
হাতের রেখা কেন বদলে যায়?
হাতের রেখা কেন বদলে যায়?
জ্যোতিষশাস্ত্রে হস্তরেখা বিচার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিভিন্ন পদ্ধতি রয়েছে হস্তরেখা বিচারের জন্য। হৃদয়রেখা, শিরারেখা, রবিরেখা, ভাগ্যরেখা ইত্যাদি বহু রেখা হাতে পাওয়া হয়। রেখাগুলির চুলচেরা বিশ্লেষণ হল হস্তরেখা বিচার।
বিজ্ঞান বলে যে হাতের রেখাগুলি তৈরি হয়েছে হাতের তালু ভাঁজ ও আঙুলগুলি সঞ্চালনের জন্য। অর্থাৎ পূর্বপুরুষ সূত্রে কিছু বৈশিষ্ট একটি শিশুর মধ্যে থাকবেই। যেমন খাবে, কাজ করবে, ইত্যাদি। শিশুর হাতের আঙুল সঞ্চালনগুলিও যাতে সহজে হয়, তাই প্রকৃতির নিয়মে কিছু হস্তরেখা (সাধারণ রেখা) থাকবেই। জন্মের সময় বাচ্চার দুটি হাতের প্রধান রেখাগুলি প্রায় একইরকম থাকে। পরবর্তীকালে বাচ্চাটি যদি ডানহতি হয়, তবে তার ডান হাতের রেখা গুলি বামহাতের তুলনায় তার কর্ম অনুয়ায়ী বেশি পরিবর্তিত হয়। আর বাঁহতি হলে,বামহাতের রেখাগুলি ডানহাতের তুলনায় বেশি পুষ্ট বা পরিবর্তিত হয়।
মানুষের জীবন কয়েকটি ভাগে বিভক্ত শৈশব, কৈশোর,যৌবন, প্রৌঢ়ত্ব,বার্ধক্য।
শৈশবে রেখাগুলি পরিপুষ্ট থাকে না। কৈশোর থেকে রেখাগুলি পরিবর্তিত হতে শুরু করে। যদিও হাতের রেখাগুলি বার্ধক্য অবধি পরিবর্তিত হয়।
যাদের মন-মানসিকতা দ্রুত পরিবর্তিত হয়, তাদের হাতের রেখাগুলিও দ্রুত পরিবর্তিত হয়, (রং,দিক ইত্যাদি) এবং তাদের হাতে বেশি অপরিচ্ছন্ন রেখা থাকে।যাদের মানসিকতা দৃঢ়, তাদের রেখা কম থাকে ও রেখাগুলি পরিষ্কার থাকে, হাতের তালুও পরিস্কার হয়।
দ্রুত পরিবর্তনশীল মানুষদের ক্ষেত্রে দেখেছি যে তাদের হাতের রেখা ১৮-২১ দিনের মধ্যেই পরিবর্তিত হয়। আর দৃঢ় মানসিকতা সম্পন্ন মানুষদের ১-২ সময় লাগে।
মস্তিষ্কের চিন্তা ও মানুষের পেশার সঙ্গে হস্তরেখার গভীর যোগ আছে অর্থাৎ একই মানসিকতাসম্পন্ন বা একই পেশায় কর্মরত মানুষদের হাত ও হাতের রেখাগুলির মধ্যে মিল থাকে। কারণ একটি নির্দিষ্ট কর্ম দীর্ঘদিন ধরে করলে হাতের তালুতে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় ক্রমাগত চাপ পড়ার সম্ভাবনা বেশি।তাই বেশি ব্যবহৃত অংশ উন্নত বা পরিবর্তিত হবেই— এটাই নিয়ম।
যেমন— জিম করলে পেশি উন্নত হয়। একটা ছোট উদাহরণ দিলাম— একজন শিক্ষক বেশি পেন/চক ব্যবহার করবে—এটা স্বাভাবিক বা আঙুলের তর্জনী বেশি ব্যবহার করে। তাই তর্জনী এবং তর্জনীর গোড়া অর্থাৎ বৃহস্পতির পর্বত বেশি উন্নত হবেই— এটাই বাস্তব।
একইরকমভাবে যাঁরা নেতা বা ধর্মীয় গুরু তারাও তর্জনী বেশি ব্যবহার করে (উপদেশ/আদেশ)। তাদের ক্ষেত্রেও বৃহস্পতি উন্নত হওয়া স্বাভাবিক। তাই শিক্ষক/ নেতা/ ধর্মগুরু বা যে কোনও উপদেশ দেওয়া সংক্রান্ত পেশায়. বৃহস্পতির ক্ষেত্র উন্নত বা যে কোনও চতুষ্কোণ / ত্রিভুজ বা ঊর্ধ্বমুখী রেখা থাকে।
