং বোমা নির্মাণের যন্ত্রপাতি মাটি খনন করে তার ভেতর পুঁতে দিলেন।
মাঝ রাতে পুলিশের এই অভিযান শুরু হল। উপেন্দ্রনাথ খবর পেয়ে কয়েকজন বিপ্লবীকে রাতের অন্ধকারে বাগানবাড়ি থেকে বের করে দিলেন। ভোর রাতে পুলিশের দল বাগানবাড়িতে ঢুকল। অনেক বিপ্লবীকে গ্রেপ্তার করা হল।
৩২ নং মুরারীপুকুর লেন থেকে গ্রেপ্তার হলেন বারীন ঘোষ, উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, ইন্দুভূষণ সরকার, বিভূতিভূষণ সরকার, নলিনীকান্ত গুপ্ত, শচীন্দ্রকুমার সেনগুপ্ত, বিজয়কুমার নাগ, কুঞ্জলাল সাহা, শিশিরকুমার ঘোষ, পরেশচন্দ্র মৌলিক, পূর্ণচন্দ্র সেন, নরেন্দ্রনাথ বক্সি এবং হেমেন্দ্রনাথ ঘোষ।
একই দিনে হ্যারিসন রোডের ১৩৪ নং বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করা হল নগেন্দ্রনাথ গুপ্ত, ধরণীধর গুপ্ত, মতিলাল রায়, বিজয় রত্ন এবং অশোক কুমার নন্দীকে। ৩০/২ নং, হ্যারিসন রোড থেকে চার বাক্স বোমা সমেত উল্লাস কর দত্ত, যামিনা কবি রাজকে গ্রেপ্তার করা হয়। ৩৮/৪ নং রাজা নবকৃষ্ণ স্ট্রিট থেকে গ্রেপ্তার হলেন হেমেন্দ্র চন্দ্র দাস। ১৫ নং গোপীমোহন লেন থেকে গ্রেপ্তার করা হল কানাইলাল দত্ত ও নিরাপদ রায়কে। ৫৩ নং গ্রে স্ট্রিটের নবশক্তি–র অফিস থেকে গ্রেপ্তার করা হল অরবিন্দ ঘোব, অবিনাশ চন্দ্র ভট্টাচার্য, শৈলেন্দ্রনাথ বসু এবং দীনদয়াল বসুকে।
পুলিশ হানা দিল ৪ নং হ্যারিসন রোডের যুগান্তর পুস্তকালয়ে। ১১ নং হ্যারিসন রোডের ছাত্রভাণ্ডার এবং যুগান্তর পত্রিকার অফিসেও পুলিশ অনুসন্ধান চালাল ৷ সেখান থেকে অনেক আপত্তিকর কাগজপত্র আটক করা হল।
ধীরে ধীরে বোঝা গেল আরও অনেক তরুণ এইসব গুপ্তদলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আছেন। বিপ্লবীদের কাছ থেকে যেসব চিঠিপত্র পাওয়া গেল, তারই সূত্র ধরে পুলিশ হৃষিকেশ কাঞ্জিলাল, সুধীরকুমার সরকার, বীরেন্দ্রনাথ ঘোষ, কৃষ্ণজীবন সান্যাল এবং নরেন্দ্রনাথ গোস্বামীকে গ্রেপ্তার করে। নরেন গোঁসাইকে গ্রেপ্তার করা হয় তাঁর শ্রীরামপুরের বাড়ি থেকে। গ্রেপ্তার করা হল হেমচন্দ্র সেন, বীরেন্দ্রচন্দ্র সেন, সুশীলচন্দ্র সেন এবং দেবব্রত বসুকে। সত্যেন বসুকে গ্রেপ্তার করা হল মেদিনীপুর থেকে।
এইভাবে বাংলার বিপ্লবীদের ওপর চরম আঘাত করা হল। আলিপুর বোমা মামলা নামে একটি মামলা পাঠানো হল। আসামীদের বিরুদ্ধে চার্জশীট গঠন করা হল।
শুরু হল বিচারের নামে প্রহসন। আলিপুরের ম্যাজিস্ট্রেট মিস্টার বার্লি তিনমাস ধরে বিচার চালালেন। এবার সমস্ত আসামীকে জজ আদালতে পুনর্বিচারের জন্য পাঠানো হল। উল্লাসকর দত্ত এবং যামিনী কবিরাজকে পাঠানো হল হাইকোর্টে। হাইকোর্টের বিচারে সকলের সাত বছর করে সশ্রম কারাদণ্ড হল। এবার উল্লাসকর দত্তকে আবার নতুন করে আসামী সাজিয়ে আলিপুর বোমা মামলার জন্য পাঠানো হল। এইভাবে আলিপুর বোমা মামলাটি জটিল ও রহস্যজনক হয়ে ওঠে।
অরবিন্দ ঘোষের জন্য দাঁড় করানো হল, তখনকার দিনের বাংলার সেরা আইনজীবী ব্যোমকেশ চক্রবর্তীকে। তিনি দৈনিক এক হাজার টাকা করে পারিশ্রমিক নিতেন। একুশ দিন পর কোন অজ্ঞাত কারনে এই মামলা থেকে নিজেকে সরিয়ে নিলেন। তখন এগিয়ে এলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ। তিনি ছিলেন এক বিখ্যাত আইনবিদ। দানবীর হিসেবেও তাঁকে আমরা সবসময় মনে রাখব। তিনি বিনা পারিশ্রমিকে অরবিন্দের পক্ষ অবলম্বনের সিদ্ধান্ত নিলেন।
