
রঙিন মাছের রোগের লক্ষণ ও প্রতিকার
রঙিন মাছের রোগের লক্ষণ ও প্রতিকার
রঙিন মাছ বিভিন্ন ধরনের রোগে আক্রান্ত হতে পারে। রোগের কারণ অনুযায়ী রোগের বাহ্যিক উপসর্গ প্রকাশ পায়। এই উপসর্গ দেখে রোগ সনাক্তকরণ করা হয়। এখানে রঙিন মাছের রোগ এবং তার প্রতিকার সম্বন্ধে জানানো হলো—
(১) সাদা ছোপ রোগঃ
রোগ– দেহে ও পাখনায় লবণের দানার মতো ক্ষুদ্র সাদা ছোপ ছোপ দাগ দেখা যায়। অতিরিক্ত শ্লেষ্মা ক্ষরণ হয়। পাখনা কুঁচকে যায়। শ্বাস ও খাদ্য গ্রহণে সমস্যা হয় ।
কারণ—ইকথিওপথিরিয়াস নামে প্রোটোজোয়া ঘটিত রোগ।
প্রতিকার— ফরমালিন দ্রবণ (1:5000), সাধারণ লবণের দ্রবণ (2%), ম্যালাকাইট গ্রিন (1:10000), তুঁতে বা কপার সালফেট দ্রবণ (1:2000)-এর যে কোনো একটি দ্রবণে রোগের প্রাদুর্ভাব অনুযায়ী 3-7 দিন প্রতিদিন 5-10 মিনিট করে রাখলে এই রোগ নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এছাড়া টীকাকরণ করে রোগ প্রতিরোধ করা যায়।
(২) ঘূর্ণন রোগঃ
রোগ– দেহের ভারসাম্য বিঘ্নিত হয় ও মাছের ঘূর্ণন গতি দেখা যায়। মেরুদণ্ড ক্ষয়ে যায় ফলে দেহ ও পুচ্ছ পাখনা বেঁকে যায়। লেজ থেকে পায়ু পর্যন্ত কালচে হয়ে যায়। সংক্রমণ মারাত্মক হলে মস্তক, চোয়াল ও কানকো বেঁকে যায়
কারণ— মিক্সোবোলাস নামক প্রোটোজোয়া ঘটিত রোগ।
প্রতিকার— মিক্সোবোলাসের স্পোর মাছের শরীরে অনুপ্রবেশের 35-46 দিন পর লক্ষণ প্রকাশ পায়। সংক্রামিত মাছ অপসারণ করতে হয়। খাদ্যের সঙ্গে অ্যান্টিপ্রোটোজায়িক ও অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ করা যায়। এছাড়া ক্যালশিয়াম সায়ানাইড (0.2 গ্রাম/লিটার) দ্রবণও প্রয়োগ করা যায় ৷
(৩) ট্রাইকোডিনিয়াসিস রোগঃ
রোগ– এপিডার্মিস নষ্ট হয়ে যায় ও দেহে অস্বচ্ছ নীল আস্তরণ পড়ে। ছোট মাছের পাখনারশ্মির মধ্যবর্তী অংশ নষ্ট হয়ে যায়। রোগের প্রকোপ বেশি হলে সারা দেহ শ্লেষ্মাস্তরে ঢেকে যায়। রোগের পরিণত দশায় মাছ রোগা হয়ে যায়, সুস্থির থাকতে পারে না। অলস হয়ে পড়ে ও অবশেষে মারা যায়।
কারণ— ট্রাইকোডিনা নামক প্রোটোজোয়া ঘটিত রোগ।
প্রতিকার— ফরমালিন দ্রবণ (1:4), সাধারণ লবণের দ্রবণ (2-3%), পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট (3-5 পিপিএম)-এর যে কোনো একটি দ্রবণে রোগের প্রাদুর্ভাব অনুযায়ী 1-2 দিন প্রত্যহ 15-30 মিনিট রাখলে এই রোগ নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
(৪) ড্রপসিঃ
রোগ— মাছের পেটে দেহরস জমে অস্বাভাবিক ফুলে ওঠে। আঁশ উঠে যায়। রোগের পরিণত দশায় মাছ সাঁতার কাটার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে ও জলে ওঠানামা করে।
