
ভাবার্থ লিখন
ভাবার্থ লিখন | Bhabartho in Bengali Grammar Notes to each chapter is provided in the list so that you can easily browse throughout different chapter ভাবার্থ লিখন| Vabartho in Bengali Grammar and select needs one.
কোন প্রবন্ধ বা গদ্যরচনার তাৎপর্যধর্মী অংশবিশেষ কিংবা কোন স্বয়ং- সম্পূর্ণ ছোট কবিতা বা দীর্ঘ কবিতার বৈশিষ্ট্যপূর্ণ খণ্ডাংশের অন্তর্নিহিত কেন্দ্রীয় ভাববস্তুকে সংক্ষেপে বিবৃত করাকে ভাবার্থ’ বলা যেতে পারে । ইংরেজিতে ‘Substance’ বলতে যা বোঝায়, বাংলা ভাষায় তারই যথার্থ প্রতিশব্দ হল ভাবার্থ । ভাবার্থকে ‘ভাবসত্য’, ‘ মর্মসত্য’, মর্মার্থ, ‘তাৎপর্য” ইত্যাদি’ নামেও অভিহিত করা যায়।
ভাবার্থ কীভাবে লিখবে?
ভাবার্থ লিখনের কোন ধরা-বাঁধা নিয়ম বলে দেওয়া যায় না। নিয়মিত অভ্যাস বা অনুশীলনের মাধ্যমে ভাবার্থ’ লেখায় নৈপুণ্যে অর্জন করা যায় ৷ তবু, শিক্ষার্থী- দের সূবিধার জন্য ভাবার্থ’ লেখার কিছু পথ নির্দেশে নিচে দেওয়া হল ।
১। যে বিষয়টির ভাবার্থ’ লিখতে হবে তা গদ্য হোক বা পদ্য হোক—সেটি বারবার পড়তে হবে। বারবার পড়বার সময় বিষয়টির মূলভাব কী তা ধরবার চেষ্টা করতে হবে ৷
২। মূলভাবটি নিজের কাছে পরিস্ফুট হলে তা যথাসম্ভব সংক্ষিপ্ত আকারে সহজ-সরলভাবে নিজের ভাষায় প্রকাশ করবে। ভাবার্থ’ লেখার সময় নিম্নোক্ত পদ্ধতিতে মূল রচনার পরিবর্তন ও সংকোচন করবে ।
(ক) মূল রচনা উত্তম পুরুষ বা মধ্যম পুরুষে রচিত হলে ভাবার্থে তাকে প্রথম পরুষে লিখতে হবে ।
(খ) মূল রচনায় কোন উদ্ধৃতি থাকলে উদ্ধৃতি চিহ্ন তুলে দিয়ে তার মর্মার্থ নির্দেশ করতে হবে এবং প্রত্যক্ষ উক্তিকে ভাবার্থে পরোক্ষ উক্তিতে বলে দিতে হবে।
(গ) মূল রচনায় বিশেষ করে কাব্যাংশে উপমা-রূপকাদি, অলংকার বা উদাহরণ বাক্য থাকলে তা যথাসম্ভব বর্জন করে অলংকার বা উদাহরণের অন্তর্নিহিত ভাবটি মাত্র প্রকাশ করতে হবে ।
(ঘ) ভাবার্থে— এমন সব শব্দগুচ্ছে থাকবে যার কোন বাহুল্য নেই অথচ যথেষ্ট প্রকাশ ক্ষমতা আছে। এজন্য দরকার হলে দীর্ঘ বাক্যকে সংক্ষিপ্ত বাক্যাংশে, একাধিক বাক্যাংশকে সমাসবদ্ধ বা প্রত্যয় নিষ্পন্ন পদে সংহত করে বিষয়কে সংকুচিত করতে হবে ৷
(ঙ) মলে রচনায় যে কথা বা ভাবের উল্লেখ নেই ভাবার্থে কখনই তার অবতারণা করা চলবে না ।
(চ) ভাবার্থ আকারে কতটা বড় হবে সে বিষয়ে নির্দিষ্ট কোন পরিমাপ বলে দেওয়া যায় না ৷ বিশেষ করে পদ্যাংশের ভাবার্থে আয়তন নির্দিষ্ট করে বলা যাবে না। মূলভাবটি প্রকাশ করার জন্যে যতখানি লেখা প্রয়োজন তা লিখতে হবে। পদ্যাংশে গভীরভাব সংক্ষেপে বা ইংগিতে প্রকাশ থাকে। তাই তার ভাবার্থ মুলের চেয়ে বড় হবেই । তবে কতখানি বড় হবে তা নির্ভর করবে লেখাকে সংহত করার ক্ষমতার উপর ।