সুতরাং একই কর্মে কর্মরত ১০০ জন ব্যক্তির হাতে যদি একইরকম কিছু চিহ্ন বা মিল থাকে এবং ১০১তম ব্যক্তির হাতে যদি এই একইরকম কিছু মিল থাকে, তবে ১০১তম ব্যক্তির এই পেশায় দক্ষতা থাকার সম্ভাবনা থাকেই। এতে আশ্চর্যের কিছু নেই। তবে উল্টোটা সত্যি নয়।অর্থাৎ একজন শিক্ষকের হাতে যে বৃহস্পতি উন্নত হবে এমনটা নাও হতে পারে।
এবার অনেকের মনেই প্রশ্ন আসবেই যে কী কী পেশায় কী কী মিল পাওয়া যায়। সেগুলি এক ঝলকে আমরা দেখে নেব
১) শিক্ষকঃ বৃহস্পতির ক্ষেত্রে চতুষ্কোণ, ত্রিভুজ, ঊর্ধমুখীরেখা। বুধের ক্ষেত্রে প্রশস্ত। শুক্র নির্মল। এর মধ্যে যাঁদের মঙ্গল, শনি, রাহু উন্নত তাঁরা বিজ্ঞান বিভাগে দক্ষ। যাঁদের শুরু চন্দ্র উন্নত তারা আর্টস-এ দক্ষ। রবি শুভ হলে সুনাম হয়।
২) ইঞ্জিনিয়ারঃ শিরোরেখা সরল ও লম্বা। শনির ক্ষেত্র পুষ্ট। শুরু শুভ। হাতের আকার চতুস্কোণ। নখ ছোট আঙুল ছুঁচালো। বুধ ও রবি রেখা স্পষ্ট।
৩)ডাক্তারঃ শিরোরেখা গভীর, চন্দ্র পুষ্ট। বৃহস্পতি প্রশস্ত। শিরোরেখার অংশ বৃহস্পতিগামী। বুধের ক্ষেত্রে Medical Stigma (মেডিশাল স্টিগমা) থাকে। আঙুল লম্বাটে। রবি রেখা স্পষ্ট। মার্শালরেখা থাকে রবি-মঙ্গল সংযোগ রেখা থাকে।
৪)রাজনীতিবিদঃ বৃহস্পতিতে সলোমন রিং বা চতুষ্কোণ থাকে। ভাগ্যরেখা চন্দ্র থেকে শনির ক্ষেত্রে প্রবেশ করে। মার্শালরেখা থাকে। শুক্রের ক্ষেত্র অনুন্নত। শনি প্রশস্ত। রবিরেখা বড়৷
৫)গবেষকঃ রাহুর ক্ষেত্র প্রশস্ত। চন্দ্রের ক্ষেত্রে ত্রিকোণ চিহ্ন।শিরোরেখা নিম্নগামী।বুধের ক্ষেত্রে একাধিক ঊর্ধ্বমুখী রেখা।ভাগ্যরেখার একটি অংশ রবিতে যায়। বৃহস্পতি উন্নত। কেতুতে প্রায়শই মিষ্টিক রুশ থাকে। তবে একাধিক রাহুরেখা থাকে।
৬)শিল্পীঃ চন্দ্র থেকে ভাগ্যরেখা শুরু। শুক্রের ক্ষেত্রে তিল, ভাল থাকতে পারে বা শুরু খুব উন্নত হয়। চন্দ্র উন্নত। রবিরো বড়। হাতের তালু নরম ও গোলাপি। হাত ছুঁচালো আঙুল সরু। শিরোরেখা বড়।
৭)অর্থনীতিঃ আঙুল ভোঁতা। বৃহস্পতি বুধ উন্নত। কেতু খুব উন্নত। বৃহস্পতি-শনি সংযোগ রেখা থাকে। বুধে ত্রিকোণ প্রায়শই থাকে। রবিরেখা স্পষ্ট ও নিম্নগামী।
৮)আধ্যাত্মিকতাঃ একাধিক রাহুরেখা থাকে। শুরুক্ষেত্রে ছোট। মার্শালরেখা থাকে। হৃদ্যারেখা সরল ও মসৃণ হয়। একাধিক শিরোরেখা থাকে।বৃহস্পতিতে সলোমন রেখাও থাকে। ছন্দ্রে ত্রিকোণ।শনিতে
“Y” চিহ্ন বা বৃহস্পতিতে পতাকা চিহ্ন থাকে।
৯)পুলিস মিলিটারিঃ রবিরেখা মঙ্গলগামী। শুক্রে একাধিক প্রভাবরেখা। রাহু প্রশস্ত। হাত পরিষ্কার হয়। হৃদয়রেখা প্রায়শই ছোট। শিরোরেখা গভীর হয়। রবি-মঙ্গল সংযোগ রেখা থাকে। মঙ্গল শুভ।