কারণ— অ্যারোমোনাস নামক ব্যাকটেরিয়া ঘটিত রোগ।
প্রতিকার–
(i)ক্লোরামফেনিকল, টেট্রাসাইক্লিন জাতীয় অ্যান্টিবায়োটিক (250 মিগ্রা) খাদ্যের (25 গ্রা) সঙ্গে মিশিয়ে প্রতি 12টি মাছের জন্য অথবা 10 মিগ্রা প্রতি লিটার জলে প্রয়োগ করতে হয়।
(ii)আঁশের নীচের শরীরের মধ্যে জল জমে পেট ফুলে ওঠে। ড্রামে পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট এর দ্রবণে কিছু সময় ছেড়ে রাখলে সুফল মিলবে।
(৫) ফিনরট বা টেলরট–লেজ ও পাখনা পচা রোগঃ
রোগ– মাছের পাখনা ও লেজ ভঙ্গুর হয়ে যায়। পাখনারশ্মি উন্মুক্ত হয়ে পড়ে। পাখনা প্রান্তে রক্ত জমা হয়। ত্বকে ঘা হয় ও চোখ ঘোলাটে হয়।
কারণ— অ্যারোমোনাস নামক ব্যাকটেরিয়া ঘটিত রোগ।
প্রতিকার—
(i)ক্লোরামফেনিকল, টেট্রাসাইক্লিন জাতীয় অ্যান্টিবায়োটিক (250 মিগ্রা) খাদ্যের (25 গ্রা) সঙ্গে মিশিয়ে প্রতি 12টি মাছের জন্য অথবা 20-30 মিগ্রা প্রতি লিটার জলে প্রয়োগ করতে হয়।
(ii)প্রথম অবস্থায় মাছের গায়ে সাদা ছোপ দেখতে পাওয়া যায়। সেখান থেকেই পচন শুরু হয়। অবশেষে মাছটি মারা যায়। মাছকে তুঁতে জলে রাখা দরকার।
ফুলকার পচনঃ
রক্তবাহী শিরাগুলো বন্ধ হয়ে যায়। মাছের শ্বাসকষ্ট হয়। মাছ জলের ওপর ভেসে ওঠে। মাছকে লবণ জলে রাখুন।
(৬) নিওন টেট্রা রোগঃ
রোগ– নিওন টেট্রা মাছের উজ্জ্বল নীল–সবুজ দাগ বিবর্ণ হয়। পেশী দুর্বল হয়ে পড়ে। ত্বকের নিচে সাদাটে দাগ দেখা যায়। মাছ অস্বাভাবিক সাঁতার কাটে।
কারণ— মাইক্রোস্পোরিডিয়াম নামক স্পোরোজোয়া ঘটিত রোগ।
প্রতিকার — খুব সংক্রামক রোগ। এই রোগ দেখা দিলে সব মাছ সরিয়ে ফেলতে হয়। . অ্যাকোয়ারিয়াম শোধনের পর নতুন করে মাছ প্রতিপালন শুরু করতে হয়।
(৭) কলাম্নারিস বা মাউথ ফাঙ্গাসঃ
রোগ– মুখ অঞ্চল, বিশেষ করে ওষ্ঠে ধূসর রঙের ছোপ দেখা যায়। গাপ্পি, প্লাটি,মলি মাছেদের পিছন দিকে এই ছোপ দেখা যায়। পরে আক্রান্ত অংশে লাল ঘা দেখা যায়। ফুলকাও আক্রান্ত হয় ও মাছ মারা যায়। এই রোগ খুবই ভয়ঙ্কর এবং সংক্রামক রোগ অ্যাকুরিয়ামের মধ্যে একটি মাছের হলে, বাকি সব মাছের এই রোগে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা ১০০ শতাংশ , বিশেষ করে লাইভ বেয়ারার অর্থাৎ যে জাতের মাছ সরা সরি বাচ্চা পারে ।
কারণ– কলাম্নারিস নামক ব্যাকটেরিয়া ঘটিত রোগ।
প্রতিকার— পেনিসিলিন প্রতি লিটার জলে 10,000 একক প্রয়োগ করা যায়। এছাড়া ক্লোরোমাইসেটিন প্রতি লিটার জলে 10-20 মিগ্রা হারে 2 দিন প্রয়োগে সুফল পাওয়া যায়।
(৮) কৃমি জাতীয় রোগঃ