আর গদ্যাংশের ভাবার্থ করতে গেলে লক্ষ্য রাখতে হবে যে, উত্তরটি যেন মুলের এক তৃতীয়য়াংশের বেশী না হয়—এইটুকু লক্ষ্য রাখা উচিত। কোন ভাবার্থ— দুটি বাক্যেও হতে পারে, আবার কোন ক্ষেত্রে পাঁচ-সাতটি বাক্যেও হতে পারে। তবে প্রশ্ন পত্রের আয়তন সম্পর্কে কোন স্পষ্ট নির্দেশ থাকলে সেই নির্দেশই বিশেষভাবে অনূসরণ করতে হবে ।
(চ) ভাবার্থ লিখনে যে সব বাক্য বাক্যাংশ বা শিক্ষার্থীর কাছে গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হবে, সেই সেই জায়গার নিচে প্রয়োজনমত দাগ দিয়ে এবং অপ্রয়োজনীয় অংশ বাদ দিয়ে দাগ দেওয়া অংশের ভিতর থেকে মুলভাব খুজে বের করা যাবে ৷
(ছ) জটিল বাক্য ভাবার্থ’ লেখায় পরিহার করাই ভাল । সেই সঙ্গে কেন্দ্রীয় ভাবকে সংহত করে নিজস্ব রীতিতে প্রকাশ করাই বাঞ্ছনীয় ।
(জ) ভাবার্থে প্রথম বাক্যটি যতদূর সম্ভব আকর্ষণীয় করতে হবে। কেন্দ্রীয় ভাবটির রূপায়ন যত শিল্পশ্রীমণ্ডিত হবে ততই বেশি পরিমাণে পরীক্ষকের মন কেড়ে নিয়ে প্রত্যাশিত ফল লাভ করা যাবে ৷
Example’s of Bhabartho in Bengali Grammar
কয়েকটি আদর্শ ভাবার্থ
[১]
“সেই দেখেছি সেবার গঙ্গার রূপে। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত, বসন্ত কোনো ঋতুই বাদ দিইনি, সব ঋতুতেই মা গঙ্গাকে দেখেছি। বর্ষাকালে দুকুল ছাপিয়ে জল উঠেছে গঙ্গার—লাল টক টক করছে জলের রং …তার উপর গোলাপী পাল তোলা ইলিশ মাছের নৌকো এদিকে ওদিকে দুলে দুলে বেড়াচ্ছে, সে কি সুন্দর। তারপর শীতকালে বসে আছি ‘ডেকে’ গরম চাদর জড়িয়ে, উত্তূরে হাওয়া মুখের উপর দিয়ে কানের পাশ ঘেষে চলেছে হু হু করে। সামনে ঘন কুয়াশা, তাই ভেদ করে ষ্টীমার চলেছে একটানা। সামনে কিছু দেখা যায় না ।মনে হ’ত যেন পুরাকালের ভিতর দিয়ে নতুন যুগে চলেছে কোন রহস্যের উদ্ঘাটন করতে । থেকে থেকে হঠাৎ দু’টি নৌকো সেই ঘন কুয়াশার ভিতর থেকে স্বপ্নের মত বেরিয়ে আসত।”
ভাবার্থ:—গঙ্গার রূপের অন্ত নেই। সব ঋতুতেই গঙ্গার রূপ অপূর্ব । বর্ষায় গঙ্গা ভরা, জলের রং টকটকে গেরুয়া লাল, ইলিশমাছের নৌকো স্রোতে দুলছে। শীতের আর এক রূপে, হিমেল বাতাস। কুয়াশা ঢাকে চারদিক। তা ভেদ করে ষ্টীমার চলে যেন অতীতের থেকে দুর ভবিষ্যতের পানে । কুয়াশার নিবিড়তা ভেঙ্গে বেরিয়ে আসে এক একটি নৌকো সপ্নের মতো ।
[ 2 ]
“নমি আমি প্রতিজনে, — আদ্বিজ -চণ্ডাল,
প্রভু ক্রীতদাস!