অরিনাশচন্দ্র ভট্টাচার্যের জন্য এলেন ঢাকার প্রধান উকিল শ্রীআনন্দমোহন রায়। এগিয়ে এলেন ব্যারিস্টার শ্রী পি. মিত্র, রজত রায়, বি. সি. চ্যাটার্জী, নরেন্দ্রকুমার বসু, সুরেন্দ্রনাথ সেন। তাঁরা সকলেই বিনা পারিশ্রমিকে বিপ্লবীদের পক্ষ অবলম্বন
করলেন।
সরকার পক্ষে দাঁড়ালেন ব্যারিস্টার মিস্টার নর্টন, মিস্টার বার্টন এবং মিস্টার উইথহল। তাঁদের সহকারী ছিলেন আশুতোষ বিশ্বাস। মামলা তদারক করতে থাকলেন তদানিন্তন পুলিশের কুখ্যাত সি. আই. ডি ইন্সপেক্টার মৌলবী সামসুল আলম ৷
রুদ্ধশ্বাস প্রতীক্ষার অবসান ঘটে গেল। ১৯০৯ সালের ৬ই মে। বহু আলোচিত আলিপুর বোমা মামলার রায় দিলেন বিচারপতি বিচক্রফট। এই রায়ের ফলে বারীন ঘোষ এবং উল্লাসকর দত্তকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হল। বলা হল, তাঁরাই হলেন প্রধান রাজদ্রোহী।
হেমচন্দ্র দাস, উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়কে যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর দণ্ডে দণ্ডিত করা হল। এঁরা ইংরেজ রাজত্ব উচ্ছেদ করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু প্রত্যক্ষভাবে হত্যাকাণ্ড করেননি, তাই এঁদের অপরাধ কিছু কম বলে মনে করা হল।
বিভূতিভূষণ সরকার, অবিনাশচন্দ্র ভট্টাচার্য, হৃষীকেশ কাঞ্জিলাল, ইন্দুভূষণ রায়, সুধীরকুমার সরকার ও শৈলেন্দ্রনাথ সরকারকে যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর দণ্ডে দণ্ডিত করা হল। এঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হল যে, এঁরা প্রথম থেকেই বারীন ঘোষকে সব ব্যাপারেই সাহায্য করে গেছেন ।
অরবিন্দ ঘোষ, দেবব্রত বসু, দীনদয়াল বসু, শচীন্দ্রকুমার সেনগুপ্ত, পূর্ণচন্দ্র সেন, বিজয়কুমার নাগ, নলিনীকান্ত গুপ্তকে মুক্তি দেওয়া হল। তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযুক্ত করার মতো প্রত্যক্ষ সাক্ষ্য ও প্রমাণ পাওয়া গেল না।
এগিয়ে এলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ। সকলের জন্য হাইকোর্টে আপীল করা হল। হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি জেঙ্কিনস এবং বিচারপতি কারানড্রক তাঁদের পুনর্বিচার শুরু করলেন। হাইকোর্টের রায় বের হল। বারীন ঘোষ এবং উল্লাসকর দত্তের ফাঁসির পরিবর্তে হল যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। হেমচন্দ্র দাস ও উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের দ্বীপান্তর একই রকম থাকল। অবিনাশচন্দ্র ভট্টাচার্য ও বিভূতিভূষণ সরকারের যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরের পরিবর্তে সাত বছরের স্বশ্রম কারাদন্ড দেওয়া হল। হৃষীকেশ কাঞ্জিলাল ও ইন্দুভূষণ রায়কে দেওয়া হল দশ বছরের দ্বীপান্তর ও শৈলেন্দ্র বসুর হল পাঁচ বছরের কারাদণ্ড ।
এইভাবে এক বিয়োগাত্মক পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে ভারতীয় বৈপ্লবিক আন্দোলনের একটি অধ্যায় শেষ হল।