রোগ— ফুলকা বিবর্ণ হয়ে যায়। ফুলকায় অস্বাভাবিক শ্লেষ্মা জমে। মাছ শ্বাসকষ্টে জলের উপরিতলে খাবি খায়। মাছ কানকো খুলতে পারে না। ফুলকা থেকে কৃমি ঝুলতে দেখা যায়।
কারণ— ড্যাকটাইলোগাইরাস নামক ফুলকা কৃমিঘটিত রোগ।
প্রতিকার— ব্লিচিং পাউডার (0.05 গ্রা./লিটার জলে) প্রয়োগ করা যায়। প্রতি লিটার জলে 2 মিলিলিটার 25% অ্যামোনিয়া দ্রবণ প্রয়োগ করা যায়। এছাড়া সাধারণ লবণের 5% দ্রবণ বা ফরমালিনের দ্রবণ (250-300 মিলি প্রতি লিটার জলে)-এ 30 মিনিট রাখা যায়।
(৯) স্যাপ্রোলেগনিয়াসিস রোগ বা কটন উল রোগঃ
রোগ— সারা দেহে মাদুরের মতো সাদা অথবা ধূসর রঙের আস্তরণ পড়ে। মাছের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়। মাছ দুর্বল হয়ে পড়ে।
কারণ— স্যাপ্রোলেগনিয়া নামক ছত্রাক ঘটিত রোগ।
প্রতিকার— ফরমালিন দ্রবণ (প্রতি লিটার জলে 150-300 মিলি)-এ 30-45 মিনিট, ম্যালাকাইট গ্রীণ দ্রবণ (প্রতি লিটার জলে 1-3.3 মিগ্রা.)-এ 1 ঘণ্টা অথবা মিথিলিন ব্লু দ্রবণ (প্রতি লিটার জলে 10-20 মিগ্রা.)-এ 15 মিনিট আক্রান্ত মাছগুলি রাখা যায়।
(১০) লার্নিয়াসিস বা অ্যাঙ্কর ওয়ার্ম রোগঃ
রোগ– মাছ কোনো শক্ত বস্তুর সঙ্গে দেহ ঘষে। আক্রান্ত জায়গায় সাদাটে সবুজ সুতোর মতো অংশ ঝুলতে দেখা যায়। মাছ দুর্বল হয়ে পড়ে। ওজন কমে যায় ও অস্বাভাবিক সাঁতার কাটে।
কারণ— স্যাপ্রোলেগনিয়া নামক ছত্রাক ঘটিত রোগ।
প্রতিকার— সাধারণ লবণের 3-5% দ্রবণে 30 মিনিট বা পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেটের 2 পিপিএম দ্রবণে 1-2 ঘণ্টা রাখা যায়। এছাড়া ব্রোমেক্স 0.12 পিপিএম বা মিগ্রা/লিটার ব্যবহার করা যায়।
(১১) মাছের উকুনঃ
রোগ– মাছ কোনো শক্ত বস্তুর সঙ্গে দেহ ঘষে। মাছ অত্যন্ত দ্রুত গতিতে অস্বাভাবিকভাবে সাঁতার কাটে এমনকি অ্যাকোয়ারিয়ামের বাইরে চলে যেতে চায়। মাছের গায়ে উকুন লেগে থাকে যা খুব ভালো করে পর্যবেক্ষণ করলে নজরে পড়ে। মাছের দেহে ছোট গোলাকার লাল ক্ষত দেখতে পাওয়া যায়। দেহে অতিমাত্রায় শ্লেষ্মা ক্ষরণ হয়। আঁশ উঠে যায়। মাছ দুর্বল হয়ে পড়ে ও ওজন কমে যায়।
কারণ — আরগুলাস নামক বহিঃপরজীবী ঘটিত রোগ।
প্রতিকার— বড় মাছের দেহ থেকে ফরসেপ দিয়ে ফেলে দেওয়া যায়। পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেটের 10 মিলিগ্রাম প্রতি লিটার জলে মিশিয়ে 10-30 মিনিট রাখা যায়। এছাড়া ব্রোমেক্স 0.12 পিপিএম ব্যবহার করা যায়।
(১১) মাছের জোঁকঃ
রোগ– খালি চোখে মাছের দেহে জোঁক (1-5 সেন্টিমিটার) দেখা যায়। মাছের দেহে ক্ষতচিহ্ন দেখা যায়। মাছের ক্ষত জায়গায় ছত্রাক, ব্যাকটেরিয়া আক্রমণ ঘটে ও ক্ষত ঘাতে পরিণত হয়। মাছ দুর্বল হয়ে পড়ে ও ওজন কমে যায়।