সিন্ধুমূলে জলবিন্দু, বিশ্বমূলে অনু,
সমগ্রে প্রকাশ।
নমি, কৃষি-তন্তু-জীবী, স্থপতি তক্ষণ
কর্ম – চর্মকার!
অদ্রিতলে শিলাখণ্ড—দৃষ্টি অগোচরে
বহু অদ্রিভার!
কত রাজ্য, কত রাজা গড়িছে নীরবে
হে পূজ, হে প্রিয়!
একত্বে বরেণ্য তুমি, শরণ্য এককে—
আত্মার আত্মীয়।”
ভাবার্থ:—এক পরম পিতা বিশ্বচরাচরে বিদ্যমান। এই সত্য উপলব্ধি হলে জীবে জীবে পার্থক্য বোধ আর থাকে না। ছোট-বড় দ্বিজ-চণ্ডাল সবই এক মনে হয় । কারণ সবার মধ্যেই সেই বিশ্বাত্মার উপস্হিতি । জীবের মধ্যে শিব দর্শন- এই মর্মসত্য উপলদ্ধির মধ্যে সকলেই প্রিয় হয়—সকলেই হয় আত্মার পরমাত্মীয়।
[3]
হে বঙ্গ; ভাণ্ডারে তব বিবধ রতন;-
তা সবে, (অবোধ আমি!) অবহেলা করি,
পর-ধন-লোভে মত্ত, করিনু ভ্রমণ
পরদেশে, ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আচরি।
কাটানু বহু দিন সুখ পরিহরি!
অনিদ্রায়, নিরাহারে স*পি কায়মন:
মজিনু বিফল তপে অবরণ্যে বরি,
ফেলিনু, শৈবালে; ভুলি কমল-কানন!
স্বপ্নে তব কুললক্ষ্মী ক’য়ে দিলা পরে;-
“ওরে বাছা মাতৃ কোষে রতনের রাজি,
এভিখারী-দশা তবে কেন তোর আজি?
যা ফিরি, অজ্ঞান তুই, যা রে ফিরি ঘরে!”
পালিলাম আজ্ঞা সুখে; পাইলাম কালে
মাতৃ-ভাষা-রূপে খনি, পূর্ণে মণিজালে॥
ভাবার্থ :- বাংলা বাঙ্গালির মাতৃভাষা । বাংলা ভাষা শব্দ সম্পদে ঐশ্বর্যশালী। সেই ঐশ্বর্যময়ী বাংলা ভাষাকে পরিত্যাগ করে কোন আত্মবিশ্বতে বঙ্গসন্তান যদি মোহের বশে বিদেশী ভাষা চর্চার আত্মনিয়োগ করে—তাহলে তাকে একদিন ব্যর্থতার গ্লানি ও দুঃখ অবশ্যই ভোগ করতে হয়। অবশেষে মোহভাঙ্গার পর পুনঃ মাতৃভাষার চর্চার মাধ্যমে সে ঐশ্বর্যময়ী বাঙলাভাষার রূপৈশ্বর্য দেখে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে যায়।
[8]
দেবতা-মন্দির মাঝে ভকত প্রবীণ
জপিতেছে জপমালা বসি নিশিদিন ।
হেনকালে সন্ধ্যাবেলা ধুলিমাখা দেহে
বস্ত্রহীন জীর্ণ দীন পশিল সে গেহে।
কহিল কাতর কণ্ঠে, “গৃহ মোর নাই।
একপাশে দয়া করে দেহ মোরে ঠাঁই।”
সসংকোচে ভক্তবর কহিলেন তারে,
‘আরে আরে অপবিত্র, দূরে হয়ে যারে ।
সে কহিল “চলিলাম” । চক্ষের নিমেষে
ভিখারী ধরিল মূর্তি দেবতার বেশে!