শুধু পেশায় নয়, জীবনের অন্যান্য দিক যেমন— বিবাহ, খ্যাতি, সম্মান ইত্যাদি বিষয়েও কিছু নির্দিষ্ট মিল বা সুত্র পাওয়া যায়। দীর্ঘদিন ধরে এই মিলগুলির ওপর ভিত্তি করেই হস্তরেখা বিচার ব্যবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। হস্তরেখা হল মানুষের চিন্তার বা কর্মদক্ষতার বা জন্মগত গুণাবলির প্রতিচ্ছবি বা ইঙ্গিতবাহক। রেখাগুলি যেহেতু পরিবর্তনশীল, তাই হস্তরেখা থেকে সুদূরপ্রসারী ভবিষ্যৎ গণনা অনেক সময় নাও মিলতে পারে। আমার ব্যক্তিগত মতামত যে— হস্তরেখায় ১ বছর আগের ও ১ বছর পরের অতীত/ ভবিষ্যৎ নিখুঁতভাবে পাওয়া সম্ভব। ব্যক্তিগতভাবে আমি একটি সমীক্ষায় দেখেছি যে— যাঁরা শিক্ষক, তাঁদের ১০০ জনের মধ্যে ৮২ জনের বৃহস্পতি উন্নত অর্থাৎ ৮২ শতাংশ ব্যক্তির ক্ষেত্রে মিল। এমনকী শিক্ষকদের মধ্যে বৃহস্পতির ক্ষেত্র উন্নত তো বটেই।উপরন্তু যাঁদের মঙ্গল ভালো তাঁরা রসায়ন, জীববিদ্যা, ভূগোলে দক্ষ।
যাঁদের বুধ ভালো, তাঁরা গণিত, স্ট্যাটিসটিক্স,কমার্সে এ দক্ষ।
যাঁদের রাহু ভালো, তাঁরা টেকনিক্যাল গবেষণা, মহাকাশ গবেষণা, মেকানিক্স-এ দক্ষ।
যাঁদের শুক্র ভালো, তাঁরা পদার্থবিদ্যা, সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং ইত্যাদিতে দক্ষ।
যাঁদের শনি ভালো তাঁরা ইতিহাস, যন্ত্রাংশবিদ্যা, ইংরাজিতে দক্ষ।
শুভ চন্দ্রে টেক্সটাইল, সাহিত্য, ট্রাভেল ট্যুরিজম, নার্সিং-এ ভালো হয়।
শুভ বৃহস্পতি দর্শন, সংস্কৃত, ম্যানেজমেন্ট, লাইব্রেরি সায়েন্স ভালো হয়।
রবি শুভ হলে সাহিত্য, ডাক্তার, শিল্পী, রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ভালো হয়।
শুভ কেতু- জ্যোতিষ, গনিত (Pure Mathematics), স্ট্যাটিসটিক্স, তন্ত্র-মন্ত্রবিদ্যা।
সুতরাং সমস্থ পেশা কোনও না কোনও গ্রহগুলির বিন্যাস সমবায়ে নির্দেশিত।হস্তরেখা বিচার সমীক্ষালব্ধ কয়েকটি সূত্রের প্রয়োগমান, কোনও ব্যক্তির ব্যক্তিগত মতামত নয়। শাস্ত্রটি স্থান-কাল-পাত্রের উপর নির্ভর করবে। কারণ আগেই বলেছি যে এটি সমীক্ষালব্ধ।একটি উদাহরণ নিলেই ব্যাপারটা পরিস্কার হবে। ধরা যাক,
একজনের হাতের অর্থভাগ্য শুভ। কিন্ত সে একটি বস্তি এলাকার মানুষ। আরেকটি একই রকম হাত পেলাম মুম্বাইয়ের ধনী সমাজের একজনের। তাহলে দু’জনের একই অর্থ হওয়ার কোথা। কিন্ত বাস্তবে বস্তির ছেলের উপার্জন ১ লাখ হলে মুম্বাইয়ের ছেলেটির ১ কোটি।
কিন্ত কেন? আসলে বস্তির ছেলেটির উপার্জন পারিপার্শ্বিক লোকদের তুলনায় ধনী। তাই স্থান ভেদে জ্যোতিষের সুত্র বা সমিক্ষার ফলগুলিও ভিন্ন হয়।
গ্রাম্য এলাকায় বিবাহ বিচ্ছেদ প্রায় হয় না বললেই চলে। তাতে বিবাহরেখায় চ্যুতি, শুক্রে তিল বা যায়ইথাকুক না কেন। কিন্তু উন্নত সমাজের মানুষদের বিবাহরেখায় কিছু অশুভ চিহ্ন থাকলেই বা অন্যান্য অশুভ থাকলেই বিবাহ বিচ্ছেদ নিশ্চিত হয়আজ থেকে ৫০ বছর আগে বিবাহ বিচ্ছেদ কম হত। আজ বেশি হয়। তাই জ্যোতিষসূত্রগুলিও কালের ওপর নির্ভরশীল,
কিছু প্রশ্নের উত্তর
১) মানুষের হস্তরেখা বিচার হয়, অন্যান্য প্রাণীদের কেন হয় না ?