কারণ— জোঁক নামক বহিঃপরজীবী ঘটিত রোগ।
প্রতিকার— বড় মাছের দেহ থেকে ফরসেপ দিয়ে ফেলে দেওয়া যায়। সাধারণ লবণ জলে মাছ কিছুক্ষণ রেখে দিতে হয়। পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট, কলিচুন, লাইসল, ক্লোরিনযুক্ত জল, ট্রাইক্লোরোফর্ম দ্রবণেও রাখা যায়।
(১২) টিউবারকিউলোসিসঃ
সব জাতের মাছেরই এই রোগ হতে পারে । এই রোগ হলে মাছ রোগা হয়ে যায় , মাছের পেট বসে যায় , মাছের খিদে কমে যায় , মাছের রঙ হাল্কা হয়ে যায় , অনেক সময় মাছের চোখ দুটি বড় হয়ে ঠেলে যেন বাইরের দিকে বেরিয়ে আসে ।
(১৩) সুইম ব্লাডার ডিসঅডারঃ
এই রোগ টি পেট ফোলা রোগ নামেও পরিচিত । এই রোগ সব জাতের মাছের হতে পারে । এই রোগ হলে মাছের পেটটি ফুলে ওঠে , প্রাথমিক অবস্থায় মাছটি জলের মধ্যে সাঁতার কাটতে অসুবিধা হয় ,পরে রোগ টি বেড়ে গেলে মাছটি পেট জলের উপরে ভাসিয়ে মাথা নিচের দিকে করে ভাসতে থাকে । মাছটি জলের ভিতরে যাবার চেস্টা করে একটু সময়ের জন্য নিচে যেতে পারলেও সামান্য সময় পরে আবার মাছটি জলের উপরে ভেসে যাবে । এই রোগ খুব একটা ছোঁয়াচে নয় ।
(১৪) আলসার ডিজিজঃ
সিউডোমোনাস ব্যাক্টেরিয়ার আক্রমনে মাছের এই অসুখ করে থাকে । এই রোগ সমস্ত জাতের মাছের হতে পারে , এই রোগ খুব খারাপ ধরনের , সঠিক সময়ে চিকিৎসা শুরু না করলে মাছের মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী । এই রোগ হলে মাছের গায়ে ঘা বা ক্ষত সৃষ্টি হয় , এই রোগের একটি অত্যন্ত খারাপ দিক হল , অনেক সময় এই রোগ মাছের শরীরের ভিতরেও হয় , যা আপনার মাছের লিভার এবং কিডনি নষ্ট করে দেয় ,কিন্তু আপনি বাইরে থেকে বুঝতেও পারবেন না ।
আবহাওয়া এবং অন্যান্য কারনে যে সমস্ত রোগ গুলি অ্যাকুরিয়ামের মাছেদের হয়ে থাকে , সেগুলি সম্বন্ধে জেনে নেওয়া যাক । অনেক সময় দেখা যায় মাছ অসুস্থ হয়ে পড়েছে কিন্তু কোন ধরনের রোগ হয়েছে তা বোঝা যাচ্ছে না , ভালো করে ভেবে দেখবেন মাছ গুলি হয়তো কোন বাহ্যিক কারনে অসুস্থ হয়ে থাকতে পারে । দেখে নিন কি কি বাহ্যিক কারনে আপনার অ্যাকুরিয়ামের মাছ অসুস্থ হতে পারে ।
(১) হটাত করে জলের তাপমাত্রা কমে গেলে ।
(২) অ্যাকুরিয়ামের জলে অ্যামোনিয়া বা নাইট্রোজেনের পরিমান বেড়ে গেলে ।
(৩) জলে ক্লোরিন থাকলে ।
(৪) জলে অক্সিজেনের পরিমান কমে গেলে ।
(৫) জলে কোন রকম বিষাক্ত কিছু পড়লে বা তার থেকে বিষক্রিয়া হলে ।
(৬) অ্যাকুরিয়ামের অন্য মাছের দ্বারা আক্রান্ত হলে ।