ভক্ত কহে, “প্রভু মোরে কী ছল ছলিলে?”
দেবতা কহিল, “মোরে দূর করি দিলে,
জগতে দরিদ্ররূপে ফিরি দয়া তরে,
গৃহহীনে গৃহ দিলে আমি থাকি ঘরে ৷
ভাবার্থ :- দীন দরিদ্র সকলের মধ্যেই দেবতার অধিষ্ঠান। তাই দরিদ্রের সেবার মধ্যে ভগবানের সেবা, দরিদ্রের প্রতি করুণাই যথার্থ ভগবৎ সেবা হয়ে থাকে। সুতরাং দীনদরিদ্রকে অবহেলা করে যতই ভক্তিশ্রদ্ধা সহ দেবতার সাধনা করা হোক না কেন- তাতে দেবতা তুষ্ট হন না। ভগবানকে পেতে হলে মানুষেরই সেবা করা উচিত।
[ ৫ ]
জগৎ জুড়িয়া এক জাতি আছে সে জাতির নাম মানুষ জাতি
একই পৃথিবীর স্তন্যে লালিত একই রবি-শশী মোদের সাথী।
শীতাতপ ক্ষুধা তৃষ্ণার জালা সবাই আমরা সমান বুঝি ।
কচি-কাঁচাগুলি ডাঁটা বরে তুলি, বাঁচিবার তরে সমান বুঝি ।
দোসর খুঁজি ও বাসর বাঁধি গো, জলে ডুবি, বাঁচি পাইলে ডাঙা ।
কালো আর ধুলো বাহিরে কেবল ভিতরে সবারি সমান রাঙা ।
বাহিরের ছোপ আঁচড়ে সে লোপ, ভিতরের রং পলকে ফোটে,
বামুন, শূদ্র, বৃহৎ, ক্ষুদ্র, কৃত্রিম ভেদ ধুলায় লোটে ।
রাগে অনুরাগে নিদ্রিত জাগে আসল মানুষ প্রকট হয়,
বর্ণে বর্ণে নাইরে বিশেষ নিখিল জগৎ ব্রহ্মময় ৷
ভাবার্থ :—মানষের ক্ষুদ্র ভেদবদ্ধিই একজন মানুষকে অপর মানুষের কাছ থেকে পৃথক করে রাখে। এই কৃত্রিম ভেদবুদ্ধি থেকেই জাতিভেদ, শ্রেণীভেদ, বর্ণভেদ দেখা দেয় ৷ কিন্তু মানব সম্প্রদায় এক ও অভিন্ন। মানুষে মানুষে কোন পার্থক্য নাই । সকলেই সেই এক পরম ব্রহ্মের অংশ। জলবায়ু – মাটি অবস্থানগত বৈচিত্র্যের জন্যে দেশে দেশে, জাতিতে জাতিতে কিছু বাহ্যিক পার্থক্য দেখা দিলেও দিতে পারে, কিন্তু জীবনের আভ্যন্তরীণ প্রবর্তনার দিক দিয়েও আমরা দেখি সব মানুষ এক ও অভিন্ন। মানুষে মানুষে অভেদবোধ থেকেই আমাদের জীবনে পরম সার্থকতা লাভ করতে পারে।
[৬]
তবু ভরিল না চিত্ত, ঘুরিয়া ঘুরিয়া
কত তীর্থ— হেরিলাম । বন্দিনু পুলকে
বৈদ্যনাথে; মুঙ্গেরের সীতাকুণ্ডে গিয়া
কাঁদিলাম চির দুঃখী জানকীর দঃখে
হেরিনু বিন্ধ্যাবাসিনী বিন্ধ্যে আরোহিয়া
করিলাম পণ্যেস্নান ত্রিবেণী সঙ্গমে;