উত্তরে একটাই কথা বলব যে, তাদের হস্তরেখা (যেমন, বাঁদর, শিম্পাঞ্জি ইত্যাদি) বিচার সম্ভব, কিন্তু এখন পর্যন্ত কেউ বা আমি নিজেও এমন সমীক্ষা করিনি।শুধুমাত্র মানুষের ওপরেই হাজার হাজার বছর থেকে সমীক্ষা চলেছে। আমরা অন্য কোনও প্রাণীকে নিয়ে হয়তো ভাবিনি।
২) যাঁদের হাত নেই বা কাটা, তাঁদের ক্ষেত্রে কি হয় ?
উত্তরে বলব যে, হস্তরেখা ব্যক্তির মনের প্রতিচ্ছবির একটি প্রতীক চিহ্ন। তাই প্রতীকী চিহ্ন নষ্ট হলে অন্যান্য উপায়ে (যেমন কুণ্ঠিবিচার) অনুমান করা যেতে পারে। তাঁদেরও ভাগ্য আছে এবং তাঁদেরও ভাগ্য নির্ধারণ করা যেতে পারে।
৩)একটি নির্দিষ্ট এলাকার মানুষের একটি নির্দিষ্ট কর্মে দক্ষতা থাকে তাহলে ওই এলাকায় সব মানুষেরই একটি গ্রহ একটি নির্দিষ্ট গ্রহদের বিন্যাস শুভ থাকে?
উত্তরে বলব যে, জ্যোতিষ স্থান, কাল, পাত্র মেনে একটি সমীক্ষালব্ধ ফল। যেমন কাতার দেশে খনিজ তেল সংক্রান্ত শিল্পে প্রসিদ্ধ। তাই সবার শনি,চন্দ্র ভালো এমন নয়। যাঁদের হাতে ব্যবসা ভাগ্য আছে তাঁরাই ব্যবসা করবেন। যাঁদের চাকুরী আছে তাঁরা চাকুরিই করবেন। কাতারে চিকিৎসক,শিক্ষক, ইঞ্জিনিয়ার সবই আছে। তাই কাতারের হস্তরেখা বিচারের সূত্রগুলি ভারতবর্ষের সঙ্গে মিলবে না।
কিছু তফাৎ হবেই। সমীক্ষা স্থাননির্ভর।
যাই হোক, পরিশেষে এটাই বলব যে, আমাদের জ্যোতিষবর্গকে আরও আরও পরিশ্রম করা দরকার যেন সূক্ষ্মভাবে সাজাতে পারি। সর্বসাধারণকেও সজাগ থাকতে হবে, যাতে তাঁরা কোনও অসৎ জ্যোতিষীর পাল্লায় না পড়েন। শাস্ত্রটির হৃত সন্মান ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব আমাদের সবার ১০০ শতাংশ মেলানো সম্ভব নয় , তবে বেশ কিছু জীবনের বড় বড় ঘটনার আভাস আমরা পাবই পাব।
আমরা ‘হস্তরেখা বিচার’ শাস্ত্রটির শুভ গুণগুলির প্রয়োগ আমাদের ব্যবহারিক জীবনে করতেই পারি হয়তো কিছু আগাম আভাস পেয়ে যাব।