“জয় বিশ্বেশ্বর” বলি ভৈরবে বেড়িয়া
করিলাম কত নৃত্যে; প্রফুল্ল আশ্রমে
রাধাশ্যামে নিরখিয়া হইয়া উতলা,
গীত গোবিন্দের শ্লোক গাহিয়া গাহিয়া
ভ্রমিলাম কুঞ্জে কুঞ্জে ; পাণ্ডারা আসিয়া
গলে পরাইয়া দিল বর-গুঞ্জমালা ।
তবু ভরিল না চিত্ত। সর্ব-তীর্থসার,
তাই মা তোমার পাশে এসেছি আবার।
ভাবার্থ:—জন্মভুমি সকল তীর্থে’র সেরা। পৃথিবীতে, দেশের নানা স্থানে কত ঐতিহাসিক স্থান, ধর্মে’র পবিত্র তীর্থস্থান আছে। তাদের সাথে কোন দিক দিয়ে জন্মভূমির কোন তুলনা হতে পারে না। ঐ সমস্ত ইতিহাস প্রসিদ্ধ স্থান তীর্থস্থান বাহ্যিক জ্ঞান ও ধর্মীয় চেতনা তৃপ্ত করলেও হৃদয়ের তৃষ্ণা মেটাতে পারে না । জন্মের সঙ্গে সঙ্গে জন্মভুমির সাথে সে নিবিড় ও গভীর আত্মীয়তার সংযোগ ঘটে তা অন্য যে কোন তীর্থস্থান অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। জন্মভুমির প্রতি ভালবাসা আকর্ষণ তুলনা- বিহীন ।
[৭]
থাকব নাকো বদ্ধ ঘরে দেখবো এবার জগৎটাকে,
কেমন করে ঘুরছে মানুষ যুগান্তরের ঘূর্ণিপাকে ।
দেশ হতে দেশ-দেশান্তরে ছুটেছে তারা কেমন করে,
কিসের নেশায় কেমন করে মরছে বা বীর লাখে লাখে,
কিসের আশায় করছে তারা বরণ মরণ-যন্ত্রণাকে।
কেমন করে মথুলে পাথর লক্ষ্মী উঠেন পাতাল ফুঁড়ে,
কিসের অভিযানে মানুষে চড়ছে হিমালয়ের চূড়ে,
তুহিন-মেরু পার হয়ে যায় সন্ধানীরা কিসের আশায় ?
হাউই চড়ে চায় যেতে কে চন্দ্রলোকের অচিন পরে—
শুনব আমি ইঙ্গিত কোন, মঙ্গল হতে আসছে উড়ে ৷
ভাবার্থ:- প্রকৃতির অজানা রহস্যের প্রতি মানুষের আকর্ষণ চিরকালের। প্রকৃতির রহস্যের জাল উম্মোচনের জন্য মানুষ তাই যুগে যুগে বৈজ্ঞানিক শক্তিকে সম্বল করে পাড়ি জমিয়েছে, পাহাড়ে-প্রান্তরে-দরে উত্তাল সমদ্রের বুকে। রহস্যের আবরণ উন্মোচনের আত্যন্তিক প্রচেষ্টার মাধ্যমেই প্রকাশ পায় মানুষের মর্ত্যসীমা অতিক্রম করে অমরত্ব লাভের দুর্নিবার আকাংখাকে ।
[৮]
ওরা চির কাল
টানে দাঁড়, ধরে থাকে হাল
ওরা মাঠে মাঠে
বীজবোনে পাকা ধান কাটে-
ওরা কাজ করে
নগরে প্রাতরে!
রাজছত্র ভেঙে পড়ে, রণ ডংকা নাহি শব্দ তোলে
জয়স্তম্ভ মূঢ় সম অর্থ তার ভোলে,
রক্ত মাখা অস্ত্র হাতে যত রক্ত আঁখি
শিশু পাঠ্য কাহিনীতে থাকে মুখে ঢাকি।
ওরা কাজ করে
দেশ-দেশান্তরে
অঙ্গ-বঙ্গ কলিঙ্গের সমদ্রে-নদীর ঘাটে ঘাটে
পাঞ্জাবে বোম্বাই-গজরাটে ।
ভাবার্থ :—সভ্যতার অগ্রগতিতে প্রবল প্রভাপান্বিত্য রাজশক্তির চেয়ে শ্রমজীবী মানুষের অবদান অনেক বেশী। ইতিহাস সাক্ষী, যুগে যুগে কত শত শক্তিশালী রাজশক্তির আবির্ভাব পাথিবীতে হয়েছে কিন্তু কালের অমোঘ নিয়মে তাদের রাজশক্তির দাপট স্থায়িত্ব লাভ করেনি। কোথায় তলিয়ে গেছে তাদের বিক্রম, আধিপত্য, রাজ্য, রাজধানী । তাতে কিন্তু মানব সভ্যতার অগ্রগতি ক্ষুণ্ণ হয়নি। আসলে মানব সভ্যতার আসল ধারক ও বাহক হচ্ছে শ্রমশক্তি। মানুষের উৎপাদনশীল শ্রমশক্তিই মানব সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। শ্রমশক্তির মত্যু নেই। তা চিরঞ্জীব ও চিরস্থায়ী।
[৯]
সংগীতের ন্যায় মানব জীবনেরও একটি মূল রাগিনী আছে। সুগায়ক কণ্ঠের গীতি যেরূপ নানারূপে আলাপ-চারিতে ঘুরিয়া ফিরিয়াও স্বীয় মূল রাগিনী বাহিরে যাইয়া পড়ে না, মানব চরিত্রেরও সেইরূপ একটি স্ব-পরিচায়ক স্বাতন্ত্র্য আছে, সেইটিকেই জীবনের মূলে রাগিনী বলা যায় ; জীবনের কার্য‘কলাপ সমগ্রভাবে বিবেচনা করিলে উহা আবিষ্কৃত হয় । যিনি যাহাই বলুন, সেই অভিষেকাপযোগী বিশাল সম্ভারের প্রতি অবজ্ঞার সহিত দাষ্টিপাত করিয়া অভিষেক ব্রতোজ্জ্বল শুদ্ধ পট্ট-বস্ত্রধারী রামচন্দ্র যখন বলিয়াছেন—“তাহাই হউক, আমি রাজার প্রতিজ্ঞাপালন পূর্বক জটাবল্কল ধারণ করিয়া বনবাসী হইব।”—সেই দিনের সেই চিত্রেই রামের অমর চিত্র,—এই অপর্ব বৈরাগ্যের শ্রী তাহাকে চিনাইয়া দিবে। যেদিন রাবণ রামের শবাসনের তেজে ভ্রষ্টকুণ্ডল ও হতশ্রী হইয়া পালাইবার পন্থা পাইতে ছিলেন না, সেদিন রামচন্দ্র ক্ষমাশীল গভীর কণ্ঠে বলিয়াছিলেন—“রাক্ষস, তুমি আমার বহূ, সৈন্য নষ্ট করিয়া এখন একান্ত ক্লান্ত হইয়া পড়িয়াছ, আমি ক্লান্ত ব্যক্তির সহিত যুদ্ধে করি না, তুমি আজ গৃহে গিয়া বিশ্রাম কর, কল্য সবল হইয়া পুনরায় যুদ্ধ করিও।” সেই মহাভবের মহতী প্রাঙ্গন ভূমিতে ধার্মিক প্রবরের সেই কন্ঠম্বর স্বর্গীয় ক্ষমা উচ্চারণ ; উহাই তাহার চিরাভ্যস্ত কণ্ঠধানি।
ভাবার্থ:—সংগীতের বিচিত্র আলাপচারিতার মধ্যেও যেমন একটা মূল রাগিনী থাকে, তেমনি মানুষের বিভিন্ন কর্ম প্রণালীর মধ্যে তার স্বভাবের একটা বিশিষ্টরপ স্পষ্ট হয়ে ধরা দেয় সেটাই তার চরিত্রের মূল রাগিনী। রামচন্দ্রের সমগ্র জীবনে বিচিত্র কমবহুলতার মধ্যেও সেই মূল রাগিনীর সন্ধান পাওয়া যায়। তাঁর কর্ম জীবনের প্রধান দুটি কাজের মাধ্যমে প্রকাশ পায়। রাজ্যভিষেকের পরম কাঙ্খিত লগ্নে স্বেচ্ছায় বনবাস গ্রহণের ইচ্ছায় এবং যুদ্ধক্লান্ত রাবণের দেহে অস্ত্রাঘাত না করার সিদ্ধাতে রামচন্দ্রের মহানুভবতার নিদর্শন মেলে। প্রথম ঘটনায় রামচরিত্রের অন্তরে বৈরাগ্যের ভাব এবং দ্বিতীয় ঘটনায় তাঁর ক্ষমাসুন্দর মূর্তি টি চোখে পড়ে । এই বৈরাগ্য ও ক্ষমাই রামচরিত্রের মূলে রাগিনী ।
[১০]
বৈজ্ঞানিকের সহিত সাহিত্যিকের একটি স্থানে মিল আছে। ইতর সাধারণ সকলেই সম্মুখে যাহা পড়ে, তাহাই কুড়াইয়া লইয়া সেই কয়টা জিনিসকে জীবনের কাজে লাগাইয়া যেন-তেন-প্রকারেন তাড়াতাড়ি জীবন যাত্রায় দৌড়িয়া চলিতেছে ; আশে পাশে যাহা আছে, তাহার প্রতি মনঃসংযোগের অবকাশ পাইতেছে না। কিন্তু কয়েকজন লোক এই আশে পাশে চাহিয়া অন্যে যাহা দেখে না, তাহাই দেখেন এবং ইতর সাধারণকে যখন দেখান, তখন তাহারা নতুন কি দেখিলাম বলিয়া চমকাইয়া উঠে। বৈজ্ঞানিক বলেন “দেখ, এত বাস্তবিক সত্য, তুমি এতদিন দেখ না; ইহা হইতে জীবনের কত প্রয়োজন সিদ্ধি, জীবন যুদ্ধে কত সাহায্য ঘটিতে পারে।” সাহিত্যিক বলেন—“দেখ এত সন্দর দৃশ্যের প্রতি তুমি এতকাল তাকাও নাই । ইহা হইতে কত আনন্দ মিলিতে পারে, জীবন যুদ্ধের আনুষঙ্গিক দঃখ কত কমাইতে পারা যায়।” একজন যেখানে সত্যের অন্যজন সেখানে সুন্দর আবিষ্কার করেন ৷
ভাবার্থ:- বৈজ্ঞানিক ও সাহিত্যিকের মধ্যে দৃষ্টিভঙ্গীতে পার্থক্য আছে। তাহলেও উভয়ের মধ্যে এক জায়গায় মিল আছে। যে জিনিস সাধারণের নজরে পড়ে না, বৈজ্ঞানিক ও সাহিত্যিক তা সহজেই দেখতে পান। বৈজ্ঞানিক তা থেকে সত্যকে আবিষ্কার করে জীবনের ক্ষেত্রে তার উপযোগীতা কত তা ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দেন, আর সাহিত্যিক তা থেকে সৌন্দর্য আবিষ্কার করে তাকে আনন্দের উপাদান হিসেবে ব্যবহার করেন। একজন সত্যসন্ধানী অন্যজন সৌন্দর্যে’র সন্ধানী । প্রথম জন বৈজ্ঞানিক, দ্বিতীয় জন সাহিত্যিক ৷
[১১]
“ধৈর্য ধর, ধৈর্য ধর, বাঁধ বাঁধ বুক
অনন্ত মরণ যদি আসিবে – আসুক!
স্থাপ তুমি জয়স্তম্ভ,
কর আত্ম অবলম্ব,
দাও অস্থি মেদ মঞ্জা, লাগে যতটুকু
শতসূর্য করি গুঁড়া
গড় সে উজ্জ্বল চূড়া
বাধা বিঘ্ন ঠেলি পদে
সিংহ-ফিরে বীরমদে
আত্মগপ্ত সভয়ে শুম্বুকে!
ভাবার্থ:—জীবনের চলার পথে নানান দুঃখ বাধা-বিঘ্ন আসতে পারে । তাতে বিচলিত হলে চলবে না। ধৈর্য ধারণ করে আমাদের সকল বাধা অতিক্রম করে এগিয়ে যেতে হবে। কত‘ব্যসাধন করার কাজে যেটাকু ত্যাগ স্বীকারের প্রয়োজন, তা অবশ্যই করা উচিত। তার জন্যে যদি মৃত্যুও ঘনিয়ে আসে—তাতেও বিচলিত হলে চলবে না – তাকে সানন্দে বরন করে নিতে হয়।